বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

আসুন অশুভকে না বলি

অধ্যাপক মালেকা আক্তার চৌধুরী

আসুন অশুভকে না বলি

জ্ঞানের আদিপাঠ দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ একটা শাখা হলো নীতিবিদ্যা। দর্শনের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক হিসেবে বিষয়টি যেমন পড়েছি তেমনি পড়িয়েছিও দীর্ঘদিন। শুধু তাই নয়, ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আচরিত জীবনের প্রতিপদে সজ্ঞানে-অজ্ঞানেও মেনে চলেছি আজও চলি, ভবিষ্যতেও চলব। এটি ঠিক ব্রত নয়; জীবনঘনিষ্ঠ সহজাত প্রবৃত্তির নিয়মিত পরম্পরা। আপনি চাইলেই পারেন জীবনের সুকুমার বৃত্তির বিকাশ ঘটিয়ে আত্মতুষ্টির অনন্য উচ্চতায় আপনাকে স্থাপন করতে। এ পথ খানিকটা কঠিন হতে পারে তবে কবিগুরুর মতো করে বলতে পারা যাবে সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম। অথবা কবি নজরুল যেমন বলেন, “হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছো মহান।’ তবে দারিদ্র্যের এক করাল বিক্ষুব্ধ রূপ তিনি এঁকেছেন” তার কালজয়ী ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসে। যাহোক, আজ আর ওদিকে নয়। যা বলছিলাম, শিশুকালেও পড়েছি সদা সত্য কথা বলব, পরের অনিষ্ট করতে নেই, জীব হত্যা মহাপাপ ইত্যাদি কত নীতিকথা, নীতিবাক্য। কোনোটি বুঝে, কোনোটা না বুঝেই আরেক দিকে তাকিয়ে আত্মস্থ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে এসে নীতিবিদ্যা পড়তে গিয়ে বুঝেছি এর আকার প্রকার, সাধারণ বিশেষ, ঐচ্ছিক অনৈচ্ছিক, কামনা, বাসনা, অভিপ্রায়- কত তার মতবাদ, মতাদর্শগত পার্থক্য, আলোচনা সিদ্ধান্ত। তবে সবচেয়ে সহজ কথাটা বলেছেন, পূর্ণতাবাদী দার্শনিকরা আর জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট। কান্টকে বলা হয় আধুনিক দর্শনে একমাত্র বিচারবাদী দার্শনিক। কর্তব্যের জন্য কর্তব্য, শর্তহীন আদেশ, সদিচ্ছার ধারণা দর্শন জগতের অনন্য পাঠ। তাছাড়া মানুষের মাঝে রয়েছে জীববৃত্তি আর বুদ্ধিবৃত্তি নামক দুটি বৃত্তি। নৈতিক জীবনে এ দুটির সমন্বয় সাধন যেমন জরুরি তেমনি আবেগ অনুভূতি সংবেদনের মূল্যও কম নয়। একইভাবে পূর্ণতাবাদিরাও বলেন, নৈতিক পূর্ণতা লাভই হলো মানব জীবনের পরম নৈতিক আদর্শ। পূর্ণতাবাদী হেগেল খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু খুবই সংক্ষিপ্ত দুটো নীতির কথা বলেছেন- একটা ‘মানুষ হও’ অন্যটি ‘বাঁচার জন্য মর’ এর তাৎপর্য সুবিশাল ও গভীর। এখানেই হেগেল ব্যক্তি মানুষকে ক্ষুদ্র স্বার্থ পরিত্যাগ করে বৃহত্তর সত্তার সন্ধান ও আত্মকেন্দ্রিক জীবন পরিহার করে মহত্তর জীবনের সন্ধানকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

ছোট্ট একটা জীবন এবং সে একটাই মানব জীবন। জীবন থেকে পশুবৃত্তিটাকে নিয়ন্ত্রিত করে উচ্চবর্গের মানবে পরিণত হতে পারাটাই এই ছোট্ট জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত নয় কি? আফসোস হয় আজকাল পত্রপত্রিকার সংবাদ পাঠ করে। মনটা বিষাদে ভরে যায়। একটার ফলোআপ শেষ হতে না হতেই পত্রিকা দখল করে নেয় আরও অধিক হতাশার খবর। মানুষ কতটা পাষণ্ড আর নিষ্ঠুর হলে একজন সংসদ সদস্যকে কেটে টুকরা টুকরা করে পৃথিবীতে তাঁর অস্তিত্ব বিলীন করে ফেলে। গা শিউরে ওঠে! সর্বগ্রাসী লোভ হিংসা ক্রোধ, পরশ্রীকাতরতা, ধর্মান্ধতা, স্বার্থপরতা মানুষকে মনুষ্যত্ব থেকে যোজন যোজন দূরে ঠেলে দিয়েছে। মানবিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা আজ ক্ষয় হতে হতে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।

যার যত বেশি আছে তাঁর আরও অধিক চাই। যান্ত্রিক জীবন মানুষকে গতি দিয়েছে বটে কিন্তু মূল্যবান নির্মল আবেগ কেড়ে নিয়ে মানুষকেই অসহায় যন্ত্রে পরিণত করেছে। রেসের ঘোড়া শুধু ছুটতে জানে, থামতে জানে না। থামাটাও যে অনিবার্য তা আমরা বুঝি না। এভাবেই সমাজে বাড়ছে হতাশা, অস্থিরতা, বৈষম্য, দুর্নীতি, মাদক, বিবাহ বিচ্ছেদ, খুনোখুনির মতো অনৈতিক আর নৃশংস কর্মকাণ্ড। সরলতা, ভালোবাসা, নির্মল আনন্দ লাভের জায়গাগুলো ক্রমেই সংকুচিত হয়ে মানুষ প্রযুক্তির ঘেরাটোপে আটকে যাচ্ছে ক্রমাগত। সম্প্রসারিত হচ্ছে অপরাধ জগৎ। স্ত্রী স্বামীকে, স্বামী স্ত্রীকে, পিতা পুত্রকে, পুত্র পিতাকে- মাতাকে সামান্য বিষয় নিয়ে খুনোখুনিতে লিপ্ত হচ্ছে। সামাজিক অস্থিরতা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, পরমত অসহনশীলতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। পাশাপাশি যে ভালো সংবাদ, অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো সংবাদ নেই সেটা বলা যাবে না। তবে তা স্বল্প পরিসরে, হাতেগোনা।

এহেন সামাজিক অবস্থায় নীতি-নৈতিকতা মূল্যবোধের অবক্ষয় যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করা মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। যুবসমাজ একটা জাতির অমূল্য সম্পদ। কিন্তু সুশিক্ষার অভাবে হয় বেকারত্বের দায় নিয়ে নয়তো অবৈধ পথে অল্প সময়ে অধিক উপার্জনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ছুটে চলেছে অজানা গন্তব্যে। কে তারে ঠেকাবে? কেউ ঠকতে চায় না, সবাই ঠকাতে আগ্রহী। কাউকে বিশ্বাস করাটা যেন অভাবনীয় অবিশ্বাস্য রকমের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রবৃত্তি আর প্রজ্ঞার সমন্বয় সাধনে যে নৈতিক মানবিক সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠার কথা সেই জায়গাটাতেই চলছে ভয়াবহ আর বিভীষিকাময় খরা।

আবারও বলি, প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের মতো ‘দার্শনিক রাজার’ প্রয়োজন নেই। জন্মগতভাবে প্রতিটি মানুষই দার্শনিক। প্রতিটি মানুষই অমিত সম্ভাবনাময় স্বাধীন মানুষ। সৃষ্টির সেরা জীব। আসুন, আমরা সবাই মিলে প্রজন্মের তারুণ্যকে সত্য শুভ আর কল্যাণের আলোকে জাগিয়ে তুলে পৃথিবী নামক প্রিয় গ্রহটাকে বাসযোগ্য করে তুলি ; অশুভকে ‘না’ বলি।

লেখক : অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর