শনিবার, ৬ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

কফি হাউসের মান্না দে

ইমদাদুল হক মিলন

কফি হাউসের মান্না দে

গেন্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোডে মায়ের মামাবাড়ি। ঢাকায় আমার নানাবাড়ি বলতে ওটাই। বিক্রমপুরের মেদিনীমণ্ডল গ্রামে মায়ের বাপের বাড়ি। সেই বাড়িতে নানির কাছে ছেলেবেলার অনেকগুলো দিন কেটেছে। নানির কাছে থেকে পাশের গ্রাম কাজির পাগলার এ. টি ইনস্টিটিউশনে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছি। এ. টি হচ্ছে অভয় তালুকদারের সংক্ষেপ। তিনি ছিলেন এলাকার জমিদার। ১৩০ বছর আগে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ২০০৩ সালে এই স্কুলের শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে কলকাতা থেকে এসেছিলেন তালুকদার মহাশয়ের নাতনি বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী দিপালী নাগ। বৃদ্ধ বয়সেও তাঁর কণ্ঠের দিপ্তীতে অবাক হয়েছিলাম। বিক্রমপুরের গান-বাজনার ভালো চলছিল। যাত্রাপালা শরিয়তি মারফতি ইত্যাদি যেমন ছিল, পাশাপাশি ছিল আধুনিক হয়ে ওঠা মধ্যবিত্ত বাঙালির প্রিয় আধুনিক বাংলাগান। সচ্ছল বাড়িতে রেডিও ঢুকে গেছে। কোনো কোনো বাড়িতে আছে গ্রামোফোন। আমরা বলতাম ‘কলের গান’। পিতলের লম্বা চোঙাঅলা। ৭৮ আরপিএমের পাথর কেটে তৈরি করা ভারী ভারী রেকর্ড। রেকর্ড রাখার টিনের বাক্স, ছোট সুটকেসের মতো। পিনের বাক্সও ছিল সুন্দর। ওরকম পিনের খালি বাক্সের ভীষণ লোভ ছিল আমার। পুরো ছেলেবেলা কেটেছে একটা বাক্সের আশায়। জোগাড় করতে পারিনি।

আমার নানারা ছিলেন তিন ভাই। আমার নানা বড়। তাঁর সংসারে দুই মেয়ে। মেজনানা ছোটনানার ঘরে অনেক ছেলেমেয়ে। সেই বাড়িতে প্রথম রেডিও কিনলেন আমার বাবা। মারফি কোম্পানির রেডিও। রেডিও শোনার জন্য পাড়ার লোক ভিড় করত। উঠোনের মাঝখানে কাঠের চেয়ারের ওপর রেডিও, চারপাশে ভিড় করা মানুষজন। আমরা ছোটরা মুগ্ধ হয়ে রেডিওর দিকে তাকিয়ে আছি। আকাশবাণী কলকাতা, রেডিও পাকিস্তান ঢাকা, কী সুন্দর সুন্দর গান, যন্ত্রসংগীত খবর কথিকা নাটক।

১৯৬০ সালের শুরুর দিককার কথা। তখনো পর্যন্ত আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না, মানে গানের ভেতরকার বাণী সুর গায়কী কে কীভাবে গাইছেন ইত্যাদি বুঝে উঠতে পারছি না। শুধু শুনেই যাচ্ছি, শুধুই মুগ্ধ হচ্ছি। আকাশবাণী কলকাতায় ‘অনুরোধের আসর’ হয়। কত শিল্পীর কত মনমাতানো গান। আমরা দলবেঁধে অপেক্ষা করি কখন শুরু হবে ‘অনুরোধের আসর’। কখন শোনা যাবে শ্রোতাদের অনুরোধের গান। শুরুর দিকে একটু কম জনপ্রিয় শিল্পীদের গান। যেমন পিন্টু ভট্টাচার্য, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, বনশ্রী সেনগুপ্ত। ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তম শিল্পীদের দিকে যায় অনুষ্ঠান। আরতি মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, আশা ভোঁশলে, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, জগন্ময় মিত্র, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, প্রতীমা বন্দ্যোপাধ্যায়, মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, লতা মুঙ্গেশকর। কখনো কখনো অমল মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত গান ‘এই পৃথিবীতে সারাটি জীবন কী পেলাম বলো হায়’ অথবা ‘চুপ চুপ লক্ষ্মীটি শুনবে যদি গল্পটি’। অমল মুখোপাধ্যায় হচ্ছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ছোটভাই। কত সুন্দর সুন্দর গান তাঁর। ‘উড়ে যা উড়ে যা আকাশে, কাঞ্চন পিঞ্জিরা দিলাম খুলে’ ‘পদ্মদিঘীর ধারে ধারে’। সুরকার হিসেবেও অমল মুখোপাধ্যায় সার্থক। গীতা দত্তের কণ্ঠে তাঁর সুরকরা গান ‘এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়’ এত এত বছর পেরিয়ে এখনো জনপ্রিয়। এই প্রজন্মের শিল্পীরা গেয়ে আসর মাতান। পান্নালাল ভট্টাচার্যের জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা শ্যামাসংগীত ‘মা আমার সাধ না মিটিল’। এই গান আমরা সবাই প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের একটি গানের কথা মনে পড়ে ‘জলভর কাঞ্চনকন্যা জলে দিয়া মন’। ছেলেবেলায় শোনা সেই গান বহু বছর পর শুনেছিলাম সাতক্ষীরার পারুলিয়ায় গিয়ে। পারুলিয়ায় আমার বিখ্যাত বন্ধু আফজাল হোসেনের বাড়ি। আশির দশকের গোড়ার দিকে গেছি সেই বাড়িতে। আফজালের একমাত্র বোন রুমা গ্রামোফোনে প্রতিদিন ওই রেকর্ডটা চাপাত। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম, শুনতে শুনতে চলে যেতাম পেছনে ফেলে আসা সোনালি দিনে। পিন্টু ভট্টাচার্যের গান শুনলেই মনে হতো পাশের বাড়ির ছেলেটি নির্জন দুপুরে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করছে। ‘এক তাজমহল, হৃদয়ে তোমার আমি হারিয়ে গেলাম’ অথবা ‘চলো না দীঘার সৈকত ছাড়িয়ে’। বনশ্রী সেনগুপ্তের ‘হৃদয় আমার সুন্দর তব পায়’ কী জনপ্রিয় গান! তালাত মাহমুদের বাংলা গান ‘এই তো বেশ এই নদীর তীরে বসে গান শোনাই’ গানটির মধ্যে নদীজলের ছলাৎ ছলাৎ একটা শব্দ ছিল। সেই বয়সে যন্ত্রের ওইটুকু কারুকাজ আমাদের কাছে বিস্ময়কর। মোহাম্মদ রফির একটা আধুনিক বাংলা গানের কথা মনে আছে, ‘ওই দূর দিগন্ত পারে, যেথা আকাশ মাটিতে কানাকানি, তোমার আমার শুধু তেমনি করে জানাজানি’। তখনই সিনেমায় বিখ্যাত হয়েছেন আজকের হার্টথ্রব নায়ক প্রসেনজিতের বাবা বিশ্বজিৎ। বাংলা হিন্দি সিনেমার জগতে সুদর্শন নায়ক হিসেবে খ্যাতিমান। গানও করতেন তিনি। তাঁর জনপ্রিয় গান ছিল ‘যায় যায় দিন, বসে বসে দিন, জানি না এখন রাত কী বা দিন’। এ রকম আরও কত শিল্পীর কত গান, সব মনেও নেই এখন।

‘পাঁচমিশালী গানের অনুষ্ঠান’ নামে একটা অনুষ্ঠান হতো আকাশবাণীতে। সেই অনুষ্ঠানও পাগলের মতো শুনতাম আমরা। শচীনদেব বর্মণ আর তাঁর যোগ্য পুত্র রাহুলদেব বর্মণ, পিতা-পুত্র দুজনই বিখ্যাত। পিতা তখনই কিংবদন্তি, পুত্র ধীরে ধীরে পিতার পথে এগুচ্ছেন। শচীনকর্তার গানের মাহাত্ম্য, সুরের খেলা আর জাদুকরি কণ্ঠমাধুর্য তখনো ধরতে পারিনি। শুধু এটুকু বুঝি, তাঁর গান শুনলে হৃদয় তোলপাড় করে। মন অন্যরকম হয়ে যায়। কেন হয় সেই রহস্য ধরতে পারি না। ‘কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া, আমার ভাই ধনরে কইও নাইওর নিত আইয়া’ শুনলে ওই বয়সেই চোখের সামনে দেখতে পাই নদীতীরে শ্বশুরবাড়িতে বছর ধরে পড়ে আছে বাংলার এক বোন। নদীর দিকে তাকিয়ে মাঝিমল্লাদের কাছে সে অনুরোধ করে তার ভাইকে খবর দেওয়ার জন্য। এই বাড়িতে এসে বোনকে যেন সে নাইওর নিয়ে যায়। বছর খানেক ভাইয়ের বাড়িতে যাওয়া হয় না তার। পরবর্তী জীবনে শচীনদেব আমাদের প্রিয়তম শিল্পী হয়ে উঠেছেন।

এই লেখায় আমি শুধু বাংলা গানের কথাই বলছি, প্রসঙ্গক্রমে দুয়েকটি হিন্দি গানের উদাহরণ আসতে পারে। শচীনকর্তা আর রাহুলদেব বর্মণের হিন্দি গানের জগৎ মাতিয়ে দেওয়ার কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুরকার হিসেবে তাঁরা কিংবদন্তি। শচীনকর্তার কণ্ঠে ‘গাইড’ সিনেমায় একটুখানি ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে তু রামা’ একেবারেই অন্যরকম একটা তাৎপর্য দিয়েছিল। আর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে রাজেশ খান্না শর্মিলা ঠাকুরের ‘অমর প্রেম, ’ পরিচালক ঋষিকেশ মুখার্জি, শচীনকর্তা, ‘ও মাইয়া রে’ বলে যে একটুখানি টান দিয়েছিলেন, এখনো সেই সুর আমার হৃদয়ে। মনে আছে, আমি কেঁদেছিলাম। রাহুলদেব বর্মণের ‘মনে পড়ে রুবি রায়’ আমাদের কৈশোরকাল আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। সতীনাথের ‘জীবনে যদি দীপ জ্বালাতে নাহি পার’, ‘আকাশ এত মেঘলা যেও নাকো একলা’ এইসব গান কী করে ভুলি! অপরেশ লাহিড়ী, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, কত মহান শিল্পী প্রায় একই সময়ে এসেছিলেন বাংলা গানের জগতে। আব্বাসউদ্দিন, আব্দুল আলীম, ফেরদৌসী বেগম (পরে রহমান), ফরিদা ইয়াসমিন আরও পরে নিলুফার ইয়াসমিন, আব্দুল জব্বার, মাহমুদুন্নবী, রুনা, সাবিনা, শাহনাজ, কত শিল্পীর কথা বলব! সব মিলিয়ে বাংলা গানের রমরমা দিন ষাট সত্তরের দশক। প্রতীমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কত কত বিখ্যাত গান। ‘মনে আগুন জ্বলে, চোখে কেন জ্বলে না’ অথবা ‘একটা গান লিখো আমার জন্য’ অথবা ‘জলে ভাসা পদ্ম আমি’ অথবা ‘আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি’। আরতির ‘যদি আকাশ হতো আঁখি, তুমি হতে রাতের পাখি’। না, গানের কথা বলতে বলতে আমি আজ খেই হারিয়ে ফেলছি। মান্না দেকে নিয়ে লিখতে বসে কোথায়, কতদূরে চলে যাচ্ছি। তবু আর দুয়েকটা প্রসঙ্গ বলে মান্না দের দিকে যাই। মানবেন্দ্রর ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’ অথবা ‘ময়ূরকণ্ঠী রাতের নীলে’ অথবা ‘ভুলে গেছি কবে সেই পথে যেতে তুমি ছিলে মোর পাশে’। শ্যামল মিত্রের অজস্র জনপ্রিয়, ব্যাপক জনপ্রিয় গান। যেমন ‘ভ্রমরা ফুলের বনে’, ‘কার মঞ্জির বাজে’, ‘চোখের নজর কম হলে’, ‘তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা’, রমাপদ চৌধুরীর প্রথম দিককার উপন্যাস ‘দ্বীপের নাম টিয়ারং’-এর বিখ্যাত গান ‘আমি চান্দের সাম্পান’ শুনে শুনে আমাদের দিন কাটত। আহা কোথায় হারিয়ে গেল গানে গানে ভরে থাকা সোনালি বিকেলগুলো। আরও কয়েকজন বিখ্যাত শিল্পীর গানের কথা মনে পড়ছে। জগন্ময় মিত্রের ‘তুমি আজ কত দূরে’, সুবীর সেনের ‘এত সুর আর এত গান’, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কাজল নদীর জলে’, সুমন কল্যাণপুরের ‘মনে কর আমি নেই বসন্ত এসে গেছে’, নির্মলা মিশ্রের ‘ও তোতা পাখি রে’, ‘গীতা দত্তের ‘তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার’ অথবা ‘এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়’ কী যে বিখ্যাত হয়েছিল বলে শেষ করা যাবে না।

তখনকার দিনে সবচাইতে জনপ্রিয় সংগীত জুটি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সিনেমায় যেমন উত্তম-সুচিত্রা, গানে তেমন হেমন্ত-সন্ধ্যা। বাংলা গানের জগৎ ছেড়ে হেমন্ত এক সময় মুম্বাইয়ে, তখনকার বোম্বাইতে পাড়ি জমালেন। ‘নাগিন’, ‘ষোলাসাল’ ইত্যাদি সিনেমায় সুর করে, গান গেয়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে চলে গেলেন। নাগিনের মিউজিক আজ সত্তর পঁচাত্তর বছর ধরে সমান জনপ্রিয়। লতার ‘মেরা মান দোলে’র জনপ্রিয়তা একবিন্দুও ম্লান হয়নি। ‘ষোলাসাল’ সিনেমায় হেমন্তের ‘আয় আপনা দিল তো আওয়ারা’ সেই সময়কার সব শ্রেণির মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। আর আধুনিক বাংলা গানে হেমন্ত, হেমন্তের এক নীল আকাশ। স্নিগ্ধ স্বচ্ছ মায়াবি। তাঁর গানের শ’ খানেক উদাহরণ আমি এখনই দিতে পারি, যেগুলো জনপ্রিয়তায় আকাশ স্পর্শ করেছে। আমার ছেলেবেলা আচ্ছন্ন করে রেখেছিল হেমন্তের একটি গান ‘ছেলেবেলার গল্প শোনার দিনগুলো’। এখনো হেমন্তের যে কোনো গান আমাকে সেই ছেলেবেলার মতোই মুগ্ধ করে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়েরও স্মরণীয় গান প্রচুর। ‘মধু মালতী ডাকে আয়’, ‘চোখের জলে যদি হয় ছোট্ট নদী’, ‘জানি না ফুরাবে কবে এই পথ চাওয়া’। কী অসাধারণ মিষ্টি কণ্ঠ। শুনলে এই বয়সেও পাগল হয়ে যাই। আর বাংলা উপন্যাসের তিন সম্রাটের এক সম্রাট তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন অবিস্মরণীয় এক গান। সন্ধ্যার কণ্ঠে এই গান নিয়ে এলো পূর্ণিমা সন্ধ্যার স্নিগ্ধতা। ‘মধুর মধুর বংশী বাজে কোথা কোন কদমতলীতে’। শুনলে এখনো মনে হয় দূরের কোনো কদমতলা থেকে ভেসে আসছে মিষ্টি এক বাঁশির সুর।

মান্না দে-কে আবিষ্কার করতে আমার একটু সময় লেগেছিল। আকাশবাণী কলকাতার অনুরোধের আসরে তাঁর গান শুনতাম, মামাবাড়িতে গ্রামোফোন রেকর্ডে শুনতাম কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না কেমন লাগে তাঁর গান। একটু ওস্তাদি ঢং, কণ্ঠে একটু অন্যরকম কারুকাজ, একদম দরাজ, খোলা, গভীর পৌরুষমাখা কণ্ঠ। অন্য কারও সঙ্গে মেলে না। একেবারেই অন্যরকম। যতদূর মনে পড়ে, প্রথম তাঁর গান শুনলাম ‘তীরভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়, তারই মাঝে প্রেম যেন গড়ে খেলাঘর’। শুনতে শুনতে মুখস্থ করে ফেললাম। বন্ধুরা একসঙ্গে হলেই যে যার মতো করে গাই। সুর ঠিক হয় না, তাল ঠিকের তো প্রশ্নই ওঠে না। গেয়ে যাই যে যার মতো। গেন্ডারিয়াতে আমরা কয়েক বন্ধু তখন স্কুলের পর একসঙ্গে আড্ডা দিই। মুকুল মানবেন্দ্র বুলু সুভাষ বজলু ইসরাজুল হামিদুল বেলাল। শীতকালে মানবেন্দ্রদের পুরনোকালের বিশাল বাড়ির মাঠের মতো উঠোনে ব্যাডমিন্টন খেলি, পূর্ণিমা সন্ধ্যায় ওদের ছাদে বসে আড্ডা দিই। লেখাপড়া ফেলে চাঁদনি রাতে আড্ডা দেওয়া আমাদের প্রিয় অভ্যাস। কখনো বুলুদের পোস্তগোলার বাড়িতে চলে যাই। রেললাইনের ধারে খোলামেলা বাড়ি। চাঁদ দেখা যায় পরিষ্কার। আমরা আড্ডা দিই, গান গাই। মা-বাবা তেমন শাসন করেন না। গেন্ডারিয়া হাইস্কুলের এই দলটি ছাত্র হিসেবে ভালো। এক থেকে দশের মধ্যে এরাই। সুতরাং বাড়ি থেকে, স্যারদের কাছ থেকে এক্সট্রা আদর পাই। আড্ডায় বসলে মানবেন্দ্রর মা, বুলুর মা চা-নাশতা পাঠান। আমরা খাই, গল্প করি, যে যার মতো খালি গলায় গান করি।

মানবেন্দ্রর গানের ধারণা ভালো। বনেদি চক্রবর্তী পরিবারের ছেলে। সে আমাদের মান্না দের কথা বলে। মান্না দের বাংলা হিন্দি গানের কথা বলে। অন্য শিল্পীদের তুলনায় মান্না দে অনেক ঊর্ধ্বে এসব বলে। গানের উদাহরণ দেয়। মানবেন্দ্রর মুখেই প্রথম শুনলাম বাংলার চেয়েও হিন্দি গানের জগৎ তখন বেশি মাতাচ্ছেন মান্না দে। তালাত মাহমুদ, মোহাম্মদ রফি, মুকেশ, লতা মুঙ্গেশকর, শামসাদ বেগম, আশা ভোঁশলে, নূরজাহান, মহেন্দ্র কাপুর আরও পরে কিশোরকুমার এসব শিল্পীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি হিন্দি গানের জগৎ মাতাচ্ছেন। বাঙালি শুরু থেকেই হিন্দি গান আর সিনেমার জগৎ জয় করেছিল। শচীনদেব বর্মণ, অশোক কুমার, কিশোরকুমার, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ঋষিকেশ মুখার্জি, শক্তি সামন্ত, শর্মিলা ঠাকুর, জয়া ভাদুড়ি (পরে বচ্চন), রাখি, মিঠুন চক্রবর্তী, কুমার শানু এরকম প্রচুর উদাহরণ।

রাজকাপুরের ক্যামেরাম্যান ছিলেন রাধু কর্মকার। আমাদের বিক্রমপুরের লোক। গ্রামের নাম উয়ারি। পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। ছেলেবেলায় বিক্রমপুরের যে স্কুলে আমি পড়তাম সেই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। রাজকাপুর তাঁর আত্মজীবনীর একটি অংশ লিখেছিলেন ভারতের কোনো এক পত্রিকায়। পত্রিকার নাম মনে নেই। লেখাটা পড়েছিলাম গভীর আগ্রহ নিয়ে। সেই লেখায় তিনি রাধু কর্মকারের জন্মস্থান, স্কুল আর ছেলেবেলার কথা লিখেছিলেন। পড়ে শিহরিত হয়েছিলাম। আমাদের বিক্রমপুরের লোক রাধু কর্মকার! আমি যে স্কুলে পড়েছি সেই স্কুলের ছাত্র ছিলেন! বাঙালি মান্না দেও হিন্দি গানের জগৎ জয় করলেন প্রথম। বাংলা জয় করার আগে। কলকাতার বিখ্যাত প্রকাশন সংস্থা ‘আনন্দ পাবালিশার্স’ প্রকাশ করেছে মান্না দের আত্মজীবনী। ‘জীবনের জলসাঘরে’। ফ্ল্যাপে লেখা হয়েছে ‘একদিন উত্তর কলকাতার সিমলেপাড়ায় দুষ্টুমি করে ঘুরে বেড়াত যে কিশোর, কুস্তির আখড়ায় লড়াইয়ে নামত, সে কীভাবে যেন এক সময় সংগীতকে আপন করে নিল। সুধাসাগরের তীরে এসে দাঁড়াল সে। সেই প্রথম যৌবনে সংগীতই হয়ে উঠল তার একমাত্র সাধনা, নির্ভরযোগ্য সঙ্গী। আরও পরে তার ধ্যান-জ্ঞান প্রেম ঈশ্বর। সেদিনের সেই কিশোর আজকের ‘জাতীয় শিল্পী’ মান্না দে। বাড়ির সাংগীতিক পরিবেশ, বিশেষত প্রবাদপ্রতিম শিল্পী তথা তাঁর ছোট কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ও আশীর্বাদ এবং অন্যান্য বিশিষ্ট সুরসাধকদের সাহচর্য পেয়েছিলেন। সুদীর্ঘ ষাট বছরেরও বেশি সময় মান্না দে তাঁর সংগীত সাধনাকে অব্যাহত রেখেছেন অপরিসীম নিষ্ঠায়। আজ তিনি ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী। তাঁর কথা, তাঁর গানের কথা বলে শেষ হওয়ার নয়।’ আরেকদিককার ফ্ল্যাপে লেখা হয়েছে ‘মান্না দের জন্ম ১ মে ১৯১৯। শিক্ষা স্কটিশ চার্চ কলেজ ও বিদ্যাসাগর কলেজ। ১৯৩৭-এ কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দের কাছে সংগীত শিক্ষার শুরু। গায়করূপে প্রথম মঞ্চে (কলেজ ফাংশনে) আত্মপ্রকাশ ওই বছরেই। উস্তাদ দবীর খাঁ সাহেবের কাছে তালিম ১৯৩৯ থেকে। কৃষ্ণচন্দ্রর সহকারী হয়ে প্রথম মুম্বাই যাত্রা ’৪২-এ। শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম উস্তাদ আমন আলি খাঁ সাহেবের কাছে। প্রথম প্লে-ব্যাক ‘তমান্না’ ছবিতে ‘জগো আঈ উষা’। শচীনদেব বর্মণের সুরে ‘মশাল’ (১৯৫০) ছবিতে ‘উপর গগন বিশাল’ গানটি গেয়ে সাফল্য ও জনপ্রিয়তা। প্রথম বাংলা ছবিতে প্লে-ব্যাক ‘গৃহপ্রবেশ’-এ (১৯৫৪)। ‘শঙ্খবেলা’ ছবিতে উত্তমকুমারের লিপে প্রথম প্লে-ব্যাক ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’। নানা পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত। একাধিকবার পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ নেপথ্য গায়কের জাতীয় পুরস্কার, লতা মঙ্গেশকর পুরস্কার, শ্যামল মিত্র অ্যাওয়ার্ড, আনন্দলোক পুরস্কার, আলাউদ্দিন খাঁ পুরস্কার, পদ্মশ্রী খেতাব ইত্যাদি। ২০০৪-এ ‘জাতীয় গায়ক’-এর সম্মান লাভ। সহধর্মিণী সুলোচনা এবং দুই কন্যা সুরমা ও সুমিতা।’

যৌবনের শুরুতে মান্না দে হয়ে উঠলেন আমাদের প্রিয়সঙ্গী। প্রতিদিন তাঁর গান শুনি, প্রতিদিন নতুন করে মুগ্ধ হই। প্রেমে পড়ার বয়স এসে গেছে। পাড়ার সুন্দরী মেয়েটিকে দেখলে বুকের ভিতর গুনগুনিয়ে ওঠেন মান্না দে। ‘জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই, পাছে ভালোবেসে ফেল তাই দূরে দূরে রই’। আমার টুনুমামা অনুমামা মিনুখালা মান্না দের মহা ভক্ত হয়ে উঠেছেন। টুনুমামা পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে ঢুকেছেন। মিনুখালার বিয়ে হয়েছে বড়লোক পরিবারে। অনুমামা বিএ পড়েন। বেতন পেয়ে টুনুমামা কিনে আনেন মান্না দের রেকর্ড। হাতখরচের পয়সা বাঁচিয়ে অনুমামা কিনে আনেন। মিনুখালা খবর রাখেন পটুয়াটুলির রেকর্ডের দোকানে মান্না দের কোন নতুন রেকর্ড এলো। তিন দিক থেকে রেকর্ড সংগ্রহ। আমার নানাও গানপাগল মানুষ। যৌবনে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করতেন। আমার মামা-খালারা সবাই কমবেশি গান করেন, গানপাগল। বীণাখালার রবীন্দ্রসংগীতের সিডি বেরিয়েছে। আমরা কাছাকাছি বয়সের। নিজেরা দলবেঁধে ওই বাড়িতে গানের আসর করতাম। বাড়িতে নতুন রেকর্ড আসা মানে দুপুরের পর থেকে শুরু হতো গানশোনা। পুরনো গ্রামোফোনটা তো আছেই, তারপরও টুনুমামা তার বেতনের টাকা জমিয়ে তখনকার দিনে মাত্র বাজারে এসেছে এমন একটা সর্বাধুনিক গানের যন্ত্র ‘চেঞ্জার’ কিনে ফেললেন। একসঙ্গে ৬টা রেকর্ড চাপানো যায়। শূন্যে ঝুলে থাকে রেকর্ডগুলো। একটা শেষ হলে তার ওপর নামে আরেকটা। ততদিনের লংপ্লেয়িং এসে গেছে। একসঙ্গে ছয়টা লংপ্লেয়িং চাপালে দুপুরের পর থেকে শেষ বিকেল, সন্ধ্যা পর্যন্ত রেকর্ড বদলাতে হয় না। গান চলতেই থাকে। অন্যান্য শিল্পীর সঙ্গে মান্না দের গান শুনি আমরা। ‘কতদূরে আর নিয়ে যাবে বল’, ‘তুমি আর ডেক না, পিছু ডেক না’, ‘আমি চলে যাই।’ ‘তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়’, ‘চাঁদের আশায় নিভায়ে ছিলাম যে দীপ আপন হাতে’, ‘এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি’, ‘এ জীবনে যত ব্যথা পেয়েছি’, ‘আমি সাগরের বেলা, তুমি দুরন্ত ঢেউ, বারে বারে শুধু আঘাত করিয়া যাও’, ‘আমি নিরালায় বসে বেঁধেছি আমার জীবন বীণ’, ‘চার দেয়ালের মধ্যে নানান দৃশ্যকে’, ‘সেই তো আবার কাছে এলে’, ‘আবার হবে তো দেখা’, ‘এই তো সেদিন তুমি আমারে শুধালে’, ‘দরদি গো কী চেয়েছি আর কী বা পেলাম’, ‘আমি তার ঠিকানা রাখিনি, ছবিও আঁকিনি’, ‘কথায় কথায় যে রাত হয়ে যায়’, ‘কী কথা রইলো বাকি’। এই গানটি লিখেছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। সুর সুধীন দাসগুপ্ত। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মজীবনীর নাম ‘কথায় কথায় রাত হয়ে যায়’। কত আর উদাহরণ দেব! এ রকম দেড় দুশো গানের কথা বলতে পারব আমি। মান্না দের বেশির ভাগ গানই জনপ্রিয়। শুধু জনপ্রিয় বললে ভুল হবে, তুমুল জনপ্রিয়, অতুলনীয় জনপ্রিয়। অজস্র আধুনিক বাংলা গান গেয়েছেন তিনি, বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য গেয়েছেন, হিন্দি চলচ্চিত্রের জন্য গেয়েছেন হাজার খানেক গান। বহু চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক, বহু গানের সুর করেছেন। মুক্তি পায়নি এমন অনেক চলচ্চিত্রে রয়ে গেছে তাঁর গান। বাংলা নাটকে গান গেয়েছেন। গীত-গজল-ভজন গেয়েছেন, রবীন্দ্র সংগীত গেয়েছেন, মারাঠী চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেন, হিন্দি সিরিয়ালে গান গেয়েছেন, দ্বীজেন্দ্রগীতি, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, নজরুল সংগীত, শ্যামা সংগীত, গীতিনাট্যের গান, ছোটদের গান কোথায় নেই মান্না দে। সংগীতের এক বিশাল মহাদেশ তিনি। তাঁকে নিয়ে লিখে শেষ করা যাবে না। অনুমামা রেকর্ড কিনে আনলেন ‘রাধা চলেছে মুখটি ঘুরায়ে, কাঁদে শ্যামের বাঁশরি’। যখনই ওই বাড়িতে যাই, বীণাখালাকে বলি, ওই গানটা বাজা। বীণাখালা আমার বন্ধু। খালার চেয়ে বন্ধু হিসেবেই বেশি প্রিয়। আমার সব কথা রাখে সে। রেকর্ড চাপায়। মান্না দে তাঁর জাদুকরি কণ্ঠে গান করেন, আমরা শুনতে থাকি। দিনের মতো দিন কেটে যায়। মান্না দে কখনো পুরনো হন না, মান্না দে প্রতিদিন নতুন। মান্না দের গানে বাঙালি জাতির সোনালি বিকেলগুলো চিরকাল ভরে থাকবে, স্নিগ্ধ হয়ে থাকবে। এ রকম শিল্পী কখনো পুরনো হন না। এই প্রজন্মের কাছে তাঁর সবচাইতে প্রিয় গান ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই।’ এই গান শুনলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়দের কফি হাউসের আড্ডার কথা মনে পড়ে আমার। বুকটা হু হু করে। একটা কাল আলোকিত করে থাকা কত মানুষ চলে গেছেন। সেই সব আড্ডার দিন আর সোনালি বিকেলগুলো আজ আর নেই। কালের ওপর জমতে শুরু করেছে ধুলোকণা।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর