শিরোনাম
রবিবার, ৩০ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

মক্কা বিজয়ের গুরুত্ব

এম এ মান্নান

মক্কা বিজয়ের গুরুত্ব

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কা বিজয় ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ঐতিহাসিকদের মতে, মক্কা বিজয়ের পরপর আরব উপদ্বীপ একত্রিত হওয়ার সুযোগ পায় এবং ইসলাম আরব উপদ্বীপের সীমানা পেরিয়ে অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। মানবতার বিকাশে যা অবদান রাখে। আরবের প্রধান শহর মক্কা ইসলামী বিশ্বের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র। ওলন্দাজ প্রাচ্যবিদ ডোজির মতে, মক্কার ইতিহাস শুরু হজরত দাউদের সময় থেকে।

তাওরাত এবং ইনজিলেও মক্কার কথা উল্লেখ রয়েছে। হজরত ইব্রাহিম (আ.) মিসর থেকে ফিলিস্তিনে আসার পর আল্লাহ তাকে মক্কার দিকে যাওয়ার নির্দেশ দেন। স্ত্রী হাজেরা ও পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে নিয়ে মক্কায় আসেন তিনি। এ সময় তিনি মক্কায় খানা-এ-কাবার ভিত্তি স্থাপন করেন। খানা-এ-কাবা একটি প্রাচীনতম ভবনের ওপর স্থাপন করা হয়। যে ভবনটি প্রথম মানব হজরত আদম (আ.) কর্তৃক নির্মিত। বহু শতাব্দী ধরে নানান সমস্যায় ভারাক্রান্ত মানুষ ওই স্থাপনায় আসতেন মনস্কামনা পূরণ করতে।

‘দ্য ক্যামব্রিজ হিস্ট্রি অব ইসলাম’ অনুযায়ী প্রাক-ইসলামিক যুগে আরবে বিভিন্ন ছোট নগররাষ্ট্র ছিল। রসুল (সা.)-এর জন্মের আগেই মক্কা আরবের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। ‘দ্য ক্যামব্রিজ হিস্ট্রি অব ইসলাম’ বলছে দীর্ঘ যুদ্ধের কারণে পারস্য ও রোম সাম্রাজ্য ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিল। আর অন্যদিকে শক্তিশালী হয়ে উঠছিল মক্কা। মক্কার গুরুত্বের অন্যতম কারণ ছিল বায়তুল্লাহ বা কাবাঘর। মক্কার গুরুত্ব বোঝা যেত পবিত্র মাসগুলোতে। প্রতি বছর মক্কায় সেই সময় মানুষের ঢল নামত। মক্কাবাসী বিখ্যাত ছিলেন তাদের আতিথেয়তার জন্য। বায়তুল্লাহর অতিথি মনে করে সেখানে আসা মানুষকে যথাসম্ভব সেবা করতেন মক্কাবাসী। একইভাবে অতিথিরাও সম্মান করতেন মক্কাবাসীকে। মদিনায় হিজরতের পর মক্কাবাসী মুশরিকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে তিনটি যুদ্ধে লড়েছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে, সে সময় ইসলামবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মক্কা। আর তার নেতৃত্বে ছিলেন কুরাইশ সম্প্রদায়ের মানুষ। ৬ হিজরি অর্থাৎ ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের নবী এবং তাঁর সহচররা কাবা জিয়ারত বা ওমরাহর জন্য রওনা হন। এ ধর্মীয় সফরে আহরাম পরিধান করেছিলেন তাঁরা। আরবদের ঐতিহ্য ছিল কোনো ব্যক্তি আহরাম বেঁধে মক্কায় এলে তাকে বাধা দেওয়া হতো না। শত শত বছর ধরে চলে আসছিল এ প্রথা। মক্কার ৯ মাইল আগে হুদাইবিয়া পৌঁছে হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কার কুরাইশ সম্প্রদায়ের কাছে বার্তা পাঠান। বার্তায় বলেন, তাদের আগমনের উদ্দেশ্য বায়তুল্লাহ দর্শন। তারা যুদ্ধের জন্য আসেননি। তাদের বাধা দিতে কুরাইশরা উরওয়া ইবনে মাসউদকে পাঠিয়েছিল। কিন্তু সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি।

এ পরিস্থিতিতে হজরত ওসমান (রা.)-কে মক্কার অভিজাতদের সঙ্গে আলোচনার জন্য পাঠানো হলে তাঁকে বন্দি করা হয়। ইতোমধ্যে ওসমানকে হত্যার গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রতিশোধ নেওয়ার শপথ নেন। সেই শপথ ‘বাইত-ই-রিজওয়ান’ নামে বিখ্যাত। বিপদ বুঝে কুরাইশ সম্প্রদায়ের লোকেরা বার্তা পাঠান ওসমান (রা.) বেঁচে আছেন এবং নিরাপদে রয়েছেন। কুরাইশদের পক্ষ থেকে একই সঙ্গে অনুরোধ করা হয় এ বছর ফিরে যাওয়ার। হজরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর সঙ্গীদের বার্তা পাঠিয়ে বলা হয়- তারা যেন পরের বছর আবার আসেন খানা-ই-কাবা জিয়ারত ও ওমরাহ করতে। সে সময় মক্কা তিন দিনের জন্য খালি করে দেওয়া হবে বলেও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। যাতে কোনোরকম সংঘাতের সম্ভাবনা না থাকে। এ প্রস্তাবগুলো লিখিতভাবে দেওয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল আরও কিছু শর্ত। এটি হুদাইবিয়া চুক্তি হিসেবে পরিচিত। চুক্তির বেশকিছু শর্ত মুসলমানদের বিরুদ্ধে হলেও কোরআনে এ চুক্তিকে ফাতেহ-ই-মুবিন বা স্পষ্ট বিজয় বলে অভিহিত করা হয়েছে। হুদাইবিয়া চুক্তির পর এক বছর হতে না হতেই এমন কিছু ঘটনা ঘটে যার ফলে কুরাইশরা এ চুক্তি ভঙ্গের ঘোষণা দেয়।

৮ হিজরির ১০ রমজান হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে মক্কার উদ্দেশে রওনা হন। মদিনা থেকে যাওয়ার সময় তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭ হাজার। সফর চলাকালীন অন্য উপজাতির লোকজনও এ দলে যোগ দেন। এভাবে তাদের সংখ্যা ১০ হাজারে পৌঁছায়। মক্কা প্রবেশের ১০ মাইল আগে তাঁরা এক জায়গায় থামেন। মক্কার কুরাইশ সম্প্রদায় বিশাল জনতার আগমনের খবরে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। কুরাইশদের প্রধান নেতা আবু সুফিয়ান হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে যান এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার সিদ্ধান্তের কথা জানান। ইতোমধ্যে চতুর্দিক থেকে মুসলমানরা মক্কায় প্রবেশ করেন এবং কুরাইশরা আত্মসমর্পণ করেন। সেদিন ছিল ২০ রমজান। রসুল (সা.) মক্কাবাসীকে সম্বোধন করে বলেন, ‘তোমরা সবাই মুক্ত। আজ তোমাদের কেউ প্রশ্ন করবে না। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি পরম দয়ালু।’ ‘দ্য ক্যামব্রিজ হিস্ট্রি অব ইসলাম’ অনুযায়ী মক্কা বিজয়ের ফলে আরবরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করেন। মক্কা বিজয়ের পর মুসলমানরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েন। তাদের অনেকেই ছিলেন একাধারে সৈনিক ও ওলামা। তারা ইরান, ইরাক, সিরিয়া ও আফ্রিকায় ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটান। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর মদিনার রাজধানীর মর্যাদা বজায় থাকে, তবে হজের কারণে মক্কা ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক ও শিক্ষা কেন্দ্রের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে রয়ে যায়। ইসলামিক বিশ্বের কেন্দ্র মদিনা থেকে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল উমাইয়া রাজতন্ত্রের আমলে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মক্কা ও মদিনার কেন্দ্রীয় মর্যাদা বজায় ছিল। আধ্যাত্মিক তৃষ্ণা মেটাতে বহুদূর থেকে মানুষ সেখানে আসতেন। মক্কার কেন্দ্রীয় ও আধ্যাত্মিক মর্যাদা আজও অক্ষুণ্ন। প্রত্যেক মুসলমান খানা-এ-কাবার দিকে মুখ করে নামাজ পড়েন।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আমেনা খাতুন হাফেজিয়া কোরআন রিসার্চ অ্যান্ড ক্যাডেট ইনস্টিটিউট কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর