শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

কোন দিকে গড়াবে তিস্তার পানি

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

কোন দিকে গড়াবে তিস্তার পানি

প্রিয় পাঠক যখন এ লেখাটি পড়ছেন, তখন দেশের উত্তরাঞ্চলে তিস্তা নদীর পানি হয়তো বিপৎসীমা অতিক্রম করে দুই কূল ভাসিয়ে ছুঁতে চলেছে বঙ্গোপসাগরের দিকে। অথচ এই তিস্তাই আবার শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে বিস্তীর্ণ বালুচরে পরিণত হয়। একদিকে উজানের দেশ ভারত কর্তৃক বাঁধ সৃষ্টি করে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ, অন্যদিকে বাংলাদেশে নদীর তলদেশ ভরাট ও দুই পাশে বাঁধ না থাকায় পানি সংরক্ষণের ব্যর্থতা এই দুর্ভোগের জন্য দায়ী। এমন দুর্ভোগের বেড়াজাল মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছে চীন ও ভারত। বাংলাদেশ এখান থেকে কাকে নির্বাচন করবে আর কাকে করবে না, এমন প্রশ্ন এখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিকে তিস্তা নদীর পানির মতো বিপৎসীমার কাছাকাছি পৌঁছে দিয়েছে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।

সিঙ্গাপুরভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইসাস ইউসুফ ইসহাক ইনস্টিটিউট (আগের নাম ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আমেরিকা ও চীনের প্রভাব নিয়ে প্রতি বছর নানা ধরনের জরিপ ও গবেষণা করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির সাম্প্রতিক গবেষণা মতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৫০.৫% জনগণ আমেরিকার চেয়েও চীনকে বেশি পছন্দ করে। গত বছর এসব জনগণের ৩৮.৯ শতাংশ চীন এবং ৬১.১ শতাংশ আমেরিকাকে পছন্দ করলেও বর্তমানে তা কমে এ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে বেইজিং তথা চীন নিয়ে শঙ্কার কথাও ব্যক্ত করেছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ৭৫ থেকে ৮৭ শতাংশ মানুষ। চীনের প্রভাবকে স্বীকার করলেও ৬৭.৫ শতাংশ মানুষ চীনের ক্রমাগত অর্থনৈতিক আগ্রাসন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৫০ শতাংশেরও বেশি মানুষের মনে এমন ভীতি কাজ করে যে, চীন তার অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি ব্যবহার করে যে কোনো দেশে যে কোনো সময় জবরদস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।

রাজনীতির বহুমাত্রিক সমীকরণে বাংলাদেশ এখন ভারত, চীন ও আমেরিকার বিশেষ আগ্রহের ভূখণ্ডে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি বিশেষত সংসদ নির্বাচনে ভারতের ভূমিকা বা পছন্দ একটি নিয়ামক শক্তি বলে প্রকাশ্যে তর্কবিতর্ক নতুন কিছু নয়। অল্প দিনের ব্যবধানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীসহ উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দলের ভারত ভ্রমণ এবং বেশ কিছু সমঝোতা স্মারক সব সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তিস্তা প্রকল্পের বিষয়ে ভারতের আগ্রহ। তবে তিস্তা প্রকল্পের বিষয়ে নিকট অতীতে চীনের আগ্রহের কথা বেশ জোরেশোরেই আলোচনায় ছিল। চীনের বেশ কয়েকজন উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি তাদের ঢাকা সফরকালে এ বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। চীনা কারিগরি দলের কেউ কেউ তিস্তা নদী অববাহিকায় ভ্রমণ, পরিদর্শন ও জরিপ করেছেন বলেও জানা যায়। তাই তিস্তা নিয়ে ভারতের আগ্রহের বিপরীতে চীন বাংলাদেশকে কী বার্তা দিচ্ছে বা দিতে চলেছে, তা দেখার অপেক্ষায় অনুসন্ধানী চোখ।

এরই মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৮ জুলাই চীন সফরে যাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক ও ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলের রাজনীতি, অর্থনীতি ও নিরাপত্তাকেন্দ্রিক প্রকাশনা দি ডিপ্লোম্যাট ২২ মে ২০২৪ তারিখে একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, চীন ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তিস্তা নদীর তলদেশ গভীর হবে এবং নদীর দুই তীরে উঁচু বাঁধ নির্মিত হবে। এতে শুষ্ক মৌসুমে সংরক্ষিত পানি ব্যবহারের সুযোগ পাবে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষ। বর্ষার বন্যা থেকেও নদীকূলের মানুষকে রক্ষা করবে এমন প্রকল্প। তবে চীন নির্মোহভাবে বাংলাদেশের এমন উপকার করতে চায়, তা মনে করার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্য আর পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের মূল ভূখণ্ডের মাঝে একটি সরু ভূখণ্ড রয়েছে, যা শিলিগুড়ি করিডর বা চিকেন নেক নামে পরিচিত। প্রায় ২০-২২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই ভূখণ্ডের এক প্রান্তে বাংলাদেশ আর অন্য প্রান্তে নেপাল। এই করিডর দখল বা এখানে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হলে নানাভাবে অশান্ত হয়ে উঠবে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য। এমন স্পর্শকাতর একটি ভূখণ্ডের কাছেই প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প। তাই তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে এ অঞ্চলে চীন বা অন্য কোনো দেশের নাগরিকদের ব্যাপক উপস্থিতি ভারতের অপছন্দ হওয়াই স্বাভাবিক। উল্লেখ্য, পদ্মা সেতু নির্মাণ কিংবা মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরসহ বহু প্রকল্পে শত-সহস্র চীনা নাগরিক বিভিন্নভাবে যুক্ত হওয়ার বাস্তবতায় প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পের মতো ১ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পেও বিপুলসংখ্যক চীনা নাগরিকের এবং চীনা প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির মহাসমাবেশ ঘটবে বলে ধারণা করা যায়, যা ভারতের কাম্য হতে পারে না। অপ্রিয় হলেও সত্য, মালদ্বীপ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় ভারতের প্রভাব কমেছে এবং চীনের প্রভাব ক্রমাগত বেড়েছে। মিয়ানমারেও রয়েছে চীনের ব্যাপক প্রভাব। পাকিস্তান, নেপাল ও মিয়ানমারের সঙ্গে চীন ও ভারত, উভয় দেশের স্থলসীমা রয়েছে। দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার জলসীমায়ও চীনের প্রভাব সুস্পষ্ট। এমন এক প্রেক্ষাপটে শিলিগুড়ি করিডরের এক পাশে নেপাল কিংবা অন্য পাশে বাংলাদেশে চীনা আধিপত্য মেনে নেবে না ভারত। চীন সফলভাবে মিয়ানমার, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। অথচ চীনের অর্থায়নে কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপের একটি সমুদ্রবন্দর প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি ভারত চায়নি বলেই। (সূত্র : দি ডিপ্লোম্যাট ২১ জুলাই ২০২৩)। তাই অনেকের মনে প্রশ্ন, তবে এমন কিছু কি ঘটতে পারে তিস্তার ক্ষেত্রেও?

তিস্তা নদীর পানির উৎস ভারতে থাকায় শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ বা বর্ষায় বাঁধ খুলে বন্যা সৃষ্টির বিষয়টি ভারতের নিয়ন্ত্রণে। সুতরাং ভারতকে পাশ কাটিয়ে চীনের দিকে ঝুঁকলে বাংলাদেশ চীনের বিশাল ঋণের চাপে নিশ্চিতভাবে পড়লেও তিস্তার পানি কতটুকু পাবে তা অনিশ্চিত। আবার এটাও সত্য, ভারতে প্রবাহিত বেশ কিছু নদীর উৎস চীন ও চীন প্রভাবিত বিভিন্ন দেশে। ভারতের অন্যতম বৃহৎ নদ ব্রহ্মপুত্রের উজানে চীন ৩টি বাঁধ নির্মাণ করেছে। সুলেজ নদীর ওপর নির্মিত বাঁধ নিয়েও চীন-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক পানি গড়িয়েছে। (সূত্র : দি ইন্টারপ্রিটার ২১ নভেম্বর ২০২৩)। নেপাল থেকে ভারতে প্রবেশ করেছে ছোট-বড় ছয়টি নদী। (সূত্র : রিসার্চ গেট)। ভুটানের দুটি বড় নদী ও বেশ কিছু ছোট নদী প্রবেশ করেছে ভারতে। (সূত্র : দি হলিডিফাই)। ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে সীমারেখা টেনে দিয়েছে বিখ্যাত কালাদান নদী। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যেও রয়েছে ছয়টি অভিন্ন নদী। (সূত্র : দি ইনফিনিটি)। সুতরাং চীনের অর্থায়নে ও কারিগরি সহায়তায় তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে ভারত যদি বিরাগভাজন হয় ও পানি সরবরাহ এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, তবে চীনও পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার যথেষ্ট ক্ষমতা রাখে।

অন্যদিকে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও আমেরিকা মিলে গড়ে উঠেছে চীনবিরোধী নতুন কোয়াড। বাংলাদেশে চীনের প্রভাব টেনে ধরতে এ চারটি দেশই বাংলাদেশকে ভারতের সহায়তা নিতে উদ্বুদ্ধ করবে এবং চীনের সহায়তা গ্রহণে অনুৎসাহিত করবে। বিনিময়ে এ চারটি দেশ বাংলাদেশকে হয়তো আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাবও করবে। আর তাই যদি হয়, তবে চীন ভবিষ্যতে বাংলাদেশে তার বিনিয়োগ ও ঋণ বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তা-ও বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশ এখন কূটনৈতিক সম্পর্কের এক ক্রস রোডে দাঁড়িয়ে আছে বলা যায়। ভারত সফরের পর পর প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফর বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। সব দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ সঠিক পথে এগিয়ে যাক-এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর