মৃত্যুর মিছিলের যেন শেষ নেই। আর এখন তো সময় হয়েই গেছে আমাদের চলে যাওয়ার। সেই কবে ’৭৫ আর আজ ২০২৪। এত বছর পর ক’দিনই-বা বেঁচে থাকি। আর তখনো আমাদের অনেকের ২০-৩০-৪০-৫০ বছর বয়স ছিল। তাই স্বাভাবিক নিয়মেই আমাদের চলে যাওয়ার কথা, যাচ্ছিও তাই। গত পরশু অধ্যাপক সুজিত চক্রবর্তী আমাদের মায়া কাটিয়ে চলে গেছে। সুজিত চক্রবর্তী পরলোক গমনের খবরও পেয়েছিলাম হঠাৎ করে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলের পথে। নেত্রকোনার জজ মিয়া ফোন করেছিল, সেই সঙ্গে সুকুমার আরও কে কে যেন। পঁচাত্তরের প্রতিরোধযুদ্ধে অধ্যাপক সুজিত চক্রবর্তী এবং অধ্যাপক দিলীপ ধর গৌরীপুর কলেজে পড়াত। সেখান থেকেই শরিক হয়েছিল পঁচাত্তরের প্রতিরোধযুদ্ধে। মারাত্মক সমাজ সচেতন মানুষ। তাকে সামাল দেওয়া খুব সহজ ছিল না। প্রচন্ড সংগ্রামী। যা বুঝত যা চিন্তা করত কামানের সামনে দাঁড়িয়েও বলতে পারত এবং কখনো-সখনো বলতও। তাকে সামাল দিতে ভীষণ কষ্ট হয়েছে। কিন্তু কেন যেন আমার ওপর তার প্রচন্ড ভরসা ছিল। আমিও তাকে একজন নিবেদিতসংগ্রামী হিসেবে সব সময় বিশ্বাস করতাম। শেষ দিন পর্যন্ত সে বিশ্বাসের কোনো চিড় ধরেনি। একবার গৌরীপুরে কী এক সমস্যা নিয়ে সুজিত চক্রবর্তী অনশন করেছিল। ঢাকা থেকে রাত ৩টায় রওনা হয়ে সকাল ৬টায় চার দিন পর অনশন ভেঙেছিলাম। সেই সুজিত চক্রবর্তী আমাদের মায়া কাটিয়ে চলে গেল। তার বিপুল সম্পত্তি থাকতেও সব ছেড়েছুড়ে ফেলেফুলে হালুয়াঘাটের কাছে তারাকান্দায় শামসুল হকের প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু কলেজের অধ্যক্ষ ছিল। কর্মরত অবস্থায়ই সে আমাদের মায়া কাটিয়ে চলে গেল। এমনি কত প্রতিরোধযোদ্ধা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করতে গিয়ে দুষ্কৃতকারীর আখ্যা মাথায় নিয়ে চলে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত আমাকেও হয়তো যেতে হবে। এখন আর ওসব নিয়ে ভাবি না। কারণ দেশ-সমাজ সব কেমন যেন একটা লাগামহীন হয়ে গেছে। আল্লাহ তাকে ভালো রাখুন এই কামনাই করি।
বন্যায় চারদিক বিভীষিকাময়। মানুষ পানিতে ভাসছে। ’৬২ সালে মির্জাপুরের বরাটি নরদানা পাকিস্তান হাইস্কুলের ছাত্র হিসেবে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাকুল্যায় নেমে গলাপানি মাড়িয়ে টাঙ্গাইল এসেছিলাম। বাড়িতে তখন গলা-সমান পানি। কী যে কষ্ট, লেখার ভাষা নেই। তাই যখনই যেখানে বানভাসি মানুষের কষ্ট দেখি, পত্রিকায় পড়ি বুকের ভিতর তোলপাড় করে। পাশে দাঁড়াতে না পারলে আরও কষ্ট হয়। বাংলাদেশের সড়কপথ- এ যেন জল্লাদের কারখানা। সড়কপথের হত্যা থামাবার কারও কোনো আগ্রহ বা ইচ্ছে আছে বলে মনে হয় না। অন্যদিকে শিক্ষকরা কর্মবিরতি করছেন। কেউ তাদের দিকে ফিরেও দেখছে না। শিক্ষকদের কর্মবিরতি মোটেই অন্যায্য নয়। ভবিষ্যতে বর্তমান পন্ডিতদের অনেক অন্যায্য সিদ্ধান্ত বুমেরাং হবে, বৈষম্য সৃষ্টি করবে। সেজন্য আন্দোলন। জেদ ছেড়ে খোলা মনে একটু বসলেই একটু আলোচনা করলেই সহজে সমাধান হতে পারে। কিন্তু সেদিকে কারও খেয়াল নেই। ছাত্রছাত্রীরা কোটাবিরোধী আন্দোলন করছে। আলোচনা করে দেখা যেতে পারত। মুক্তিযুদ্ধকে, স্বাধীনতাকে সম্মান ও মূল্যায়ন করতে হলে যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা থাকা অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু তা ৩০ শতাংশ কেন? ২৫, ২০, হোক-না ১৫ শতাংশ। কিন্তু এখন যেমন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ নিয়ে কিছু কিছু যুবক কোটাবিরোধীদের রাজাকার বলছে, আবার কোটাবিরোধীরা দেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করতে চলেছে এর কোনোটাই ভালো নয়। একটু সহনশীল হলে খুব সহজেই এসব সমস্যার সমাধান করা যায়। কিন্তু কারও কোনো আগ্রহ নেই। বর্তমান প্রধান বিচারপতি নেত্রকোনার মানুষ। তিনি যখন ছোট ছিলেন তার বাবা আখলাকুল হোসাইন আহমেদ এমপি ও আমরা একসঙ্গে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়েছি। এমন নির্লোভ মানুষ খুব কম দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে তিনি যে কষ্ট করেছেন তা তুলনাহীন। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, কোনো আন্দোলনে বিচারের রায় বদল হয় না। কথাটা মোটেই অযৌক্তিক নয়। কিন্তু আন্দোলনেরও তো একটা অর্থ থাকে। এটাও তো আমাদের ভেবে দেখতে হবে। তাই কোনোভাবেই কোনো শান্তি পাচ্ছি না। এবারই বোধহয় প্রথম এক মাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন হাসিনা দুবার ভারতে গেছেন। নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ১০টি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছেন। সমঝোতা আর চুক্তি কিন্তু আভিধানিক অর্থে এক নয়। ভালোভাবে সেগুলো প্রচার এবং প্রকাশও হয়নি। করিডর আর রেল সংযোগ এক কথা না। আর বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে ভারতের রেল সংযোগ নেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী দেশ বিক্রি করে দিয়েছেন-এটা সত্য নয়। পৃথিবীর বহু দেশে এক দেশের রেল আরেক দেশের ভিতর দিয়ে যাতায়াত করে। তাতে তাদের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হয় না। কোনো দেশের ভিতর দিয়ে অন্য দেশের গাড়ি যাওয়া-আসায় সার্বভৌমত্বের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না। আমার বাবার এক বন্ধু অবিনাশ কাকা ছিলেন খুবই কালো। মাঝেসাজে বাবাকে বলতেন, ‘আব্দুল আলী, আব্দুল আলী, আমি কালো হলে কী হবে, আমার রং খুব পাকা।’ ঠিক তেমনি একটি দেশের সার্বভৌমত্ব কচুপাতার পানি না যে, ঝাড়া দিলেই পড়ে যাবে। তবে এটা ঠিক, আমরা রেল সংযোগ দিলে ভারত কী দিচ্ছে। আমাদের দরকষাকষি কোথায়? ফারাক্কা, তিস্তাতে আমরা কী পেলাম? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তার রাজনৈতিক স্বার্থে অনেক কিছু বলতে পারেন, করতে পারেন। তাতে আমাদের কী? পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আমাদের চুক্তি না। তিস্তা, ফারাক্কাসহ সব পানির চুক্তি কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে। বিষয়টা কেন যেন আমরা তলিয়ে দেখি না। প্রায় ৪০-৪৫ বছর ধরে মিয়ানমার থেকে কলকাতায় গ্যাস নেওয়ার একটা আলোচনা চলছে। একসময় এমন আলোচনাও হয়েছিল, আমাদের ভূখ- কম। যত্রতত্র এরকম লাইন দিলে আমাদের কৃষিজমি কমে যাবে, আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। সে কারণে ভারতের তরফ থেকে প্রস্তাব এসেছিল, মিয়ানমার থেকে গ্যাসলাইন নিতে যতটুকু জমি যাবে তাতে যতটুকু ফসল ফলতে পারত বা পারে সে ফসল ভারত ১০০ বছর বাংলাদেশকে দেবে। গ্যাসলাইন রক্ষণাবেক্ষণ বাংলাদেশ করবে। সে রাজস্ব বাংলাদেশ পাবে। আমাদের পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাসের অভাব। পূর্বাঞ্চল থেকে একই লাইনে গ্যাস তুলে দিয়ে আমরা পশ্চিমাঞ্চল থেকে নামিয়ে নিতে পারব। এ সমস্ত নানা সুবিধা থাকার পরও সেই চুক্তি বাস্তবের মুখ দেখেনি। একসময় যখন পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগরতলা সড়ক যোগাযোগের জন্য ভারত অনুরোধ করেছিল। তখন বিএনপির অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ছয় মাস ভারতের গাড়ি চললে আমাদের রাস্তাঘাট একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের ভিতর দিয়ে রেল যাওয়ায় কত কী খাজনা ট্যাক্স টোল পাব জানি না। কিছু একটা উল্লেখ করার মতো টোল পাওয়ার কথা। ঠিক আছে দেখা যাক দেশবাসীর জন্য সরকার কতটা কী আদায় করতে পারে। তবে আগেই বলেছিলাম, আমরা যত ফুটানিই করি চিন্তা-ভাবনা করে কাজ করি না। যেদিন থেকে ভারতীয় রেল আমাদের ওপর দিয়ে যাতায়াত শুরু করবে তখন ঢাকা শহরের মতো পদ্মা সেতুতে রেলজট সৃষ্টি হবে। ওদিকে যশোর-খুলনা, এদিকে পদ্মা থেকে কুমিল্লা। দেখবেন আজ থেকে পাঁচ বছর পর চাঁড়ালের কথা বাসি হলে ফলে। পদ্মা সেতু আমাদের জন্য এক অভাবনীয় সম্পদ। কিন্তু এই সেতুতে শুধু এক লাইন রেলপথ ভবিষ্যতে বুমেরাং হবে। ভবিষ্যতে কেন, অল্প দিনের মধ্যেই আমাদের বুক চিড়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে রেল ও সড়কপথ যাবে তখন শ্বাস ফেলার উপায় থাকবে না। কারণ শুধু পদ্মা সেতুটুকু পার হতেই একটা রেল বা একটা গাড়ির ৭-৮ মিনিট সময় দরকার। সেতুতে উঠতে ৪-৫ মিনিট, সেতু পার হয়ে ৪-৫ মিনিট এ সময়টুকু তো দিতেই হবে। যাক এখন পন্ডিতের রাজত্ব, পন্ডিতরা যা ভাবে প্রধানমন্ত্রী বোনকে যা বোঝায় তাই হয়। তা হোক।
লেখক : রাজনীতিক
www.ksjleague.com