মঙ্গলবার, ২ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

দীনি শিক্ষা প্রত্যেক নারী-পুরুষের ওপর ফরজ

মুফতি রুহুল আমিন কাসেমী

দীনি শিক্ষা প্রত্যেক নারী-পুরুষের ওপর ফরজ

ইসলাম শব্দের অর্থ আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ। তাই প্রত্যেক মুসলিমকে সে কার আনুগত্য করবে, কীভাবে আনুগত্য করবে এবং কী কী কাজ থেকে বিরত থাকবে, তা জানার জন্য ইলম বা জ্ঞানের প্রয়োজন, এজন্যই আল্লাহ রব্বুল আলামিন নবুয়াতের সূচনাতেই সর্বপ্রথম যে আয়াতগুলো হেরা গুহায় নাজিল করেন তাতে এর গুরুত্ব প্রকাশ পায়। ওই আয়াতগুলোর অর্থ নিম্নরূপ, ‘পাঠ করুন, আপনার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করুন, আর আপনার প্রতিপালক মহিমান্বিত। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানত না।’ (সুরা আলাক, আয়াত ১-৫)। এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে তিনটি ক. মহান স্রষ্টার সর্বপ্রথম নির্দেশ হচ্ছে পড়। খ. জমাট রক্তের মতো সাধারণ ও তুচ্ছ বস্তু থেকে মহিমান্বিত প্রতিপালকের সান্নিধ্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য জ্ঞানসাধনাকেই একমাত্র সেতুবন্ধ বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে। গ. কলমের সাহায্যে তিনি মানবজাতিকে জ্ঞান দান করেছেন। এই প্রথম প্রত্যাদেশ থেকেই ইলমের ফজিলত সুস্পষ্ট। অন্যত্র আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন- বলুন যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান? (সুরা জুমার, আয়াত-৯)। অন্য আয়াতে উল্লেখ রয়েছে, তোমাদের মধ্যে যারা ইমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদায় উন্নত করবেন। (সুরা মুজাদালা, আয়াত ১১)।

আল্লাহতায়ালা অন্যত্র ইরশাদ করেন : তিনি যাকে ইচ্ছা হেকমত দান করেন এবং যাকে হিকমত দান করা হয় তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়। (সুরা বাকারা, আয়াত-২৬৯)। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কিতাব ও হিকমত দানের মাধ্যমে তাঁকে যে মহান মর্যাদা দান করা হয়েছিল, সে প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন : আল্লাহতায়ালা আপনার প্রতি কিতাব ও হিকমত অবতীর্ণ করেছেন এবং আপনি যা জানতেন না তা আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন। (সুরা নিসা, আয়াত ১১৩)। হাদিসে উল্লিখিত বিষয়টি এভাবে রয়েছে, আল্লাহ যার কল্যাণ কামনা করেন, তাকে দীনের ব্যুৎপত্তি দান করেন। বস্তুত আমি বণ্টনকারী এবং দাতা হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহতায়ালা। (বুখারি শরিফ)। মানবজাতির চরম উৎকর্ষ সাধনকারী ইসলাম। তাই প্রতিটি মুসলমানের জন্য জ্ঞান অর্জনকে ফরজ ঘোষণা করেছেন। প্রিয় নবী (সা.) ইরশাদ করেন : ইলম অন্বেষণ প্রতিটি মুসলমানের ওপর ফরজ। (ইবনে মাজা)। আল্লাহর প্রিয় পাত্র হতে হলে অবশ্যই ইলম অর্জন করে তার সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির ব্যাপারে পুরোপুরি জেনে, সে অনুযায়ী আমল করতে হবে। আর এ উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি জ্ঞান অন্বেষণে রত থাকে, আল্লাহর কাছে তার মর্যাদা যে কত বেশি, নিম্নবর্ণিত হাদিসটি তার প্রমাণ। হজরত আবু দারদা (রা.) বর্ণনা করেন, আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন : যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণের লক্ষ্যে পথ চলে, আল্লাহতায়ালা তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দেবেন। তালিবে ইলম বা জ্ঞানের শিক্ষার্থী এর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে ফেরেশতাগণ তাদের নূরের ডানা তাদের জন্য বিছিয়ে দেন। আর আলেমের জন্য আসমান-জমিনের সব কিছু ক্ষমা প্রার্থনা করে। এমনকি পানির মাছও। আবিদ ব্যক্তির তুলনায় আলেমের মর্যাদা ঠিক সে রকম, যেমনটি পূর্ণিমার চাঁদের মর্যাদা সমস্ত তারকার তুলনায়। আলেমগণ হচ্ছেন নবীগণের ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারী, আর নবীগণ কাউকে দিনার ও দিরহামের উত্তরাধিকারী করে যাননি, তারা উত্তরাধিকারী করেন ইলমের। যে ব্যক্তি তা অর্জন করল, সে প্রভূত কল্যাণ লাভ করল। (তিরমিজি, আবু দাউদ)। অন্য এক হাদিসে ইলম অর্জনকে সর্বোত্তম ইবাদত বলে অভিহিত করা হয়েছে। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলে পাক (সা.) ইরশাদ করেন : সর্বোত্তম আমল হচ্ছে আল্লাহর বিষয়ক ইলম। নিঃসন্দেহে ইলম তোমার উপকারে আসবে, চাই তার সঙ্গে অল্প আমল হোক বা অধিক আমল হোক। আর অজ্ঞতা তোমার কোনো উপকারে আসবে না, চাই তার সঙ্গে অল্প আমলেই থাক বা অধিক আমলই থাক। (জামি ছগির)

আল্লাহতায়ালার গুণবাচক নামসমূহের অন্যতম দুটি নাম হলো, ‘আলিম ও হাকিম’ অর্থাৎ তিনি সর্বজ্ঞ এবং প্রজ্ঞাবান, কোরআন শরিফের অসংখ্য স্থানে তার এই দুটি গুণবাচক নামের উল্লেখ রয়েছে। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ইলম বা জ্ঞানের প্রকৃত উৎস হচ্ছেন আল্লাহ রব্বুল আলামিন নিজে। তিনি দয়া করে যাকে যতটুকু ইলম দান করেছেন, সে ততটুকু জ্ঞানই লাভ করেছে। তাই সৃষ্টির প্রথম মানব হজরত আদম (আ.)-এর জ্ঞান সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেছেন : আর তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিয়েছেন, (সুরা বাকারা, আয়াত ৩১) বস্তুসমূহের নামই শুধু নয়, বরং এগুলোর বস্তুগুণ এবং বৈশিষ্ট্যগুলো আল্লাহতায়ালা হজরত আদম (আ.)- কে শিক্ষা দিয়েছেন বলে সব তাফসির গ্রন্থসমূহে উল্লেখ রয়েছে। অতঃপর আল্লাহতায়ালা যখন ফেরেশতাদের সে সব বস্তুর নাম বলতে আদেশ করলেন তখন তারা যে জবাব দিয়েছিলেন তা থেকেও প্রতীয়মান হয় যে, সব জ্ঞানের উৎস হচ্ছে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা। তারা বলেছিলেন, আপনি মহান পবিত্র, আপনি আমাদের যা শিক্ষা দিয়েছেন তাছাড়া আমাদের তো কোনো জ্ঞানই নেই। বস্তুত আপনি জ্ঞানময় ও প্রজ্ঞাময়। (সুরা বাকারা, আয়াত ৩২)

সুরা আলে ইমরানের নিম্নোক্ত আয়াতে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ প্রদত্ত কিতাব ও হিকমতের শিক্ষা লাভের আগে মানুষ স্পষ্ট ভ্রান্তিতে ছিল। তিনি ইরশাদ করেন : আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অবশ্যই অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের কাছে রসুল (সা.) প্রেরণ করেছেন, যিনি তার আয়াত তাদের কাছে তিলাওয়াত করেন, তাদের পরিশোধন করেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন, যদিও তারা আগে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে ছিল। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : আমি আল্লাহতায়ালার কাছে জানতে চাইলাম, হে আল্লাহ! আমি কোন জিনিস আপনার কাছে চাইব? মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী আপনি আমার কাছে জ্ঞান হাসিলের আবেদন করুন।’

♦ লেখক : ইমাম ও খতিব

কাওলার বাজার জামে মসজিদ দক্ষিণখান, ঢাকা

সর্বশেষ খবর