বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

নফল ইবাদতের মাস মহররম

আবদুর রশিদ

মহররম মাস দিয়ে হিজরি সনের শুরু। হিজরি সন চান্দ্রবর্ষভিত্তিক একটি সন। বাংলা সন সৌরবর্ষভিত্তিক হলেও এ সনকে হিজরি সনের উত্তরসূরি বলে ভাবা হয়। দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর খেলাফতকাল ছিল ইসলামের বিজয় ও সম্প্রসারণের স্বর্ণযুগ। আরবের সীমা পেরিয়ে রোম ও পারস্য পর্যন্ত ইসলামী খেলাফত সম্প্রসারণের ফলে নতুন এলাকার কর্মচারী-কর্মকর্তা নিয়োগ করে রাজধানী মদিনার সদর দফতর থেকে বিভিন্ন নির্দেশ সংবলিত চিঠি ইস্যু করা হতো। কর্মকর্তারাও প্রয়োজন বোধে খলিফার কাছে দিকনির্দেশনার জন্য চিঠি পাঠাতেন। কিন্তু তাতে সুনির্দিষ্ট সন-তারিখ না থাকায় বিপাকে পড়তে হতো। হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) একদা এ বলে খলিফা ওমর (রা.)-এর দরবারে নিবেদন করলেন-“আমিরুল মুমিনীন! আপনার পক্ষ থেকে যে নির্দেশনা আমরা পেয়ে থাকি, তাতে সন-তারিখ না থাকায় কোন সময়ের লেখা তা বোঝা যায় না। ফলে নির্দেশ কার্যকর করতে গিয়ে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। অতএব, সন-তারিখ নির্ধারণ করা দরকার।” এরপর হজরত ওমর (রা.) হিজরি সন প্রবর্তন করেন। একইভাবে একদিন স্বয়ং খলিফা হজরত ওমর (রা.) কোনো এক মোকদ্দমা সম্পর্কীয় চিঠিতে শুধু শাবান মাস লিখা থাকায় ঘটনার সময় নিরূপণ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন। দিন দিন রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্রমোন্নতিতে এ সমস্যাটা আরও তীব্রতর হয়ে উঠল। মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট একটা সন-তারিখ নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ১৭ হিজরিতে হজরত ওমর (রা.) বিশিষ্ট সাহাবিদের নিয়ে এ বিষয়ে এক পরামর্শ সভার আয়োজন করেন। কয়েকজন সাহাবি রোম ও পারস্যের ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর অনুসরণীয় সালকে গ্রহণ করার প্রস্তাব দিলে, অধিকাংশ সাহাবির কাছে এ মত গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। তৎকালীন বহুল প্রচলিত যাবতীয় সাল গণনার পদ্ধতি সম্পর্কে সাহাবিদের মাঝে কোনো ধরনের গোঁড়ামি ছিল না, ইতিহাসের পাতায় দেখা যায় যে, বিভিন্ন প্রয়োজনে বিজাতীয় অনেক মতামতকে যথেষ্ট মূল্যায়ন করা হতো তখনকার দিনে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে হজরত ওমর (রা.) ও সাহাবিগণ অনুভব করছিলেন, সাল গণনা প্রত্যেক জাতির স্বাতন্ত্র্য এবং জাতীয় অস্তিত্বের একটি মৌলিক ভিত্তি। নিজস্ব সন-তারিখ একটি জাতির পরিচয় চিহ্নিত করে। জাতির উত্থান-পতন, জন্ম-মৃত্যু, জয়-পরাজয়, উন্নতি-অগ্রগতির সমুজ্জ্বল ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এ সাল। বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত সময় গণনার পদ্ধতি অনুসরণের বদলে সাহাবিরা একটা নতুন সন প্রবর্তনের তাগিদ অনুভব করেন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরতকে কেন্দ্র করে হিজরি সাল গণনা শুরু করার বিষয়ে সাহাবিগণ ঐকমত্যে পৌঁছান।

মহররম নফল ইবাদতের মাস। ১০ মহররম বা আশুরার দিন রোজা রাখা এ মাসের অন্যতম আমল। রসুলুল্লাহ (সা.) মহররমে আমল করার কথা বলেছেন। আশুরায় রোজা রাখার পাশাপাশি তওবা-ইসতিগফার ও দান-সদকার কথাও বলেছেন। মহররমজুড়ে বেশি বেশি নফল রোজা ও তওবা-ইসতিগফারের প্রতি সবাইকে উৎসাহিত করেছেন। তাই মাসব্যাপী আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করা মোমিন মুসলমানের জন্য একান্ত আবশ্যক। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যদি রমজানের পর আর কোনো মাসে রোজা রাখতে চাও তবে মহররমে রোজা রাখ। কেননা সেটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন রয়েছে যে দিন আল্লাহ অনেকের তওবা কবুল করেন। ভবিষ্যতেও আরও অনেক মানুষের তওবা কবুল করবেন।’ (তিরমিজি, মুসনাদে আহমদ)। মহররমে সবচেয়ে উত্তম হলো কোরআন-হাদিসে বর্ণিত ইসতিগফার-বিষয়ক দোয়াগুলো বুঝে বুঝে পড়া। এ দোয়াগুলোর মাধ্যমে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ বান্দাকে ক্ষমা করে দেবেন বলে আশা করা যায়। রমজানের ফরজ রোজার পর মহররমের নফল রোজার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। রসুল (সা.) হিজরতের পর হজরত মুসা (আ.)-এর সুন্নত হিসেবে আশুরার দিন এবং আগের অথবা পরের দিন রোজা পালনের হুকুম দেন। তিনি মদিনায় হিজরতের পর ইহুদিদের আশুরার দিন রোজা পালন করতে দেখেন। বুখারি ও মুসলিমের হাদিস অনুযায়ী ইহুদিরা রসুল (সা.)-কে জানান, এই দিনে হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর উম্মতকে আল্লাহ নাজাত দান করেন এবং ফেরাউন ও তার বাহিনীকে পানিতে ডুবিয়ে দেন। হজরত মুসা (আ.) আল্লাহর এই কৃপায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এ দিন রোজা পালন করেন। তাই ইহুদিরাও আশুরার দিন রোজা পালন করে। রসুল (সা.) ইহুদিদের বলেন, মুসা (আ.)-এর নাজাতে কৃতজ্ঞতা আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা তোমাদের চেয়ে বেশি হকদার। তিনি এর পর থেকে আশুরায় নিজে রোজা রাখেন এবং মুসলমানদের রোজা রাখার হুকুম দেন। আশুরার রোজা পালনের মাধ্যমে বেশি বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। হজরত আদম (আ.) থেকে রসুল (সা.) পর্যন্ত সব নবী মহররমকে বিশেষ সম্মান দিয়েছেন। বিশেষত আশুরার দিনে রোজা ও ইবাদত-বন্দেগি করেছেন তাঁরা।

ইসলামবিষয়ক গবেষক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর