বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

সামাজিক সমস্যা মাদকাসক্তি

বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী

সামাজিক সমস্যা মাদকাসক্তি

বাংলাদেশ অনেক সামাজিক সমস্যা বিদ্যমান। তার মধ্যে মাদকাসক্তি বড় একটি সমস্যা এবং এটি বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। মাদকাসক্তি একটি রোগ। মাদকদ্রব্য, ধূমপান ও তামাক সেবন মানুষের অকাল মৃত্যু এবং স্বাস্থ্যহানির অন্যতম প্রধান কারণ। মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে আমাদের তরুণ প্রজন্মের বিপথগামিতাও সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, বর্তমানে বাংলাদেশের বড় অংশের জনগোষ্ঠী কিশোর-তরুণ, যে কারণে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকে বলা হয় ইয়ুথ ডিভিডেন্ট। বাংলাদেশে ৪৯% মানুষের বয়স ২৪ বা এর নিচে। অর্থাৎ ৪৯% জনগোষ্ঠী বয়সে তরুণ। বেসরকারি হিসাব মতে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। মাদকসেবীদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, ইয়াবা সেবনকারী শতকরা ৮৫ ভাগই তরুণ যুবসমাজ! ধারণা করা হচ্ছে- আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে যাবে। মাদকাসক্তি একটি রোগ। মাদকাসক্ত ব্যক্তির আসক্তি তাকে মানসিক ও শারীরিক রোগসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যার আশঙ্কা সৃষ্টি করে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের বিভিন্ন রোগের মতো এইচআইভি এইডসের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা মাদক গ্রহণকালীন অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ। মাদকাসক্তদের মধ্যে শতকরা ৯৮ ভাগই ধূমপায়ী এবং তাদের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ বিভিন্ন অপরাধ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত, যা গবেষণায় প্রমাণিত। ধূমপানে অভ্যস্ততার মধ্য দিয়ে তরুণরা মাদকদ্রব্য সেবন শুরু করে থাকে। পরবর্তীতে ইয়াবা, ফেনসিডিল, সিসা, হেরোইন, কোকেন, আফিস, কোডিন, মরফিন, এলএসডিসহ বিভিন্ন মারণনেশায় আসক্ত হয়। ক্রমান্বয়ে মাদকাসক্তরা কিডনি, লিভার, মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্ম নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে ও স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য তরুণদের ধূমপান, মাদকসহ সব নেশা থেকে দূরে থাকা জরুরি। কিন্তু মাদকের সঙ্গে জড়িত অসাধু চক্র আমাদের যুবসমাজকে ধ্বংসের দারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। তরুণদের মাদকের রাজ্যে টানতে তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করছে অসাধু মাদক ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারিরা। এটিও বড় চ্যালেঞ্জরূপে আবির্ভূত হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৮০ শতাংশেরও বেশি কিশোর অপরাধী মাদকাসক্ত এবং তাদের বেশির ভাগই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। উপরন্তু, ৮৫ শতাংশ কিশোর অপরাধী মাদক কেনার কথা স্বীকার করেছে এবং ৫৫ শতাংশ স্বীকার করেছে যে, তারা মাদক বিক্রি করেছে। এদের অধিকাংশ স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থেকেই পরিচয় ঘটছে মাদকের সঙ্গে। স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থান মাদক সরবরাহের হটস্পটে পরিণত হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে মাদক বিক্রি করে অসংখ্য মাদক চোরাকারবারি চক্র। এর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা, স্থানীয় চোরাকারবারি এমনকি ছাত্রছাত্রীরা এর সঙ্গে জড়িত! বিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, বিগত ২০ মাসে ক্যাম্পাসে মাদক সম্পৃক্ততায় বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী আটক হয়েছেন। মাদকসহ আটক হওয়ায় মামলা হয়। আটককৃত প্রায় ডজনখানেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর একাডেমিক ফলাফল পর্যবেক্ষণ করে প্রশাসন দেখতে পায়, প্রথমবর্ষে যে শিক্ষার্থীর ফলাফল ফার্স্ট ক্লাস ছিল, পরবর্তীতে মাদকাসক্তের কারণে একাডেমিকভাবে তারা পিছিয়ে গেছেন। অকৃতকার্য হয়ে অনেকের দু-এক বছর ড্রপ হয়েছে। অধিকাংশই ভুল স্বীকার করে এ কাজ থেকে বিরত থাকার অঙ্গীকার করলেও আবারও মাদকের জালে জড়িয়ে পড়ে। তাহলে মাদক প্রতিরোধে বিনিয়োগের যে বিষয়টি ইউএনওডিসি এ বছর সামনে এনেছে, সেটা অত্যন্ত সময়োপযোগী। কারণ মাদক বর্তমানে আমাদের মানুষ গড়ার প্রতিষ্ঠান স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আগ্রাসন চালাচ্ছে। জাতি মেধাশূন্য হওয়ার যে ভয়ানক প্রক্রিয়া চলমান, তা রুখতে হবে ‘মাদক প্রতিরোধ’ কার্যক্রমে জোর দেওয়ার মাধ্যমে। তা না হলে ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। কারণ হলো- কিশোর ও তরুণরা শুধু মাদকদ্রব্যের আসক্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বিবরণীতে জানা যায়, গত ১০ বছরে নেশাখোর সন্তানের হাতে প্রায় ২০০ বাবা-মা খুন হয়েছেন, স্বামী হত্যা করেছে স্ত্রীকে, স্ত্রী হত্যা করেছে স্বামীকে। খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ, পরকীয়া প্রেম, দাম্পত্য কলহ, অর্থ লেনদেন, হত্যা, সন্ত্রাসী কার্যক্রম সবকিছুর মূলেই রয়েছে এই মাদকের নেশা। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব কিন্তু, সেই মানুষ মাদকের নেশায় হয়ে উঠে হিংস্র দানব, নরপশু। সুতরাং সামাজিক মূল্যবোধের এই যে চরম অবক্ষয়, আমাদের ভাবিয়ে তুলছে।

সম্প্রতি গাজীপুরের কাপাসিয়ায় টাকার জন্য ঘরে টানা দুই দিন দুই দফায় নিজেদের বাড়িতে আগুন দেন কামরুজ্জামান নামক এক মাদকাসক্ত। এতে বাড়ির পাঁচ কক্ষের সব আসবাব পুড়ে যায়। ঈশ্বরদীতে ইপিজেডে এক নারী কর্মী নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তার ওপর ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাবেক স্বামী। তার অপরাধ, তিনি মাদকাসক্ত সাবেক স্বামীর সঙ্গে ঘর-সংসারের প্রস্তাবে রাজি হচ্ছিলেন না। আবার সম্প্রতি, ঢাকায় ফিলিস্তিন দূতাবাসের গাডরুমের সামনে দায়িত্ব পালনের সময় পুলিশ কনস্টেবল কাউসার আলী এসএমজি দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে তার সহকর্মী কনস্টেবল মনিরুল ইসলামকে হত্যা করেন। এ দুর্ঘটনায় জাপান দূতাবাসের গাড়িচালক সাজ্জাদ হোসেন শাখরুখও আহত হন। ঘাতক পুলিশ কনস্টেবল মাদকাসক্ত ছিলেন বলে বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনা চলছে। এ ঘটনায় নতুন করে পুলিশ সদস্যদের ডোপ টেস্ট করার বিষয়টি সামনে উঠে আসে। যা অনেকদিন ধরে নীতিনির্ধারণী সভায় বারবার আলোকপাত করে আসছি। কিন্তু ফল আসছে না। এ রকম ঘটনায় শুধু বিষয়টি কিছুটা আলোচনায় আসে। আশা করছি, এবার পুলিশ সদস্যদের ‘ডোপ টেস্ট’ জোরালো গতি পাবে।

লেখক : (একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দ সৈনিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র), প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস)

সর্বশেষ খবর