শিরোনাম
রবিবার, ৩০ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

স্টিভ জবস এবং আমার কথা

অধ্যাপক জীবেন রায়

স্টিভ জবস এবং আমার কথা

স্টিভ জবস এবং অ্যাপলের নাম বিশ্বজুড়ে অনেকেই শুনেছেন বা জানেন। একটি পরিসংখ্যান মতে, ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সি তরুণরা টমাস এডিসনের পরই জবস নামের সঙ্গে পরিচিত। অ্যাপল বর্তমানে ৩.২৬ ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানি। কিন্তু বিশ্ববাসীর দুর্ভাগ্য, মাত্র ৫৬ বছর বয়সে ২০১১ সালে স্টিভ জবস ক্যান্সারে মারা যান। তার জন্ম থেকে শুরু করে যদ্দিন বেঁচেছিলেন, বিচিত্র সব কাহিনি রয়েছে তাকে ঘিরে। ইউটিউবে স্টিভ জবস লিখলেই কয়েক ডজন ওয়েবসাইট এসে যাবে। তাকে নিয়ে ডকুমেন্টারি, সিনেমা সবই হয়েছে। আমি অন্য কিছু বলব, যা পাঠকদের ভালো লাগতে পারে। সুদূর হাঙ্গেরিতে তার বেশ কয়েকটা স্ট্যাচু শোভা পাচ্ছে।

সিরিয়ান মুসলিম বাবা, আমেরিকান খ্রিস্টান মা কিন্তু জন্মের পর থেকেই দত্তক নেওয়া পরিবারে বড় হয়েছেন। জবসের বাবা, আবদুল ফাতাহ জানডালি উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করাকালে তার মা, ক্যাথলিক খ্রিস্টান, জোয়ান সিয়েবেলের সঙ্গে পরিচয় ও প্রেম হয়। কিন্তু জোয়ানের পরিবারের বিরোধিতায় প্রেমটা বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি। এদিকে জোয়ান প্রেগনেন্ট হয়ে পড়েন। মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রথমে সানফ্রান্সিসকোতে কলেজ গ্র্যাজুয়েটস দম্পতির কাছে অ্যাডপ্টেশানের ব্যবস্থা হয় কিন্তু নবজাতক ছেলে হওয়ায় তারা নিতে রাজি হয়নি। পরবর্তীতে উইসকনসিনে পল এবং ক্লারা জবস দম্পতি শিশু স্টিভকে দত্তক নেন।

মৃত্যুশয্যায় থাকা অবস্থায় স্টিভ জবসের শেষ পরামর্শগুলো আমার বিশ্বাস মানুষকে ভালো মানুষ হতে সাহায্য করবে। যে কেউ এ ধরনের পরামর্শ বা কথা বলতে পারে, কিন্তু জীবনে একজন সফলতম, এই শতাব্দীর সুপার জিনিয়াস এবং সৃজনশীল স্টিভ জবস যখন বলেন, তখন সেটা অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য। এবার তাহলে পড়ুন তার বক্তব্য আর আমার কথা।

স্টিভ জবস : ১/আমি ব্যবসায়িক জগতে সাফল্যের শিখরে পৌঁছেছি। অন্যদের চোখে আমার জীবন সাফল্যের প্রতীক। তবে কাজ বাদ দিয়ে আমার আনন্দ কম। শেষ পর্যন্ত, সম্পদ হলো জীবনের একটি সত্য যাতে আমি অভ্যস্ত। তবে এ মুহূর্তে, বিছানায় অসুস্থ অবস্থায় শুয়ে এবং আমার পুরো জীবনকে স্মরণ করে, আমি বুঝতে পারি যেসব স্বীকৃতি এবং সম্পদের জন্য আমি এত গর্ব করেছিলাম, আসন্ন মৃত্যুর মুখে তা ফ্যাকাশে এবং অর্থহীন হয়ে গেছে।

আমার কথা : আপনি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখুন আর বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা করুন, মোদ্দা কথা মৃত্যু অমোঘ সত্য। জেনেটিক ব্লুপ্রিন্ট অনুযায়ী আমাদের জীবনযাত্রা অব্যাহত থাকে। সুতরাং বলা চলে জীবন একটা লুপে আবদ্ধ। দুর্ঘটনাহীন এবং ক্যান্সারহীন জীবন কাটাতে পারলে বড়জোর ১০০ বছরের জীবন মানুষের। মূল কথাটা হলো, মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সব সম্পদ অর্থহীন হয়ে পড়ে। তাই যদি হয়, আপনি কি দুর্নীতি করে সম্পদ বানাবেন? বাংলাদেশে ক্ষমতাবানরা জোর বা কৌশল খাটিয়ে সম্পদের পাহাড় বানাচ্ছেন। এমনকি অন্যকে নিঃস্ব বানিয়ে। সংখ্যালঘুদের ধমক দিয়ে। হে দুর্নীতিবাজ মানুষ, আপনাদের মৃত্যুভয় নেই? দুর্নীতির টাকায় বানানো আলিশান বাড়িতে আপনারা ঘুমাতে পারেন কি? সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সামর্থ্য আছে কিন্তু জানবেন তা ধন্বন্তরি নয়। স্টিভ জবস পরিশ্রম, মেধা ও সৃজনশীলতা দিয়ে সম্পদ বানিয়েছেন। তারপরও তার এত অনুশোচনা। আপনাদের শরীর ও মনন তো আর ইস্পাত দিয়ে তৈরি নয়। অবশ্যই নশ্বর।

স্টিভ জবস : ২/হারিয়ে যাওয়া বস্তুগত জিনিস পাওয়া যাবে। কিন্তু একটা জিনিস আছে যেটা হারিয়ে গেলে কখনোই পাওয়া যায় না- ‘জীবন’।

আমার কথা : আমরা সবাই জানি জীবনপ্রদীপ নিভে গেলে আর জ্বলে ওঠে না। আর আমাদের কিছু হারিয়ে গেলে আমরা ভেঙে পড়ি। কিছুটা খারাপ তো লাগবেই, তবে একেবারে ভেঙে পড়া নয়। আমি বিয়ের পর একবার নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্রেনে ঢাকা আসছিলাম। হঠাৎ ফতুল্লা থেকে ছাড়ার পর আমার পাশের লোকটি দাঁড়িয়ে ছুরি মেলে ধরল। আরও দুজন দাঁড়িয়ে গেল। বলল যার যা আছে বের করেন। আমি তো আগ বাড়িয়ে ঘড়ি, চেইন এবং মানিব্যাগ বের করে দিলাম। বললাম এই কার্ডগুলো নেবেন না, বাকি সব নিয়ে নেন। আমার প্রথম প্রায়োরিটি, আমার ‘জীবন’ অন্য কিছু নয়। আমি ভীতু হতে পারি কিন্তু জীবনকে ভীষণ ভালোবাসি।

স্টিভ জবস : ৩/ বয়স বাড়ার সঙ্গে আমাদের বুদ্ধিও বাড়ে। আমরা ধীরে ধীরে বুঝতে পারি যে ৩০০ টাকা বা ৩০ ডলারের ঘড়ি পরায় সময়ের দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই। তারা উভয়ই একই সময় বলে। একইভাবে আমরা ৩০০ টাকা বা ৩০ ডলারের মানিব্যাগ/হ্যান্ডব্যাগ বহন করি না কেন- ভিতরে একই পরিমাণ ডলার। গাড়ির ব্যাপারেও কম এবং বেশি দামের গাড়ি আমাদের একই গন্তব্যে পৌঁছাব।

আমার কথা : স্টিভ জবসের এ কথাগুলো আমার প্র্যাকটিসের সঙ্গে হুবুহু মিলে যাচ্ছে। এ যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম যখন আসি, দেখতাম প্রতিটি বাড়িতে ২-৩টা করে গাড়ি। সেজন্যই তো এত এত গাড়ি প্রতিদিন ব্যবহৃত হয়। ২০২২ সালের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে রেজিস্টার্ড গাড়ির সংখ্যা প্রায় ২৯ কোটি। আমাদেরই ৩ মেয়ের একটা করে ৩টি গাড়ি আর আমাদের স্বামী-স্ত্রীর জন্য একটি গাড়ি। অবশ্য মেয়েরা অন্যান্য শহরে বসবাস করে। আমাদের গাড়িটি কিনেছি ২০০৮ সালে এবং এটি সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি। সেই গাড়িটি আমারই মতো বুড়ো হয়ে গেছে, অনেকটাই জীর্ণশীর্ণ, সেটাই চালিয়ে যাচ্ছি এখনো। গন্তব্যস্থলে ঠিক ঠিকই চলে যাচ্ছি। মাঝে-মধ্যে গাড়ির ডাক্তারকে দেখাতে হয় বৈকি। মনের মধ্যে কোনো দুঃখবোধ নেই। একটা ঘড়ি এখনো অনেক বছর ধরে আমার স্ত্রীর ফেসবুক বন্ধু সাঈদ ভাই আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। এখনো ঘড়িটি সঠিক সময় দিয়ে যাচ্ছে। পকেটে একটি মানিব্যাগ আজ ক’বছর ধরে ব্যবহার করে আসছি। জীবন তো চলছে, খুব একটা খারাপভাবে নয়।

স্টিভ জবস : ৪/আপনি বুঝতে পারবেন, আপনার প্রকৃত অভ্যন্তরীণ সুখ এই জগতের বস্তুগত জিনিস থেকে আসে না। আপনি ফার্স্ট ক্লাসে প্লেনে চড়ুন বা ইকোনমি ক্লাসে, প্লেন যদি নিচে পড়ে যায়-আপনিও নিচে পড়ে যাবেন।

অতএব, আমি আশা করি আপনি বুঝতে পারবেন, যখন আপনার সঙ্গী, বন্ধু এবং পুরনো বন্ধু, ভাই এবং বোন আছে, যাদের সঙ্গে আপনি আড্ডা দেন, হাসেন, কথা বলেন, গান করেন, উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম বা পৃথিবী, স্বর্গ সম্পর্কে কথা বলেন... এটাই প্রকৃত সুখ!!

আমার কথা : প্লেনে ফার্স্ট ক্লাসে চড়া অবশ্যই আরামদায়ক। খাবার, ড্রিংকস অঢেল কিন্তু দুর্ঘটনার ফলাফলে কোনো তারতম্য নেই। আমি একসময় প্রচুর প্লেনে চড়েছি তবে ফার্স্ট ক্লাসে অবশ্যই নয়। দু-একবার এয়ারলাইনস এমনিতেই আপগ্রেড করে দিয়েছে। তাছাড়া ফার্স্ট ক্লাসে চড়ার সামর্থ্য থাকতে হবে তো? আর এখন তো একটা ফোবিয়াতে ভোগী। যদি দুর্ঘটনা হয় তাহলে সব শেষ। তবে লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে ভালোবাসি। আড্ডা দিতে ভালোবাসি। আবার একা থাকতেও ভালোবাসি।

স্টিভ জবস : ৫/আপনার খাবার আপনার ওষুধ হিসেবে খান। অন্যথায় আপনাকে খাবার হিসেবে ওষুধ খেতে হবে।

আমার কথা : হিপোক্রেটের বাণীটিই স্টিভ জবস পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। সুস্বাস্থ্যের জন্য নিউট্রিশনের ভূমিকার কথাকেই জোর দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে বৃদ্ধ বয়সে সমস্যাগুলো যেন কম উঁকি দেয়।

স্টিভ জবস : ৬/আপনার সন্তানদের ধনী হতে শিক্ষিত করবেন না। তাদের সুখী হতে শিক্ষিত করুন। সুতরাং তারা যখন বড় হবে তখন তারা জিনিসের মান জানবে দাম নয়।

আমার কথা : অবশ্য চাইলেই সন্তানদের ধনী বানানো যায় না। যদি না সন্তানদের পিতামাতা আগে থেকেই ধনী হয়। স্টিভ জবস, বিল গেটস- তারা কিন্তু তাদের সব সম্পদ ছেলেমেয়েদের লিখে দেননি। কাজেই মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের সন্তানদের ধনী হওয়ার চিন্তা না করে শিক্ষা বা শিক্ষিত করে তোলার দিকে মনোযোগ দেওয়াই উচিত। আমার আগের লেখাটায় বলেছিলাম, আমার বাবা তার সন্তানদের শিক্ষার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। এমনকি বুড়ো বয়সে তাঁর কনিষ্ঠতম সন্তানের শিক্ষার জন্য কিই না করেছেন। ১৯৬৭ সালে তাঁর সন্তান ঢাকা বোর্ডে পঞ্চম স্থান নিয়ে স্ট্যান্ড করেছিল। বাবার সে কি আনন্দ! টাকা-পয়সা দিয়ে সেই আনন্দ কেনা যায় না। কানাডাতে পিএইচডি করতে আসব। প্লেনের ভাড়াটা কোথায় পাই? নিষ্ঠা ও একাগ্রতা থাকলে সবই ম্যানেজ হয়ে যায়। বাংলায় জৈব রসায়ন-একটি বই লিখেছিলাম। কপি রাইট বিক্রি করে টাকা পেয়ে গেলাম। কাজেই আমার বাবার সন্তান শিক্ষার সরু পথটা দিয়ে চলতে গিয়ে পেছনে তাকায়নি। শিক্ষার সর্বোচ্চ শিখরে উঠে গিয়েছে। ধনী হওয়ার পথ কখনো খোঁজ করিনি। ধনপতি কনের বাবারা চেষ্টা কম করেননি। অর্থের বিনিময়ে ভালোবাসায় কখনোই প্রকৃত সুখী হওয়া যায় না। তেমনি সমাজ থেকে যৌতুক প্রথার নির্বাসন হওয়া উচিত। একসময় বেলিফুলের মালায় বিয়ে নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছিল। সে ধরনের কিছু চালু হলেই ভালো।

পরিশেষে বলতে চাই, সৃজনশীলতার জন্য উচ্চশিক্ষিত এমনকি তেমন শিক্ষারও প্রয়োজন নেই। মাঠে যারা কৃষিকাজ করে তারাই সে কাজের এক্সপার্ট। সেখানেই তাদের সৃজনশীলতা দেখাতে পারে। সেজন্য অবশ্য উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন হতে পারে।

লেখক : বিজ্ঞান ও অঙ্ক বিভাগ, মিসিসিপি ইউনিভার্সিটি ফর উইম্যান, কলম্বাস, যুক্তরাষ্ট্র

Email: [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর