শনিবার, ৬ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

আম নিয়ে মজার কিছু কথা

আবদুল বাকী চৌধুরী নবাব

আম নিয়ে মজার কিছু কথা

আমের ভরা মৌসুম চলছে। আম গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে উৎপাদিত একটি ফল। ভারতের বিভিন্ন ধর্মীয় ও লোকজ অনুষ্ঠানে ব্যবহার্য ফলাদির মধ্যে আমের ব্যবহার সর্বাধিক। এসব অনুষ্ঠানের সঙ্গে আমের মতো অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক অন্য খুব কম ফলেরই রয়েছে। কথিত আছে, স্বয়ং গৌতম বুদ্ধকে একটি আম্রকানন উপহার দেওয়া হয়েছিল, যাতে তিনি এর ছায়ায় বিশ্রাম নিতে পারেন। প্রাচীনকালে নির্মিত ভারতের অজন্তা ইলোরার গুহাচিত্রে রয়েছে আম গাছের অপূর্ব দৃষ্টিনন্দন চিত্র। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ সালে মহাবীর আলেকজান্ডার সিন্ধু উপত্যকায় এসে সুদৃশ্য আমবাগান দেখে মুগ্ধ হন। আর ভারতবর্ষে পাল রাজাদের আমলে পণ্ডুবর্ধনভুক্তি ও শ্রীনগরভুক্তিতে আমের চাষ করা হতো। বিখ্যাত চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং ৬৩২ থেকে ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে ভারত উপমহাদেশে ভ্রমণে আসেন এবং তিনিই আম সর্বপ্রথম বহির্বিশ্বে পরিচিত করান। মুসলিম শাসনামলেও আম চাষ ও আমবাগান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সম্রাট বাবর তাঁর রাজত্বকালে আম ভারতের শ্রেষ্ঠ ফল বলে আখ্যায়িত করেন। মুঘল সম্রাট আকবর ভারতের লাখবাগের দারভাঙার সন্নিকটে প্রায় ১ লাখ আম গাছ রোপণ করেছিলেন। আর সেটিকে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম সুসংগঠিত আমবাগান বলে অভিহিত করা হয়। এক্ষেত্রে মুর্শিদাবাদের নবাবদের অবদান খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, আনুমানিক ১৭০০ সালে ব্রাজিলে প্রথম আম গাছ রোপণের আগ পর্যন্ত পশ্চিম গোলার্ধে আমের চাষ শুরু হয়নি। আর সম্ভবত সেখান থেকে এ ফল ওয়েস্ট ইন্ডিজে পৌঁছে ১৭৪০ সালের দিকে। যতদূর জানা যায়, তাতে প্রতীয়মান হয় স্প্যানিশ, ডাচ, ফ্রেন্স ও ইংরেজদের হাত ধরে ধীরে ধীরে আমেরিকা, মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সোমালিয়া, কেনিয়া ও ফিলিপাইনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিস্তার লাভ করে। অবশ্য আমেরিকার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে কিছু বুনো প্রজাতির আম জন্মে। বর্তমানে অনেক দেশেই আম উৎপাদন হলেও বেশি জন্মে ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, পাকিস্তান, মিসর, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া ইত্যাদি দেশে। আম গাছ বিভিন্ন কৃষি উপযোগী জলবায়ুতে জন্মাতে সক্ষম বলে বর্তমানে এটিকে পৃথিবীর প্রায় সব অঞ্চলেই পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে বেশ কিছুসংখ্যক উন্নত জাতের আম রয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই জন্মে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর ও সাতক্ষীরা এলাকায়। বাজারে এসব আমের চাহিদাই বেশি এবং এ জাতগুলো বাণিজ্যিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত জাতের আমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ফজলি, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, হিমসাগর, ক্ষীরশাপাতি, আশি^না, কিষানভোগ, কুয়াপাহাড়ি, লতা বোম্বাই, ফোরিয়া বোম্বাই, কোহিতুর, লক্ষণভোগ, মোহনভোগ, রানীপছন্দ, মিস্রিভোগ ইত্যাদি। প্রসঙ্গক্রম উল্লেখ্য, আম সব সময়ই ছিল রাজরাজাদের প্রিয় ফল, সে জন্য এর নাম নৃপপ্রিয়। ফজলি একটি জনপ্রিয় আম। মুঘল বাদশাহ আকবরের দরবারে এক বাইজি ছিলেন। নাম ছিল তার ফজল বিবি। বৃদ্ধ বয়সে ফজল বিবিকে বাদশাহ তাঁর আমবাগানের এক কোণে একটা ঘর তৈরি করে থাকতে দেন। আর ফজল বিবির ঘর ছিল একটি আম গাছের তলায়। সে গাছে বড় বড় আম ধরত। ফজল বিবি মারা যাওয়ার পর মানুষ ওই বড় বড় আমের নাম দেয় ফজলি আম। এখন আমরা যে ফজলি আম খাই, সেটা সেই আদি গাছের আম। তবে সময়ের বিবর্তনে এর আকার ও স্বাদে বেশ বৈচিত্র্য এসেছে। এজন্য এখন ফজলিরও অনেক উপজাত সৃষ্টি হয়েছে। যেমন-সুরমাই ফজলি, মালদা ফজলি, নাক ফজলি, কাল ফজলি ইত্যাদি। এদিকে প্রাচীন ভারতে আম্রপালি নামের এক নর্তকী ছিলেন। তার নামেও বিশেষ একটি জাতের আমের নাম রাখা হয়েছে ‘আম্রপালি’। আমের মধ্যে ছোট হলেও আম্রপালিই সবচেয়ে মিষ্টি। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কথা। প্রাচীন ভারতে বিহারের অন্তর্গত বৈশালী নামক সবার সমঅধিকার সংবলিত একটি গণতান্ত্রিক শহর ছিল। সেই শহরে বাস করতেন আম্রপালি। একদা মাহানামন নামে একজন জনদরদি ও উদার ব্যক্তি একটি আম গাছের নিচে শিশু আম্রপালিকে কুড়িয়ে পান। তিনি মা-বাবাহীন এই শিশুকে পিতৃ-মাতৃ স্নেহে পালন করতে থাকেন। কালের পরিক্রমায় সে দিনে দিনে বেড়ে ওঠে এবং ভরা যৌবনে পা দেয়। তখন এই অপসরা আম্রপালির রূপের কথা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশ-বিদেশের রাজপুত্রসহ রাজা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত পাগলপ্রায় হয়ে যান। সবাই বিয়ে করার জন্য এগিয়ে গেলে দ্বন্দ্ব, ঝগড়া ও ভীষণ বিবাদের কথা একের পর এক আসতে থাকে। বলতে গেলে বৈশালী শহরে এটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তখন এ সমস্যা সমাধানের জন্য সেখানের ক্ষমতাধর, ধনবান ও জ্ঞানী-গুণীরা বসে এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেন, বৈশালী একটি গণতান্ত্রিক শহর। আর এখানে সবার সমান অধিকার। কেউ আম্রপালিকে একা বিয়ে করতে পারবেন না। আম্রপালির রূপ-যৌবনের ওপর সবার সমান অধিকার আছে বিধায় তিনি হবেন নগরবধূ তথা সবার বধূ; এক কথায় পতিতা। শিশু আম্রপালিকে যে জাতের আম গাছের নিচে কুড়িয়ে পাওয়া যায়, সেই গাছের আমের নাম আম্রপালি। এখানে একটি কথা থেকে যায়, যা হলো যেহেতু তাকে আম গাছের নিচে পাওয়া গেছে, তাই তার নামকরণ করা হয়েছে, ‘আম্রপালি’। আর সংস্কৃতিতে ‘আম্র’ মানে ‘আম’ এবং পল্লব হলো ‘পাতা’।

লেখক : প্রাবন্ধিক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর