শনিবার, ৬ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

ব্রাহমা : সিদ্ধ না নিষিদ্ধ?

শাইখ সিরাজ

ব্রাহমা : সিদ্ধ না নিষিদ্ধ?

কথায় বলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ। দেশে সাম্প্রতিক সময়ে ছাগল বের করে নিয়ে এসেছে বিশাল বিশাল ব্রাহমা। সেই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে ব্রাহমা কি দেশে নিষিদ্ধ?

২০১৬ সালে ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে তুলে ধরেছিলাম বেলজিয়ামের একটি খামারের মাংসের গরু ‘বেলজিয়াম ব্লু’ নিয়ে প্রতিবেদন। প্রতিবেদনটি প্রচার হওয়ার পর বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানানো হয়, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা মাংসের গরু আমেরিকান জাত ‘ব্রাহমা’ নিয়ে কাজ করছে। বিস্তারিত জানতে আমি সাভারের বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে যাই। জানতে পারি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ‘বিফ ক্যাটল ডেভেলপমেন্ট’ প্রকল্পের মাধ্যমে ব্রাহমা জাত সম্প্রসারণ কার্যক্রম শুরু করেছে। প্রকল্প পরিচালক এম এ সামাদ বলেছিলেন, ২০০৮ সালে একটি পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে প্রথম ব্রাহমা নামের মাংসল জাতের ষাঁড়ের ফ্রোজেন সিমেন (হিমায়িত বীজ) আমদানি করে একটি শংকর মাংসল জাত সৃষ্টি করা হয়। এতে সফলতাও পাওয়া যায়। এরই ধারাবাহিকতায় গবাদিপশু উন্নয়নের কলেবর বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৩ সাল থেকে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ব্রাহমা জাতের গরুর সিমেন দিয়ে দেশি গাভীর মাধ্যমে ওই জাতের গরু পালন হবে। অনেক আগেই উপজেলা পর্যায়ে গাভি নির্বাচনের যাবতীয় কাজও সম্পাদন হয়েছে। ৩৮ জেলার ৮০টি উপজেলায় খামারি নির্বাচন করে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের বিনামূল্যে সিমেন দেওয়া হয়েছে। দুই বছরে ফলাফল আশাতীত।

ব্রাহমা জাতের গরু সম্পর্কে প্রকল্প পরিচালক বলেন, দেশি জাতের গরুর দৈহিক বৃদ্ধি প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম। কিন্তু মাংসল জাত ব্রাহমা গরুর দৈহিক বৃদ্ধি এক থেকে দেড় কেজি। ফলে বাণিজ্যিকভাবে এর পালন অনেক লাভজনক। এর মাধ্যমে মাংস উৎপাদনের পাশাপাশি আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দারিদ্র্যবিমোচন, সামাজিক উন্নয়ন ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ রয়েছে। এর আগে বাংলাদেশে কম বয়সে এত বেশি ওজনের মাংসল জাতীয় গরু উৎপাদন হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ব্রাহমা জাতের গরুর আদি আবাসস্থল ভারতীয় উপমহাদেশ। মূলত ভারতীয় তিন ধরনের গরুর উপজাত থেকে ব্রাহমা জাত তৈরি হয়েছে। ১৮৫৪ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত ভারত থেকে এ উপমহাদেশের বস ইনডিকাস জাতের ২৬৬টি ষাঁড় ও ২২টি গাভি সংগ্রহ করে জাত উন্নয়নের কাজ শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রে।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ক্যারাবিয়ান দ্বীপরাষ্ট্রগুলো প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর আরও অনেক দেশে এ গরু লালন-পালন হচ্ছে। বিএলআরআইয়ে গরুর শেডে আমি বিশ-ত্রিশটির মতো ব্রাহমা গরু দেখেছি। কোনটি প্রথম প্রজন্মের কোনটি দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের বলছিলেন সামাদ সাহেব। তিনি বলেন, ব্রাহমা জাতের গবাদিপশুর শরীরের আকার মাঝারি ধরনের হয়ে থাকে। জন্মের সময়ে বাচ্চার ওজন হয় ২৮ থেকে ৩৫ কেজি, যেখানে একটি সাধারণ গরুর বাছুরের ওজন হয় ১৫ থেকে ২০ কেজি। পূর্ণ বয়স্ক ব্রাহমা জাতের গাভীর ওজন ৪৫০ থেকে ৬৫০ কেজি। শিং সাধারণত ছোট আকৃতির হয়। গরুর গায়ে ছোট ও মোটা লোমযুক্ত চকচকে চামড়া থাকায় বেশ গরম সহ্য করতে পারে। এ জাতের গরু পরিবেশের তাপমাত্রার তারতম্যের সঙ্গে সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পারে। তাছাড়া খাদ্য সংকটের সময়ও খুব সাধারণ মানের খাদ্য খেয়ে দৈহিক বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে পারে। অন্যান্য জাতের চেয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন এর মাংসে চর্বির পরিমাণও কম।

তিনি আমাদের টাঙ্গাইলের সখীপুরে দুজন খামারির কাছেও নিয়ে যান; যারা ব্রাহমার সিমেন দিয়ে গরু উৎপাদন করেছেন। মনে আছে, আক্তার হোসেন নামের এক খামারি তার ব্রাহমা জাতের গরুটি দেখিয়ে বলছিলেন, এটির বয়স ১৭ মাস, ওজন ১০ মণ। অথচ এটা সাধারণ বাছুর হলে ১৭ মাসে ওজন হতো ২ থেকে ৩ মণ। এ ছাড়াও অন্য খামারিরা বলেন, এ জাতের গরু আসলেই দ্রুত বর্ধনশীল। আমি ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এর প্রতিবেদনে এসব তুলে ধরেছি। সঙ্গে সঙ্গে আমি খামারি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার মতো গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে কি না সেই প্রশ্নও তুলেছিলাম। তখন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলেছিলেন ‘বাংলাদেশের মাংস চাহিদা মেটাতে ব্রাহমার বিকল্প নেই।’ তারা জানিয়েছিলেন, প্রায় ৬ লাখ সিমেন তারা প্রস্তুত করে রেখেছেন ভবিষ্যতের জন্য। এর কিছুদিন পর জানা যায়, সরকারের কৃত্রিম প্রজনন নীতিমালার অধীনে বেসরকারিভাবে ও ব্যক্তি উদ্যোগে খামারিদের মাধ্যমে ব্রাহমা গরু আমদানি নিষিদ্ধ করে। কারণ হিসেবে বলা হয়- খামারিরা সরকারের কাছ থেকে সিমেন নিয়ে প্রজনন করছে। কিন্তু আমদানির অনুমতি পেলে খামারিরা ব্যাপক হারে ব্রাহমা গরু উৎপাদন করবে। কিন্তু ব্রাহমা জাতের গাভি তার আকৃতি অনুযায়ী দুধ দেয় না। এখন খামারিরা যদি ব্যাপক হারে ব্রাহমা পালন করে তাহলে দেশে গরুর দুধের উৎপাদন একেবারেই কমে যাবে। এ কারণে বেসরকারি পর্যায়ে ব্রাহমা গরু আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। সরকারের আশঙ্কা ব্যাপক হারে ব্রাহমা গরু লালন-পালন করলে হোলস্টেইন বা ফ্রিজিয়ান জাতের গরুর উৎপাদনে আগ্রহ হারাবে খামারিরা। এ জাতের গরু দুধের উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। দেশে দুগ্ধ উৎপাদন খাতকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্যই মূলত নিষিদ্ধ করা হয় ব্রাহমা জাতের গরু আমদানির।

২০২১ সালে ‘ব্রাহমা’ আবার খবরের শিরোনামে উঠে আসে, যখন ঢাকা কাস্টমস হাউস যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা ব্রাহমা জাতের ১৮টি গরু জব্দ করে। গরুগুলো টার্কিশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসে। সে সময় কাস্টমস হাউস সূত্রে জানা যায়, আমদানির পর বিল অব এন্ট্রিতে সব গরুর মূল্য ধরা হয়েছে ৪০ হাজার ডলার। তবে কাস্টমস কর্মকর্তারা ধারণা করছেন গরুগুলো প্রতিটির মূল্য ১২-১৫ লাখ টাকারও বেশি। কেউ সেই গরুগুলো নিতে আসেনি। সাধারণত আমদানিকৃত পণ্য বা মালামাল বিমানবন্দরের ওয়্যারহাউসে রাখা হয়। কিন্তু কোনো প্রাণী সেখানে রাখার ব্যবস্থা না থাকায় গরুগুলোকে সাময়িকভাবে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর পরের খবর আমরা সবাই জানি। ছাগলকাণ্ডে বের হয়েছে ব্রাহমা উপাখ্যান। সারা বিশ্বে ব্রাহমা জনপ্রিয় এবং মাংসের গরু হিসেবে লালন পালন করা হচ্ছে। আমাদের দেশে ২৫ কোটি টাকার উপরে নেওয়া একটি প্রকল্পের ফলাফল আট বছরেও আমরা কিছুই জানি না। সংশ্লিষ্টরা নিজেদের সীমাবদ্ধতা ঢাকার জন্য অন্যজনের দিকে আঙুল তুলছেন। আর আমার মনে প্রশ্ন জাগছে, প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে যে ব্রাহমা গরুগুলো দেখে এসেছিলাম সেগুলো কোথায় গেল? আর যে ৬ লাখ সিমেন তারা তৈরি করেছিলেন, সেগুলোর কী অবস্থা?

আমি যতদূর জানি ‘ব্রাহমা’ আমদানি নিষিদ্ধ কিন্তু ব্রাহমা লালনপালনে নিষেধাজ্ঞা নেই। কারণ সরকারের প্রাণিসম্পদ বিভাগই ব্রাহমা কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন। ব্রাহমার ফ্রোজেন সিমেন আমাদানিতেও নেই বিধিনিষেধ। যাই হোক শুধু ব্রাহমা নয় প্রাণিসম্পদ খাতে অনেক বড় বড় প্রকল্প পরিচালিত হয়েছে, হচ্ছে। প্রকল্প শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পের বিষয় ‘মাঠ পর্যায়’ থেকে হারিয়ে যায়। এমন উদাহরণ আমরা অনেক দেখেছি। দেশের প্রান্তিক খামারিদের হাতে আমাদের প্রাণিসম্পদ খাত অল্প অল্প করে তৈরি হয়েছে। নানা সংগ্রামের ভিতর তারা আশার স্বপ্ন বুনে চলেছে। যে খবরাখবর বের হয়ে আসছে তাতে বোঝা যাচ্ছে নানাজন নানাভাবে এ খাতটিকে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে তলিয়ে দেখতে হবে। সব অশুভ থেকে প্রকৃত খামারিদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের স্বার্থে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর