মঙ্গলবার, ২ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

ঘুরে দাঁড়াচ্ছে অর্থনীতি

অপরাজিতা হক

ঘুরে দাঁড়াচ্ছে অর্থনীতি

১৯৭২ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত রিজার্ভশূন্য অবস্থায় ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট দিয়ে শুরু করে বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর ৩৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৮৪ ডলার। বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বাংলাদেশ ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৯.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল। ১৯৭৫ সালে জাতির জনককে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর বাংলাদেশের অর্থনীতির যে নিম্নগামী ধারা তৈরি হয়েছিল তার থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যার হাতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমাদের প্রবৃদ্ধি ৭.৮৮ শতাংশে দাঁড়ায়। করোনাকালে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির চক্রে পড়ে গেলেও বাংলাদেশ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩.৪৫ শতাংশ ধনাত্মক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। করোনা-পরবর্তী ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের অস্থির অর্থনীতির বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ম্যাক্রো-ইকোনমিক স্ট্যাবিলিটির লক্ষ্যে ২০২৪-২৫ সালের জন্য একটি আন্তরিক, বাস্তবসম্মত ও ভারসাম্যমূলক বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিয়ে যারা অহেতুক সমালোচনা করেন, তাদের কিছু তথ্য স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে বিএনপির দেওয়া সর্বশেষ বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৬৯ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। আর বিশেষ গবেষণা সংস্থার ঘরে তৈরি ২০০৭-০৮ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল সাকল্যে ৯৯ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা। সেখান থেকে অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটিয়ে আমাদের ২০২৪-২৫ সালের বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও এ সময়টায় বিপ্লব ঘটে গেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেটের প্রায় ৯৪ শতাংশ অর্থাৎ ৭ লাখ ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকার সংশোধিত বাজেট বাস্তবায়িত হয়েছে।

রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ২০০৬-০৭ অর্থবছরে বিএনপির শাসনামলের শেষ বছর রাজস্ব আদায় হয়েছিল মাত্র ৪৯ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে ব্যবসায়ীদের ধরে বেঁধে এনে রাজস্ব আদায় করা হয়েছে ৬০ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা। আর ২০২৩-২৪ সালের সম্পূরক বাজেটে রাজস্বের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড খানিকটা পিছিয়ে থাকলেও দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের ‘ক্যাশলেস ইকোনমি’ গড়ার প্রত্যয়। দেশে এখন ২২ কোটি ‘মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট’ রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ডিজিটাল লেনদেন ১৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। রিটেইল পেমেন্টের ক্ষেত্রেও মোবাইল মাধ্যম ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ডিজিটাল ট্রানজেকশনের বেলায় ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট ছাড় দেওয়া হলে এক্ষেত্রে ব্যাপক সাড়া পড়বে এবং ভ্যাট আদায়ও বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এখন উচিত হবে ‘স্মার্ট ইকোনমি’র অগ্রগতির সঙ্গে সমন্বয় করে ‘ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস’-এর মতো অবসলিউট প্রযুক্তি থেকে সরে এসে ‘ইন্টিগ্রেটেড ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম’ চালু করা, যা একই সঙ্গে সব ধরনের কার্ড ও মোবাইল পেমেন্ট গ্রহণে সক্ষম হবে এবং রাজস্ব বোর্ডের প্রাপ্য তাৎক্ষণিকভাবে তাদের অ্যাকাউন্টে জমা হবে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে শুধু খুচরা পর্যায়ের ভ্যাট আদায় নয়- এর ফলে ক্রেতা-বিক্রেতা ও পণ্যের যে ‘ডিজিটাল ফুট প্রিন্ট’ তৈরি হবে তার ‘বিগ ডেটা অ্যানালাইসিস’ করে উৎপাদন ও পাইকারি পর্যায়ের মূল্য সংযোজন করসহ আমদানি শুল্কের আদায়ও নিশ্চিত করা যাবে। এ উপাত্ত করপোরেট ট্যাক্স ও ব্যক্তি পর্যায়ের আয়কর নির্ধারণের ক্ষেত্রেও নিয়ামক ভূমিকা রাখবে। ‘ট্যাক্স নেট’ প্রসারের ক্ষেত্রে এটাই হতে পারে সবচেয়ে উপযোগী পদক্ষেপ।

বেচাকেনা ছাড়াও আমাদের বহু সেবা খাত রয়েছে যা বাধ্যতামূলকভাবে ‘ডিজিটাইজ’ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে শুধু ক্যাবল টিভি ডিস্ট্রিবিউশন খাতে ৪ কোটি গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় হতে পারে বছরে ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকার মূল্য সংযোজন কর। ভূমিসংক্রান্ত বহু তথ্য সরবরাহে সরকার ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করেছে। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ১৯৯৬-২০০১ শাসনামলে গৃহীত পাইলট প্রকল্পের আলোকে ভোটার ডেটাবেজ এবং ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমের সঙ্গে ‘ইন্টিগ্রেট’ করে প্রতিটি জমির মালিককে সমন্বিত ‘সার্টিফিকেট অব ল্যান্ড ওনারাশপ’ প্রণয়ন করা হলে ভূমি বিরোধ ও সে সংক্রান্ত মামলাজট শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। ‘ই-জুডিশিয়ারি’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগও আমাদের দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করতে হবে। একদল চিহ্নিত বিশেষজ্ঞের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে লাগাতার গুজব ও ভীতি ছড়ানো হচ্ছে। এক্ষেত্রেও কিছু তথ্য জেনে নেওয়া প্রয়োজন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে তখন দেশের রিজার্ভ ছিল মাত্র ৫.৫৭ বিলিয়ন ডলার। সরকারের যুগান্তকারী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে মাত্র ১০ বছরে দেশের প্রবৃদ্ধি ৭.৮৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যায় এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২১ সালে কভিড মহামারির কারণে আমদানি স্থবির হয়ে যাওয়ায় এবং অনেক অভিবাসী তাদের সঞ্চয় নিয়ে দেশে ফিরে আসায় সর্বমোট রিজার্ভ ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৪৮.০৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে।

তবে মহামারি থেকে কাটিয়ে ওঠে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতেই ‘পেন্ট আপ ডিমান্ড’ মোকাবিলায় রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি হতে থাকে। অনেক প্রবাসী একেবারে দেশে চলে আসায় রেমিট্যান্স প্রবাহেও ধীরগতি তৈরি হয়। সর্বোপরি ‘সাপ্লাই চেইন’ বিভ্রাট এবং ইউক্রেন যুদ্ধ ও স্যাংশনের কারণে কেবল জ্বালানি আমদানিতেই বাংলাদেশকে গত তিন বছরে অতিরিক্ত ১৩.৯ বিলিয়ন ডলার বাড়তি গুনতে হয়েছে। তবে শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অবিচল আস্থা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সময়োপযোগী পদক্ষেপের ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ২৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা প্রায় ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে সক্ষম। রপ্তানি বাণিজ্যে ২ শতাংশ এবং রেমিট্যান্স প্রবাহে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ফলে আমাদের ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’ও এখন ধনাত্মক ধারায় ফিরেছে। গত অর্থবছরের ৩.৩ বিলিয়ন ডলার ঘাটতির পরিবর্তে এ বছর উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ৫.৮ বিলিয়ন ডলার। আইএফসির মতে, অবকাঠামো খাতে যে বিনিয়োগ সরকার করেছে তা আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশকে ‘ইনভেস্টমেন্ট হাব’-এ পরিণত করবে। তবে ব্যাংকিং সেক্টর রিফর্ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সসহ সার্বিক সুশাসন এখন সময়ের দাবি, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ অবশ্যই পরবর্তী ধাপে উত্তীর্ণ হবে।

♦ লেখক : সংসদ সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

 

সর্বশেষ খবর