বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

ব্রিটেনের নির্বাচন : রাজা চার্লসের মুসলিম কানেকশন

সুমন পালিত

ব্রিটেনের নির্বাচন : রাজা চার্লসের মুসলিম কানেকশন

ব্রিটেনে কাল ৪ জুলাই সাধারণ নির্বাচন। বিলাতে ঋষি সুনাকের নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ দল ক্ষমতায় থাকবে নাকি ক্ষমতা লেবার পার্টির শিকেয় ছিঁড়বে সে বিষয়ে রায় দেবেন ব্রিটেনের ভোটাররা। জনমত জরিপের তথ্য বলছে, নির্বাচনে স্যার কিয়ার স্টার্মারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি এগিয়ে। এ নির্বাচনে ৩৪ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এদের মধ্যে বর্তমান পার্লামেন্টের চারজন সদস্যও রয়েছেন। যাদের একজন বঙ্গবন্ধু দুহিতা শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক। লেবার পার্টি জিতলে যারা মন্ত্রী হবেন বলে ভাবা হচ্ছে সে তালিকায় আছেন তিনিও। নির্বাচনে অযাচিতভাবে বাংলাদেশের নাম টেনে এনে বিপাকে পড়েছেন লেবার পার্টি প্রধান স্যার কিয়ার স্টারমার। ঐতিহ্যগতভাবে ব্রিটেনের বাঙালিরা লেবার পার্টির সমর্থক। সে দলের প্রধান নেতা বলেছেন, ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো থেকে আসা যেসব লোকের বৈধ কাগজপত্র নেই, তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। লেবার নেতা তার বক্তব্য থেকে পরে সরে এলেও দলে এ নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লেবার পার্টি নেত্রী সাবিনা আখতার এ ইস্যুতে পদত্যাগ করেছেন দল থেকে।

সবারই জানা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে এক সময় সূর্য ডুবত না। দুনিয়ার দেশে দেশে উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল তারা। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ সবই ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীনে। আজ দুনিয়ার এক নম্বর অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্রও ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের সব দেশেই উড়ত ব্রিটিশ পতাকা। এশিয়া আফ্রিকার এক বড় অংশেরও ভাগ্য বিধাতা ছিল তারা। কালের বিবর্তনে ব্রিটিশ শাসন কার্যত এখন নিজ ভূখণ্ডেই সীমিত। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি দেশ ব্রিটিশ রাজাকে সাংবিধানিকভাবে তাদের রাজা বলেই মানে। তবে সেসব দেশ শাসনে ব্রিটিশ রাজার কোনো নির্বাহী ভূমিকা নেই। এমনকি কয়েক শতাব্দী ধরে ব্রিটেনেও রাজা বা রানি কোনো নির্বাহী ক্ষমতা ভোগ করেন না। দেশ পরিচালনা করেন জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। সবকিছু রাজার নামে হলেও রাজা কখনো পার্লামেন্ট কিংবা মন্ত্রিসভার কাজে হস্তক্ষেপ করেন না। সে সুযোগও নেই। ঐতিহ্যগতভাবে ব্রিটেনের মানুষ ধর্মীয় উদারতায় বিশ্বাসী। ব্রিটিশরা এক সময় দুনিয়ার এক বৃহৎ অংশে নিজেদের শাসন কায়েম করলেও কোথাও ধর্ম প্রচারে উৎসাহ দেখায়নি। রাজা তৃতীয় চার্লস চার্চ অব ইংল্যান্ডের সুপ্রিম গভর্নর অর্থাৎ খ্রিস্টানদের একটি সম্প্রদায়ের প্রধান নেতা। তারপরও বাস্তবে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের প্রতি গভীরভাবে তিনি আস্থাশীল। সব ধর্মের মানুষের সহাবস্থানেও বিশ্বাসী তিনি।

রাজা চার্লস একাধিকবার ইসলাম ধর্মের প্রশংসা করেছেন। ২০২২ সালে আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল- তিনি পবিত্র কোরআন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং মুসলিম নেতাদের কাছে আরবিতে চিঠিও লিখেছেন। রবার্ট জবসনের লেখা ‘চার্লস অ্যাট সেভেন্টি’ বইতে বিষয়টি উঠে এসেছে
জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে রাজা ব্রিটেনে বসবাসকারী সব ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক গড়ায় ভূমিকা রাখেন। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, সব ধর্মের মানুষকে দেখেন সমান চোখে।

রাজা চার্লস একাধিকবার ইসলাম ধর্মের প্রশংসা করেছেন। ২০২২ সালে আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল- তিনি পবিত্র কোরআন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং মুসলিম নেতাদের কাছে আরবিতে চিঠিও লিখেছেন। রবার্ট জবসনের লেখা ‘চার্লস অ্যাট সেভেন্টি’ বইতে বিষয়টি উঠে এসেছে। ২০১০ সালে সে সময়ের যুবরাজ চার্লস অক্সফোর্ডের ইসলামিক স্টাডিজ সেন্টারে পরিবেশ ইস্যুতে বলেছিলেন, ইসলাম অনুযায়ী প্রকৃতির প্রাচুর্যের সীমা আছে। আর তাই মুসলিমদের সীমা লঙ্ঘন না করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ২০০৫ সালে ইসলামের মহানবীর ব্যাঙ্গচিত্র এঁকে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল ডেনমার্কের একটি কার্টুন ম্যাগাজিন। ওই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে চার্লস বলেছিলেন, সবার উচিত অন্যের বিশ্বাসকে সম্মান জানানো। মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া এক বক্তৃতায় যুবরাজ চার্লস বলেছিলেন, একটি সভ্য সমাজের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার সংখ্যালঘু এবং অপরিচিতদের সম্মানের চোখে দেখা। অন্যের চোখে যা পবিত্র এবং মূল্যবান তা সম্মান করতে না পারলে সেটি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।

মুসলিমদের কাছে রমজান পবিত্র মাস বলে বিবেচিত। এ মাসে রোজা রাখা হয়। এ মাস নিয়ে চার্লস একবার বলেছিলেন, বিশ্বের সবার উচিত রমজানের চেতনা থেকে শিক্ষা নেওয়া। রোজার মাস যেমন উদারতা শেখায় তেমনি মানুষকে ত্যাগ, কৃতজ্ঞতা এবং একত্রিত হতে উৎসাহিত করে। রাজা চার্লস দীর্ঘদিন ধরেই মুসলিম বিশ্বকে পশ্চিমাদের কাছে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, উভয় পক্ষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে। রাজা চার্লসের মতে, পশ্চিমা বিশ্ব ইসলামী বিশ্বের কাছে অনেক দিক থেকে ঋণী। ১৯৯৩ সালে তিনি বলেছিলেন, পশ্চিমা বিশ্ব শুধু ইসলাম সম্পর্কে ভুলই বোঝে না, সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে তাদের অবদানের কথাও ভুলে যায়। রাজা চার্লস বলেন, ইসলাম ধর্মকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ দিয়ে ব্যাখ্যা করা ঠিক নয়।

ব্রিটিশ রাজ পরিবারের মুসলিম কানেকশন নিয়ে রয়েছে অনেক তথ্য-উপাত্ত। ২০১৮ সালের এপ্রিলে মরক্কোর সংবাদপত্র আল-ওসবোতে দাবি করা হয়- বর্তমান ব্রিটিশ রাজবংশ চৌদ্দ শতকে আর্ল অব কেমব্রিজ বংশের সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এ আর্ল অব কেমব্রিজ বংশ স্পেনের প্রথম ইসলামী রাজবংশের সঙ্গে রক্তবন্ধনে যুক্ত। কারণ, স্পেনে ইসলামী শাসনের গোড়াপত্তন করেছিলেন হজরত ফাতিমা (রা.)-এর বংশধর।

সে অর্থে জর্ডান ও মরক্কোর রাজবংশ এবং ইরানের আধ্যাত্মিক নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিও ব্রিটিশ রাজ পরিবারের খুব কাছের আত্মীয়। এ দাবির সত্যতা নিয়ে ইউরোপ ও আরব উভয়দিকের ইতিহাসবিদরা নানা মত পোষণ করেন।

একদল ইতিহাসবিদের মতে, সেভিল শহর মরক্কোর উমাইয়া সমর্থিত বর্বরদের দ্বারা আক্রান্ত হলে এগারো শতকে জাইদা নামে স্পেনের ইসলামী রাজবংশের এক রাজকন্যা সেখান থেকে পালাতে বাধ্য হন এবং কাস্তাইয়ের খ্রিস্টান রাজা ষষ্ঠ আলফোনসোর কাছে আশ্রয় নেন। সেখানেই জাইদা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। তার নতুন নাম হয় ইসাবেলা। তিনি আলফোনসোকেই বিয়ে করেন এবং তাদের এক পুত্রসন্তান হয়। সেই পুত্রেরই কোনো বংশধর কেমব্রিজের আর্লকে বিয়ে করেন। হাজার বছর আগের এ ঘটনার যথার্থতা যাই হোক, ব্রিটিশ রাজ পরিবার তাদের মুসলিম কানেকশন নিয়ে কখনো কোনো মন্তব্য করেনি। মুসলমানদের কাছেও এ ধরনের ইতিহাস কিংবা কাহিনির কোনো গুরুত্ব নেই।

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এখন ঋষি সুনাক। ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে তিনি ক্ষমতায়। ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ব্রিটেনের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভরাডুবিতে আগাম নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেন ঋষি সুনাক। কনজারভেটিভ পার্টির পায়ের নিচ থেকে যে মাটি সরে গেছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ফলাফল তারই প্রমাণ। স্মর্তব্য, ঋষি সুনাকের আগে প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন বরিস জনসন। পার্টিগেট নিয়ে পার্লামেন্টে বিভ্রান্তিকর বিবৃতি দেওয়ায় তাকে প্রধানমন্ত্রী পদ ছাড়তে হয়।

ব্রিটেনের এ যাবৎকালের অন্যতম গুণী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাবা হয় বরিস জনসনকে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি পরিচিত ছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় কলামিস্ট হিসেবে। ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় সাপ্তাহিক কলাম লিখে তিনি সম্মানি পেতেন বছরে ২ লাখ ৭৫ হাজার পাউন্ড। অন্যান্য পত্রিকা এবং ম্যাগাজিনে লিখেও আয় করতেন বিপুল অর্থ। একটি বই লেখার জন্য তিনি ৫ লাখ পাউন্ড পাওয়ার চুক্তিতে আবদ্ধ হন।

সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনেরও রয়েছে মুসলিম কানেকশন। তিনি একজন তুর্কি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ। তার দাদার বাবা অর্থাৎ প্রপিতামহ আলি কামাল ১৯১৮ সালে ছিলেন তুরস্কের উসমানীয় খলিফার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। প্রপিতামহের ভাই ছিলেন তুরস্কের প্রভাবশালী রাষ্ট্রদূত। বরিস জনসনের প্রপিতামহ ছিলেন খেলাফতের ঘোর সমর্থক। মুস্তফা কামাল আতাতুর্কের প্রচণ্ড বিরোধী। তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতা দখল করলে আলি কামালকে হত্যা করা হয়। আলি কামাল বিয়ে করেছিলেন এক ব্রিটিশ খ্রিস্টান মহিলাকে। তার গর্ভে জন্ম নেন বরিস জনসনের পিতামহ। তিনি কখনোই বাবার দেশে যাননি। মুসলমান পুরুষরা খ্রিস্টান ও ইহুদি নারীদের বিয়ে করতে পারেন স্ব স্ব ধর্মীয় বিশ্বাসে বহাল থাকা অবস্থায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় উমাইয়া খলিফাদের কারও কারও খ্রিস্টান স্ত্রী ছিল। বাবার হত্যাকাণ্ডের পর বরিস জনসনের দাদা তার মায়ের কাছে লালিত-পালিত হন। তিনি তার পুত্রের নাম রাখেন মুসলিম ও খ্রিস্টান ঐতিহ্য অনুযায়ী। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ টানা যায় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামাকে। ওবামার বাবা কেনিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসা কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমান। মা মার্কিন শ্বেতাঙ্গিনী খ্রিস্টান। বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর ওবামা মায়ের কাছে মানুষ হন। মায়ের ধর্মই অনুসরণ করেন তিনি। বরিস জনসনের প্রপিতামহের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল তেমনটি। বরিস জনসন পূর্ব পুরুষদের মতো তুরস্কের উসমানিয়া খেলাফতের প্রতি সমীহ পোষণ করলেও ইংরেজ পরিচয়েই গর্ববোধ করেন। ইউক্রেনের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেওয়ায় ইউরোপের তথা বিশ্ব রাজনীতিতেও তিনি আলোচিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন তার প্রধানমন্ত্রিত্বকালে।

ঋষি সুনাক অল্প সময়ে দলের মধ্যে শক্ত ভিত গড়ে তুলেছেন। ব্রিটেনের বাঙালিরা ঐতিহ্যগতভাবে লেবার পার্টির সমর্থক হলেও ব্যক্তি হিসেবে তাদের কাছে ঋষি সুনাক এগিয়ে। এর কারণ ভারতে জি-১০ সম্মেলনকালে ঋষি সুনাক মায়ের বয়সী বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তার পায়ের কাছে বসে কথা বলেন। আলাপচারিতায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, আমার দুই কন্যাই আপনার অনুসারী। যা দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিকদের মনে ঋষি সুনাক সম্পর্ক সফট কর্ণার সৃষ্টি করেছে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক নিজের ব্রিটিশ পরিচয়ে গর্ববোধ করেন। ব্রিটেনে দীর্ঘদিন ধরে কনজারভেটিভ পার্টি ক্ষমতায়। তবে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট এ দলের জনপ্রিয়তায় ধস নামিয়েছে। আজ ৪ জুলাইয়ের নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টি জিততে না পারলে ব্রিটেনে আবার লেবার যুগের সূচনা হবে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর