মঙ্গলবার, ২ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

শিক্ষককুলের গৌরব আমজাদের মহাপ্রয়াণ

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

শিক্ষককুলের গৌরব আমজাদের মহাপ্রয়াণ

ব্যথাতুর মন নিয়ে কোনো কিছুই করা যায় না। ক্ষতবিক্ষত বিধ্বস্ত দেহে অবসাদ চেপে বসে। অবসাদগ্রস্ত দেহ নিয়ে কাজ করা যায় না, হাত চলে না, মস্তিষ্ক সাহায্য করে না। এ যাত্রায় আমার তেমনই হয়েছে। মাত্র এক সপ্তাহ আগে ’৭৫-এর প্রতিরোধ যোদ্ধা বঙ্গবন্ধু হত্যার অন্যতম প্রতিরোধকারী দুর্গাপুরের আবদুল হক আমাদের মায়া কাটিয়ে চলে গেছে। আবদুল হক শুধু ’৭৫-এর প্রতিরোধ যোদ্ধাই ছিল না, ’৭১-এরও একজন উল্লেখযোগ্য স্বাধীনতা যোদ্ধা ছিল। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার আগে আবদুল হক নামে এই দুনিয়ায় কেউ আছে আমি জানতাম না। ’৭৫-এর প্রতিরোধ যুদ্ধ খুব একটা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বড় কঠিন সময় পার করেছি। প্রথম সীমান্তে গিয়েছিলাম ২৩ আগস্ট। মুক্তিযুদ্ধের সময়ই ঝগড়ারচর, কামারেরচর, ডোবারচর চিনতাম। বঙ্গপিতার হত্যার দিন ১৫ আগস্ট সারা দিন চোখের পানি রাখতে পারিনি। সকালে ছিলাম গজনবী রোডের মুসলিম সাংবাদিকতার পথিকৃৎ মোহাম্মদ মোদাব্বেরের বাড়ি। মুক্তিযুদ্ধের আগে তাকেও চিনতাম না। একজন মানুষের এত বিপুল পরিচিতি থাকে এবং সবার কাছে এত আদরণীয় হয়, সেটা মোহাম্মদ মোদাব্বেরকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী কার সঙ্গে তার পরিচয় ছিল না। মনে হতো সবাই যেন তার চিরচেনা। ড. নীলিমা ইব্রাহীম, সুফিয়া খালা, কবি শামসুর রাহমান কেউ ছিলেন না যে তাকে সম্মান করতেন না। এমনকি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক দেখে অনেক সময় অভিভূত হতাম। সেই মোহাম্মদ মোদাব্বেরের বাড়িতে ছিলাম সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দুপুরের নামাজের আগ পর্যন্ত। এরপর আশ্রয় নিয়েছিলাম খিলজি রোডে সিলিমপুরের সবুর দারোগার বাড়ি। ভদ্রলোক মুসলিম লীগ করতেন। তার বাড়িতে যেতে দ্বিধা ছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা আরিফ আহমেদ দুলালের চাপাচাপিতে সবুর দারোগার খিলজি রোডের বাড়িতে গিয়েছিলাম। মানুষ মানুষের জন্য এতটা করতে পারে তাদের বাড়িতে না গেলে বুঝতে পারতাম না। দুলাল সাদাসিধা মানুষ। আমার থেকে সাত-আট বছরের ছোট। মুসলিম লীগের লোক বলে যখন যেতে চাচ্ছিলাম না তখন দুলাল বলছিল সবুর দারোগার ছেলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধা, তার মেয়ের জামাই একজন মুক্তিযোদ্ধা এখানে দুদিক থেকে রক্ষাকবচ। ছেলের সঙ্গে বেইমানি করলেও কোনো বাবা তার মেয়ের জামাইয়ের সঙ্গে বেইমানি করবে না। আরিফ আহমেদ দুলালের কথাই ঠিক। বেইমানি তো দূরের কথা তিনি যে চরম ভক্তি, বিশ্বাস ও আস্থার পরিচয় দিয়েছিলেন তা খুব বেশি পাওয়া যায় না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কথা শুনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে শেরেবাংলা নগর রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছিলাম। একজন জয়েন সেক্রেটারি আবুল মনসুর আহমেদ অথবা আবুল মনসুর আমাকে গণভবনের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে আটকে ছিলেন। তার প্রশ্ন, কোথায় যাচ্ছেন?

-রক্ষীবাহিনী ক্যাম্পে।

-আপনি জানেন না?

-জানি বলেই তো যাচ্ছি।

-না, ওদিকে যেতে পারবেন না। কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। জেনেশুনে খোঁজখবর করে তারপর যান। এমনি আপনাকে যেতে দেব না।

এই আবুল মনসুর কেন সামনে এসেছিলেন তখন কেন ওখানে ছিলেন জানি না। সেখান থেকে ২৭ নম্বর সড়ক হয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে গিয়েছিলাম। তার এক বা দুই বাড়ি পশ্চিমে এক ভদ্রলোক মনসুর সাহেবের মতোই পথ আগলে ছিলেন। গাড়ি থেকে এক হেঁচকা টানে তার ঘরে নিয়ে বসিয়ে ছিলেন। এক গ্লাস পানি পান করে কিছুটা সম্বিত ফিরে পেয়েছিলাম। আমি বোধহয় জীবনে কোনো দিন চেতনায় অমন অচেতন হইনি। গাছ থেকে পড়ে জ্ঞান হারিয়েছি, গুলি লেগে জ্ঞান হারিয়েছি. গাড়ি এক্সিডেন্ট করে কিছু সময়ের জন্য জ্ঞানহারা হয়েছি। কিন্তু সজ্ঞানে অমন অজ্ঞান জীবনে কখনো হইনি। সেখান থেকে মোদাব্বের দাদুর বাড়ি এসেছিলাম। তারপর খিলজি রোড। সারা দিন দানাপানি জোটেনি। খাবার ছিল না তা নয়। ধনবান মানুষ সবুর খান সেই তখনই শত কোটির মালিক। খাবার অভাবে নয়, খাওয়ার পরিবেশ ছিল না। পানি আর পানি চোখের সব বোঁটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। মনে হয় সব ফুটো হয়ে গিয়েছিল। যেদিকে তাকাচ্ছিলাম চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল আর বহতা নদীর মতো পানি ঝরছিল। সন্ধ্যায় টেলিভিশনে অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হলে খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভার শপথ প্রচার হচ্ছিল।

সব পুরনো মন্ত্রী। সব বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য, একজনও বাইরের কেউ ছিলেন না। আমি হয়তো দুই-চার লোকমা ভাত মুখে দিয়েছিলাম। খাবার সঙ্গে মাংস ছিল। হঠাৎই মনে হচ্ছিল আমি যেন বঙ্গবন্ধুর মাংস চিবুচ্ছি। চোখ থেকে দরদর করে ভাতের থালায় পানি পড়ছিল। শুনেছি চোখের পানি থালায় পড়লে দুঃখ বাড়ে। আমার দুঃখ যে কত বেড়েছে আজ ৫০ বছরেও মোচন হওয়ার নাম নেই। সেই যে মাংস ছেড়েছিলাম ৩০ বছর কখনো কোনো মাংস মুখে দেইনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন হাসিনা দু-একবার মাংসের আলু বা অন্যান্য সবজি তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আমার স্ত্রী সেখানে বাদ সেধেছে, ‘হায় হায় আপা আপনি কী করেন? ও তো বুঝে ফেলবে এসব মাংসের আলু।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন হাসিনা আমার খাওয়া-দাওয়ায় অনেকটা মায়ের মতোই যত্ন নিয়েছেন। এখনো কথাবার্তা হলে খাবার কথা আগে জিজ্ঞেস করেন। এটা তাঁর এক অসাধারণ গুণ। বছর ১৫ আগে আজমিরের এক মোয়াল্লেম ৮০-৯০ বছর বয়স হবে যিনি আমার দু’হাত চেপে ধরে বলেছিলেন, ‘বাবা, শুনলাম আপনি আপনার নেতা বঙ্গবন্ধুর হত্যার কারণে মাংস মুখে দেন না। আল্লাহ মানুষের জন্য কত জিনিস হারাম করেছেন। সেগুলোও কখনো সখনো মানুষজন খায়। আর আল্লাহর নামে জবেহ করা মাংস আপনি মুখে দেন না? যা হোক কোরবানির মাংস একবার দুবার খাবেন।’ সে থেকে সত্যিই এক-দুবার কোরবানির মাংস খাই।

যা বলেছিলাম, ১৫ আগস্টের পর প্রায় সাত দিন ঢাকায় ছিলাম। জিগাতলায় মোহনদের বাড়ি, ধানমন্ডির কে জেড ইসলাম খোকনের বাড়ি, সর্বশেষ এলি খালা এবং আর এ গনির বাড়ি। সেখান থেকে সীমান্তের পথ ধরেছিলাম। গাড়ির চালক ছিলেন মোহাম্মদ মোদাব্বের দাদুর তিন নম্বর ছেলে ইকবাল মামা। জামালপুর ব্রহ্মপুত্রের ফেরি অপরপাড়ে দেখে দেরি করতে ইচ্ছে করেনি। তাই এক নৌকায় উঠেছিলাম ব্রহ্মপুত্র পার হতে। নৌকায় উঠে মনে হলো কিছু পথ উজিয়ে গেলে কেমন হয়। সারা রাত নৌকা উজানে বেয়ে যেখানে নেমেছিলাম সেটা ছিল কামারের চর। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে ডোবারচর, ঝগড়ারচর বকশীগঞ্জ হয়ে তন্তর সীমান্তে পৌঁছেছিলাম। সে সময় আমার হাত-পা অচল হয়ে পড়ে। এরপর মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে তুরা। সেখান থেকে আসামের রাজধানী গোহাটি। গোহাটি থেকে মেঘালয়ের রাজধানী শিলং। সেখান থেকে আবার গোহাটি। তারপর ইল্লি দিল্লি কত জায়গায় ঘুরেছি তার শেষ নেই। এর মধ্যেই নদীপথে একবার দেশের অভ্যন্তরে ঢুকেছিলাম। সারিয়াকান্দি, চন্দনবাইসা নানা জায়গায় ঘুরে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের ভাটিতে নিশ্চিন্তপুর চরে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে এক সামনা-সামনি যুদ্ধ হয়। সেখানে বগুড়া যুবলীগের সভাপতি খালেকুজ্জামান খসরু শহীদ হয়। তারপর প্রায় এক মাস কাজীপুর, শাহজাদপুর, ভূঞাপুর, গোপালপুর, কালিহাতী, বাসাইল, সখীপুর, কালিয়াকৈর, ভালুকা, ত্রিশাল, ফুলবাড়ী হয়ে হালুয়াঘাটের গোবরাকুড়ায় যাই। যে সন্ধ্যায় গোবরাকুড়ায় পৌঁছেছিলাম সেখানে ২ কেজি চাল ৪০ জনে ভাগ করে খেয়েছিলাম। সবাই এক মুঠো-দেড় মুঠো ভাত পেয়েছিল। কেন যেন সেই এক-দেড় মুঠো ভাত থেকে একটু একটু করে ভাত আমার পাতে তুলে দেওয়ায় একজন মানুষের যেটুকু খাবার দরকার তার চাইতে অনেক বেশি আমার থালায় জমা হয়েছিল। আমি আর সে ভাত মুখে তুলতে পারিনি। সহকর্মীদের কাণ্ড দেখে শুধু চোখের পানি ঝরছিল। এই সময় একদিন দুর্গাপুরের আবদুল হক এসে হাজির। সে এক দুর্দান্ত মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের সময় অমন অনেক কর্মঠ মানুষ দেখেছি। কিন্তু তারপর আর কাউকে অমন সবদিকে দৃষ্টিসম্পন্ন লোক দেখিনি। ওই সময় সারা দিনে একবেলা খেতাম, কখনো দেড়-দুদিনে এক বেলা। আবদুল হককে না পেলে হয়তো দুদিনেও একবেলা জুটত না। শেখ পরিবারের মারুফ এর সাক্ষী। কোনো দিন ক্ষুধায় অমন কষ্ট করেনি। সেই শেখ মারুফ যখন সারা দিন খেতে পারত না, ছটফট করত। অনেক দিন পাশে বসে খেয়েছে। বাজিলা মাছ, মলা মাছ দিয়ে আধপেটা খেয়েছে। আমি হয়তো দু’মুঠো ভাত ওর পাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। শুনেছি, মারুফ খুবই অসুস্থ। এখন কেমন আছে জানি না। কয়েক মাস খোঁজখবর নেই। বলছিলাম আবদুল হকের কথা। সীমান্ত এলাকায় আবদুল হকের ছিল সব চেনাজানা। কত জায়গা থেকে বলে কয়ে চাল-ডাল এনেছে। অনেক সময় ধানখেত থেকে ধান কেটে এনেছে। মাড়াবার সময় হয়নি। কাঁচা ধানে চাল হয় না। তাও আমরা কাঁচা ধানের চাল বানাবার চেষ্টা করেছি। সেগুলো ভাত হয়নি, জাও হয়েছে। কিন্তু তবু জীবন চলেছে। সেই আবদুল হকের ১০-১২ বছর আগে গলায় ক্যান্সার হয়েছিল। যেখানে যেখানে পেরেছি চিকিৎসা করাবার চেষ্টা করেছি। ওরকম মারাত্মক অসুখ নিয়ে এতদিন চলবে এতদিন বেঁচে থাকবে ঘুণাক্ষরেও আশা করিনি। যাহোক চলে গেছে ভালোই হয়েছে। অসহায়ের মতো বিছানায় পড়ে থাকার চেয়ে চলে যাওয়া অনেক ভালো।

এবার আসি শিক্ষককুলের গর্ব মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর চিকিৎসা বিভাগের অন্যতম স্তম্ভ আমজাদ বিএসসি সম্পর্কে। আমজাদের সঙ্গে কবে কোথায় কীভাবে পরিচয় আমার মনে নেই। আমজাদের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবন। আগে পাহাড়ের মানুষ লেখাপড়া করতে জিয়ারত স্যারের জামুর্কী স্কুল এবং কাউলজানি স্কুলে আসত। সখীপুর থেকে টাঙ্গাইল আসতে এক-দেড় দিন লেগে যেত। পাহাড়িয়া মাটির কাদা ধুতেই ঘণ্টা পেরিয়ে যেত। এখন তো কারও পায়ে কাদা লাগাতে হয় না। সখীপুর পাহাড়ে কী চমৎকার চমৎকার কার। আমাদের বাড়িতে সেই ’৬৫ সাল থেকে গাড়ি এসেছে। আমাদের ৫-৬টি গাড়ির যে দাম সখীপুরের অনেক ধনবানের এক গাড়ির দাম তার চেয়ে অনেক বেশি। সখীপুরে ৩০০-৪০০ টাকায় যেখানে এক পাকি জায়গা পাওয়া যেত সেই জায়গার দাম এখন ১৫-২০ কোটি। কিন্তু আমার আমজাদ মুক্তিযুদ্ধের সময় যা ছিল, তার আগে যা ছিল, মৃত্যু পর্যন্ত তাই ছিল। আগেও যেমন ওদের সংসার মোটামুটি ভালো চলত এখনো তাই চলে। আমজাদ সখীপুর পাইলট স্কুলের হেডমাস্টার এবং যখন স্কুল অ্যান্ড কলেজ হয়েছে খুব সম্ভবত তার প্রিন্সিপালও ছিল। শনিবার আমজাদের জানাজায় যখন গিয়েছিলাম বহুদিন পর পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক খলিলের অফিসে বসেছিলাম। ’৯০-এ আমি যখন দেশে ফিরি খলিল, রফিক, শামীম, সানোয়ার, আশিক ওরা সবাই ছোট ছোট। বড় নিবেদিত ছিল। খলিলকে কোনো কথা জিজ্ঞেস করলে বলত আমি হুদাই লীগ। আমার এখনো সে সময়ের কথা বুকের ভিতর আলোড়ন তোলে। আমি বাড়ি পালানো এক বাউন্ডুলে। ১০-১২ বছর থেকেই বাড়ি পালাতাম। সে কারণে পাহাড়ের অনেক জায়গাই ছিল আমার পরিচিত। গ্রামের বাড়ির পুবদিকে মরিচা, বাঘেরবাড়ী, ছোটচওনা, বড়চওনা, কচুয়া, কালিয়াপাড়া, জোড়দিঘি, সাগরদিঘি, কাজলা কামালপুর, ধলাপাড়া, দেওপাড়া এসবই ছিল আমার চিরচেনা। পাহাড়কাছরার বহেরাতৈল, নাকশালা, খোলাঘাটা, বেড়বাড়ি এসবও চিনতাম জানতাম। কিন্তু সখীপুর চিনতাম না, সখীপুর নামে কোনো জায়গা আছে তাও আমার জানা ছিল না। ’৭০-এর জাতীয় নির্বাচনের পর ডিসেম্বরের একেবারে শেষদিকে বিজয়ী নেতাদের নিয়ে সখীপুর পাইলট স্কুলে এক সভা হয়েছিল। সেখানে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী এমপি, শামসুদ্দিন আহমেদ বালু মোক্তার এমপি, হুমায়ুন খালিদ এমএনএ, খুব সম্ভবত ফজলুর রহমান খান ফারুক, তোফাজ্জল হোসেন মুকুল, হাতেম আলী তালুকদারসহ অন্যান্য এমপি এমএনএ-রাও গিয়েছিলেন।

সেখানে আমি চিৎকার-ফাৎকার করে বক্তৃতা করেছিলাম। এরপর আলী আজগর সাহেবের বাড়িতে খেয়েছিলাম। তখন পাহাড়ের মানুষের আন্তরিকতা ভালোবাসা ছিল উল্লেখ করার মতো। এরপর ২-১ বার গেছি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় মে মাসের ৪-৫ তারিখ প্রথম সখীপুর গিয়েছিলাম। নুরে আজম, হানিফ, গুরখা, আবদুল হালিমসহ আরও কয়েকজন আমার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। সেখানে প্রধানতম ব্যক্তি ছিল হামিদুল হক বীরপ্রতীক ও শওকত মোমেন শাজাহান। শাজাহান ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। লতিফ ভাইয়ের ভক্ত ও শিষ্য। দোষ-ত্রুটি যাই থাকুক মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা অসাধারণ। মনপ্রাণ দেহ কাজ করছিল না। ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছিল। আমজাদের কফিন নিয়ে অনেক নেতা বক্তৃতা করছিল। বৃষ্টির মধ্যে অনেক মানুষ দাঁড়িয়েছিল। বেলা ১১টার দিকে আমজাদকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। বর্তমানের অনেক রাষ্ট্রীয় কাজকর্মই আমার সঙ্গে মেলে না। একজন মুসলমান হিসেবে আমি শরিয়তের বাইরে এক পা যেতে চাই না। এর আগে খুব সম্ভবত সখীপুরে একজন মহিলা ইউএনও ছিলেন। তিনি রাষ্ট্রীয় সালামিতে অংশ নিয়েছিলেন। আমি বারণ করেছিলাম। পুরুষের জানাজায় মহিলার শরিক হওয়ার রেওয়াজ নেই। কি-ন্তু যেহেতু তিনি এখন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা তার পাওয়ার বেশি। তিনি শরিয়ত মানেননি, ধর্মের বিধান মানেননি। এবার এসিল্যান্ড হিসেবে এক ভদ্রলোক সালামিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মনে হলো তার সালামি সম্পর্কে জ্ঞান নেই। আর যে সাব-ইন্সপেক্টর সালাম পরিচালনা করেছেন তারও প্রশিক্ষণ নেই। আর শেষ বিদায়ে সালামি দলের পাক পবিত্র হওয়া দরকার। মনে হয় তার কোনো বালাই নেই। যাক, এসব কথা। মুক্তিযুদ্ধে আমজাদের অবদান অবিস্মরণীয়। আমজাদ, শাহজাদা, ডা. শিশির রঞ্জন, মোহাম্মদ আলীর বাবা নিজাম ডাক্তার তারা ওভাবে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ গড়ে তুলতে না পারলে ৪০০-৫০০ মুক্তিযোদ্ধা এবং ৫-৭ হাজার সাধারণ মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যেত। আমজাদ শুধু মুক্তিযুদ্ধেই নয়, মুক্তিযুদ্ধের পরও বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়া পর্যন্ত আমার সঙ্গে ছায়ার মতো থেকেছে, কাজ করেছে। অনেকের অনেক সময় বিশ্বাসের চিড় ধরেছে, স্বার্থের টানে এদিক-ওদিক গড়াগড়ি করেছে। কিন্তু আমজাদ বিএসসি কখনো একচুল এদিক-ওদিক হয়নি। মৃত্যুর কী অমোঘ মিল শওকত মোমেন শাজাহান ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর ১৯ জানুয়ারি হঠাৎই রাত ১১টার দিকে ফোন করেছিল, ‘স্যার, আপনাদের সঙ্গে কত সময় কত বেয়াদবি করেছি, সমালোচনা করেছি। কিন্তু লতিফ ভাইয়ের কাছে গেলে আপনার কাছে গেলে সন্তানের মতো যত্ন পেয়েছি, ভালোবাসা পেয়েছি। আর বাসাইল অফিসে অলিদ আমাকে চেয়ার নিয়ে মারতে এসেছিল। ছোট্ট একটা চেংরা ছেলে অন্য দল থেকে এসে আমাকে মারতে আসে এই অপমান সহ্য করা যায়? মনে হয় এ অপমান সহ্য করে আর বাঁচব না। স্যার, মাফ করে দিয়েন।’ এটাই যে শাজাহানের শেষ কথা হবে আমি কল্পনাও করতে পারিনি। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে প্রথম যে সংবাদ পেয়েছিলাম সেটা ছিল শওকত মোমেন শাজাহান ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছে। আমজাদ বিএসসির ঘটনাটা তারও চেয়ে আকর্ষিক। ২৮ জুন শুক্রবার দুপুরের খাবার খেয়ে কেবলই ঘরে ঢুকেছি, মোবাইল বেজে উঠে। দেখি আমজাদ বিএসসি। ফোন ধরতেই বলল, ‘স্যার, আমি হাসপাতালে। বুকে ব্যথা হচ্ছিল তাই ইনজেকশন দিয়ে শুইয়ে রেখেছে।’ এমনভাবে বলছিল মনে হচ্ছিল যেন সখীপুরে। আমি তখনই যাওয়ার কথা চিন্তা করছিলাম। পরে বুঝলাম ঢাকাতে। চিন্তা করে রেখেছিলাম পরদিন শনিবার ঢাকায় গিয়ে ওকে দেখব। একটু পরে অধ্যাপক শামীমের ফোন, ‘স্যার, আমজাদ বিএসসি হাসপাতালে।’ বলেছিলাম, হ্যাঁ, আমজাদ ফোন করেছিল। ভেবেছিলাম সামান্য কিছু হয়েছে। কিন্তু না, সন্ধ্যার পর আবার শামীমের ফোন, ‘আমজাদ বিএসসি নেই।’ ভাবছিলাম এ যেন বলে-কয়ে আমজাদ চলে গেল। এরকম আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল বন্ধু কবি সায্যাদ কাদিরকে নিয়ে। কবি সায্যাদ কাদির বাবরও হৃদরোগ ইনস্টিটিউট থেকে ফোন করেছিল, ‘বন্ধু আমি হাসপাতালে ভর্তি। তুমি দেখো।’ সঙ্গে সঙ্গে তুহিনকে পাঠিয়ে ছিলাম। আবার ফোন, ‘আমাকে কেবিনে নেওয়ার ব্যবস্থা করো।’ তাও হয়েছিল। তুহিন ওকে খাবার খাইয়ে বাড়ি ফিরেছিল।

আমি ঢাকার পথে রওনা হয়েছিলাম। খবর পেলাম একসঙ্গে বড় হওয়া ছেলেবেলার বন্ধু সায্যাদ কাদির বাবর আর নেই। শিক্ষককুলের গৌরব আমজাদও তেমনি আমাদের সবার মায়া কাটিয়ে জ¦ালা-যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি দিয়ে এপার থেকে ওপার চলে গেল। আর কোনো দিন ফিরবে না। আমজাদের জানাজায় দাঁড়িয়ে বারবার মনে হচ্ছিল আমি তো কতজনের জানাজায় শরিক হলাম, আমার জানাজায় কে বা কারা শরিক হবে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি, হে পরম দয়ালু আল্লাহ, আপনি আমজাদকে তার সব ভুলত্রুটি ক্ষমা করে বেহেশতবাসী করুন। তার পরিবার-পরিজনকে আপনার পবিত্র আরশের ছায়াতলে রাখুন। আমিন।

♦ লেখক : রাজনীতিক

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর