শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

দুনিয়াতেও ইবাদতের প্রতিদান পাওয়া যায়

আল্লামা মাহ্‌মূদুল হাসান

হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্দেশ, আল্লাহর চাহিদা ও মর্জি মোতাবেক জীবনযাপন করেছেন। স্বীয় নফসের ইচ্ছা ও চাহিদার একদম মূল্যায়ন করেননি। এমনকি নিজের জানের চেয়ে প্রিয়, কলিজার টুকরা ইসমাইলকেও আল্লাহর নির্দেশে কোরবানি করার জন্য নিজের হাতে ছুরি চালিয়েছেন। আল্লাহপাক তার এই আনুগত্যের প্রতিদান দুনিয়াতেই দিয়েছেন। কিয়ামত পর্যন্ত তাঁকে অমর করে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। প্রতিদিন সারা দুনিয়ার লাখ-কোটি মানুষ একাধিকবার নামাজের মধ্যে দরুদে ইব্রাহিমে তাঁর নাম মুখে উচ্চারণ করে, তাঁর প্রতি সালাম নিবেদন করে এবং কিয়ামত পর্যন্ত এভাবে করতে থাকবে। তিনি যে নেক আমল করেছেন, আল্লাহর হুকুমে কোরবানি করেছেন, তার বিনিময় আল্লাহ দুনিয়াতেই তাঁকে দিচ্ছেন। এখানে আপনার আমার মনে হয়তো সংশয় জাগতে পারে যে, ‘এটা তো নবীদের ব্যাপার, অন্যদের এভাবে বিনিময় দেওয়া হবে না’। কিন্তু না, এর পরের আয়াতই আমাদের এ সংশয় দূর করে দেয়। আল্লাহ বলেছেন, ‘কর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।’

আমি আপনি যে কেউ (মুহসিন) হতে পারলে এরূপ দুনিয়াতেই প্রতিদান পাব। মুহসিন বলা হয় যার মধ্যে ইখলাস আছে। সে যা কিছু করে, একমাত্র আল্লাহকে রাজি করার জন্য, মালিকের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করে। দুনিয়াতে যুগে যুগে বহু ‘মুহসিন’ ছিলেন, যারা এ জগৎ ছেড়ে চলে গেলেও বিশ্ববাসীর কাছে অমর হয়ে আছেন। যেমন সাহাবি আবু বকর, ওমর, উসমান, আলী, ইবনে মাসউদ (রা.) প্রমুখ। তদরূপ আমাদের ইমাম আবু হানিফাসহ চার ইমাম (রহ.)। তাঁদের সবার প্রতি পৃথিবীর লাখ-কোটি মুসলিম ভক্তি নিবেদন করে, রহমতের দোয়া করে। আমাদের এই উপমহাদেশের কথাই ধরুন, ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী, আবদুল আযীয দেহলভী, রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী, কাসেম নানুতুবী, শায়খুল হাদিস হজরত যাকারিয়া, হযরত মাদানী রহ. সহ অগণিত উলামায়ে দেওবন্দ গত হয়েছেন, যারা অমর হয়ে আছেন। তাঁদের নাম আমরা কত ভক্তির সঙ্গে উচ্চারণ করি। নাম বলার পর তাঁদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করে বলি- কিংবা অথবা ইত্যাদি। বোঝা গেল, আল্লাহ এসব বুজুর্গদেরও ইব্রাহিম (আ.)-এর মতো দুনিয়াতেই তাঁদের নেক আমলের প্রতিদান দিচ্ছেন। এরকম যারাই এর যোগ্যতা অর্জন করেছে, হয়েছে, আল্লাহ তাদের প্রতিদান দিয়েছেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর এই নীতি বহাল থাকবে। অর্থ কী, তা পূর্বে বলেছি যে, যারা তারাই।

এর প্রমাণ সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.-এর বক্তব্যে রয়েছে। দীনের যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে সেরা জ্ঞানী সাহাবিদের একজন হলেন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)। তিনি এক আলোচনার মাঝে সাহাবিদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন- উল্লিখিত উক্তির মধ্যে আমাদের আলোচনার সঙ্গে সম্পর্কিত বাক্যটি হলো, মোল্লা আলী কারী (রহ.) স্বীয় গ্রন্থ মিরকাতে ওই বাক্যের অর্থ করেছেন- অর্থাৎ তাঁদের অন্তর হলো, ‘ইখলাস’ ও ‘ইহসান’ ওয়ালা অন্তর।

যাহোক ইব্রাহিম (আ.)-কে ‘আল্লাহপাক অমর করে রেখেছেন’ সে আলোচনা করছিলাম। আল্লাহতায়ালা এই প্রতিদান দেওয়ার একটি স্পষ্ট কারণও পরের আয়াতে বলছেন, (সে অবশ্যই আমার মুমিন বান্দার একজন) লক্ষ্য করুন, আল্লাহ কী ভাষা ব্যবহার করেছেন। এরকম বলতে পারতেন যে, (সে একজন মুমিন বান্দা।) কিন্তু এরূপ বললে তো আমাকে ও আপনাকে মাথায় হাত দিতে হতো। তাই আল্লাহ বলতে চাচ্ছেন যে, সে শুধু একা আমার আপনজন নয়, বরং আমার বহু আপনজনের মধ্যে সেও একজন। এর পরের আয়াতে আল্লাহপাক ইব্রাহিম (আ.)-কে দুনিয়াতেই প্রদত্ত আরেকটি নেয়ামত বা প্রতিদানের কথা উল্লেখ করেছেন। (আমি তাঁকে সুসংবাদ দিয়েছি ইসহাকের। সে সৎকর্মীদের মধ্য থেকে একজন নবী) সন্তান হওয়া যে কত বড় নেয়ামত তা সন্তানহীনরাই বুঝতে সক্ষম। একটা সন্তানের জন্য কত তাবিজ-কবজ, ওষুধ ইত্যাদি ব্যবহার করে! তবে সন্তানকামীদের বিভিন্ন উদ্দেশ্য থাকে। এক একজনের এক এক ধরনের উদ্দেশ্য। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য এই থাকা দরকার যে, আমার সন্তান দ্বারা রসুলের নেক উম্মত বৃদ্ধি পাবে। তাকে আমি সৎ ও চরিত্রবান, মুত্তাকি ও পরহেজগার করে গড়ে তুলব; যাতে দুনিয়া ও আখেরাতে সে আমার প্রভূত কল্যাণে আসে। আপনি যদি আপনার সন্তানকে দীনদার, ইলমওয়ালা না বানিয়ে, ফাসেক, ফাজের, আখেরাত থেকে গাফেল, আল্লাহর নাফরমান বানিয়ে রেখে যান, তাহলে সে যত পাপ করবে সব আপনার আমলনামায়ও যোগ হবে। কেয়ামত পর্যন্ত আপনার কবরে আজাব হতে থাকবে। আর কেয়ামতের পরের আজাব তো আছেই। যাদের পুরো পরিবার তথা সন্তানাদির সবাই দীনি ইলম ও আমল থেকে বঞ্চিত থাকে, তাদের চেয়ে অধিক দুর্ভাগা আর কাকে আপনি বলবেন?

পক্ষান্তরে যার পরিবারের সবাই দীনদার, ইলমের অধিকারী, পৃথিবীর সেরা পরিবার তারা। আজকাল তো শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি অর্থ ও ক্ষমতা। আপনাদের আমি কসম করে বলছি, আল্লাহর কাছে একজন অতি সাধারণ, এতিম হাফেজে কোরআনের যে মর্যাদা, দুনিয়ার সব ফাসেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সম্মিলিত মর্যাদা তার এক কণা পরিমাণও নয়। আপনার একটি ছেলে যদি হাফেব হয়ে যায়, তাহলে আপনার জান্নাত প্রায় নিশ্চিত। আর যদি সে মুত্তাকি আলেম হয়, তাহলে তো আপনাকে পায় কে? তাই বার্থ কন্ট্রোলের চক্করে না পড়ে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি নেক সন্তান চান। তাহলে তারা যত নেক আমল করবে, তা এমনিতেই চলে যাবে আপনার আমলনামায়। কবর, হাশর ও পরকালের জিন্দেগি হবে সুখময়। যেমনটি চেয়েছিলেন, হজরত ইব্রাহিম (আ.)। সন্তানহীনভাবে ৮০টি বছর শেষ হওয়ার পর আল্লাহপাক তাঁকে সর্বোচ্চ স্তরের নেক সন্তান তথা নবী সন্তান দান করেন। যার নাম ইসমাইল (আ.)। একটামাত্র সন্তান নিয়ে তো কোনো ভরসা নেই। যে কোনো সময় সে সন্তান মৃত্যুবরণ করলে পিতার কবরে সওয়াব পৌঁছানোর ব্যবস্থা শেষ। তাই ইব্রাহিম (আ.) দ্বিতীয় আরেকটি সন্তানের দরখাস্ত করলে আল্লাহপাক ইসহাক (আ.)-এর সুসংবাদ দিলেন এবং তাঁকেও আলা দরজার নেক বান্দা তথা নবীর মর্যাদায় ভূষিত করলেন। এরপর আল্লাহপাক স্বীয় অনুগ্রহের আরও কিছু বর্ণনা তুলে ধরেছেন- (তাঁকে ও ইসহাককে আমি বরকত দান করেছি) তাঁদের পর বনি ইসরাইলের সব নবী ইসহাক (আ.)-এর বংশধর। আর আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.) হলেন ইব্রাহিম (আ.)-এর বড় পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর বংশধর। অসংখ্য নবী যার বংশ থেকে হয়েছে, কেমন বরকতই না তিনি পেয়েছেন। তবে অতি দুঃখের বিষয়, তাদের দুজনের বংশের সব মানুষই নেককার হয়নি। কেউ তার প্রতিপালককে চিনেছে ও অনুগত হয়েছে, আর কেউ হয়েছে অবাধ্য ও নাফরমান। এ ইতিহাসই আল্লাহপাক পরের আয়াতে বর্ণনা করেছেন- (তাঁদের বংশধরদের মধ্যে কতক সৎকর্মী এবং কতক নিজেদের ওপর স্পষ্ট জুলুমকারী) এখানে আমাদের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে যে, নবীর বংশের লোকেরাই যদি নাফরমান হয়, আখেরাত থেকে গাফেল হয়, তাহলে আমাদের বংশের লোকদের কী হতে পারে। এরকম হওয়ার কারণ হলো, ইলম ও দাওয়াতের সিলসিলা জারি না থাকা। তাই আমাদের এ ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। আল্লাহপাক আমাদের দীনের ব্যাপারে পূর্ণ-হুঁশিয়ার করুন!

লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ

সর্বশেষ খবর