বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

মুমিনরাই আল্লাহর আপন লোক

আল্লামা মাহ্‌মূদুল হাসান

কোনো সমাজসেবী সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে দান করছেন; এখন এ কথা ভাবা যাবে কি যে, তিনি তার সন্তানদের মাহরুম করে সব অর্থ অন্যদের দিচ্ছেন? আদৌ এটা ভাবা যায় না। কারণ সবাই আপনকে আগে দেয়, আপনের টান সবার থাকে। পিতার সবচেয়ে আপন তো সন্তানই হয়ে থাকে। তাকে সে না দিয়ে অন্যকে দিতে পারে না। যদি দেয় তাহলে তাকে আদর্শ পিতা বলা যাবে না। শরিয়তে এরূপ করার অনুমতি নেই। উপরোক্ত নীতি অনুযায়ী মুমিনগণই আমলের প্রতিদান দুনিয়াতে আগে পাবে। কারণ, মুমিনরাই আল্লাহর আপন লোক। আল্লাহ মুমিনদের ক্ষেত্রে বলেন, (আমার বান্দাগণ) আর কাফেরদের ক্ষেত্রে যে শব্দ ব্যবহার করেন তা হলো, প্রথমটিতে ইয়া আর দ্বিতীয়টিতে লানা। প্রথমটিতে যতটুকু আপনত্ব বোঝানো হয়েছে, দ্বিতীয়টিতে তার কিছুই নেই। আসল কথা হলো, আমরা বুঝি না। আল্লাহপাক যে আমাদের কত নেয়ামত দিচ্ছেন তা অনুধাবন করার যোগ্যতা আমাদের নেই। তাই আমরা আল্লাহর প্রতি অভিযোগ করি যে, এত আমল করি কিন্তু আল্লাহ আমাদের দিকে তাকায় না।

একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবেন যে, আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের সমুদ্রে আপনি সাঁতার কাটছেন। সবচেয়ে বড় নেয়ামত হলো আপনার ইমান। এই ইমানই আপনাকে একদিন না একদিন জান্নাতে পৌঁছাবে। যে কাফের হয়ে মৃত্যু বরণ করল, সে তো চির দুর্ভাগা। দুনিয়াতে সীমাহীন ভালো কাজ করলেও তার নসিবে জান্নাত কখনো হবে না। আল্লাহ তাআলা আমাকে আপনাকে এই মহান নেয়ামত দিয়েছেন, কিন্তু আমাদের উপলব্ধি নেই। আমাদের নামাজ পড়ার তাওফিক হচ্ছে, এগুলো কি কম বড় নেয়াতম? কিন্তু আমাদের বুঝ নেই। বুঝের অভাবেই আমরা শুধু আখেরাতের প্রতিদানের কথা বলে মানুষকে দ্বীনের প্রতি, নেক আমলের প্রতি দাওয়াত দেই; তখন অনেকে বলে “আরে ভাই! দুনিয়ায় চলব কীভাবে, তাই বলুন। কর্মের মজুরি নগদ না পেয়ে লক্ষ-কোটি বছর বাকি থাকবে, তারপর পাব? বাকির নাম তো ফাঁকি।” এরকম কথা বলা অবশ্য বাঞ্ছনীয় নয়। কারণ আল্লাহর স্বভাবে কোনো ফাঁকিবাজি নেই।

যাহোক বলছিলাম যে, ইবাদত করার, নেক কাজ করার শক্তি ও তাওফিক পাওয়া আল্লাহর বড় নেয়ামত। যে ইবাদত করার তাওফিক পেল, সে নিজেকে সবচেয়ে বড় সৌভাগ্যবানদের একজন মনে করতে পারে। চাই সে ইবাদতে মজা ও স্বাদ পাক বা না পাক। আসলে ইবাদতে স্বাদ পাওয়াটা জরুরি নয়, বরং কষ্ট হওয়াই ইবাদতের মূল বৈশিষ্ট্য।

অনেক লোক আমাকে চিঠিতে অনুযোগের সুরে জানায় যে, ‘হুজুর! কত আমল-ইবাদত করি, কিন্তু কোনো মজা পাই না। দিলকে জোর করে বাধ্য করি।’ আমি তাদেরকে উত্তরে বলি যে, ‘ইবাদত কার জন্য করো? নিজের নফসের মজার জন্য নাকি আল্লাহর জন্য? আল্লাহর জন্য করলে নিজের মজা খোঁজ কেন? মজা তো আল্লাহ পাবে। কোরআনে বলা হয়েছে আয়াতে উল্লিখিত (যার শব্দ মূল) অর্থ কী? অর্থ হলো আল্লাহর পথে চলতে, শরিয়তের বিধি বিধান পালন করতে নানাবিধ কষ্টের সম্মুখীন হতে হবে, সেই কষ্টকে যারা সহ্য করবে তাদেরকে আমি অবশ্যই আমার হেদায়েতের পথ দেখাব। যেমন : নামাজ পড়তে শারীরিক কষ্ট হয়। গরমের সময় বিদ্যুৎ না থাকলে তো আরও বেশি কষ্ট। যারা দোকানপাট বন্ধ করে নামাজে আসে, তাদের মানসিক কষ্টও হয়। হায়রে! নামাজটা ফরজ না হলে, এখন কতগুলো মাল বিক্রি করতে পারতাম! অনুরূপ হজ করতে কষ্ট হয়। দু-তিন লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়। এরপর আবার জীবনের রিস্ক নিয়ে লাখ লাখ মানুষের মধ্যে হজের কাজগুলো সম্পন্ন করতে হয়। এসব কষ্ট স্বীকার করার পরই কেবল হেদায়েতের পথে দৃঢ়পদে চলতে পারার গ্যারান্টি রয়েছে।

আপনার কাছে কোনো সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্মানিত ব্যক্তি এক ব্যাগ ভরে কোনো জিনিস হাদিয়া আনল। নিজের হাতে বহন করে এনে আপনার হাতে দিল। আপনি স্বাভাবিকভাবেই ভীষণ খুশি হবেন এবং বলবেন, “আপনি নিজেই বয়ে নিয়ে আসলেন! কোন লোক দিয়ে আনলে ভালো হতো না?” তখন সে ব্যক্তি উত্তর দিবে, ‘না হুজুর, কারও কছে না দিয়ে আমি নিজের হাতেই বহন করে আনাকে আপনার তাযীমের অধিক মোয়াফেক মনে করেছি।’ এ কথা শোনার পর তো আপনার খুশির ঢেউয়ে তরঙ্গ সৃষ্টি হবে।

আর যদি এর বিপরীতে অন্য এক সম্মানিত ব্যক্তি তার চাকরের হাতে বহন করে খুব দামি হাদিয়া নিয়ে আসল। আপনার কাছে এসে বলল, ‘হুজুর! আপনার জন্য হাদিয়া এনেছি।’ এবার চাকরকে লক্ষ্য করে- ‘এই দে, হুজুরকে দে’ এতে কি আপনি আগের মতো খুশি হবেন? এবারের হাদিয়ার পরিমাণ ও দাম আগের হাদিয়ার তুলনায় যতই বেশি হোক, নিশ্চয়ই এবারের খুশির পরিমাণ আগের চেয়ে কম হবে। মনের মুহাব্বত আগের ব্যক্তির প্রতিই বেশি সৃষ্টি হবে। কারণ পরের ব্যক্তি কোনো কষ্ট ছাড়া নবাবের মতো, নিজের প্রেস্টিজ-সম্মান ঠিক রেখে আপনাকে খুশি করতে এসেছে। পক্ষান্তরে প্রথমজন স্বীয় প্রেস্টিজের প্রতি কোনো খেয়াল না করে, কষ্ট সহ্য করে গোলামের মতো বিনয়ী বেশে আপনাকে খুশি করতে এসেছে। তাই বলা যায় আল্লাহপাক পূর্বোক্ত দ্বারা বলতে চাচ্ছেন যে, তুমি ইবাদত করো কি মজা পাওয়ার জন্য? তাহলে তো তোমার স্বার্থে ইবাদত করছ, আমার জন্য নয়। আমার রাস্তা পেতে হলে তো বহু কষ্ট স্বীকার করতে হবে।

লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ

সর্বশেষ খবর