শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৯ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

তিস্তা নিয়ে মমতার আপত্তির কারণ কী?

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

তিস্তা নিয়ে মমতার আপত্তির কারণ কী?

বিগত শতকের ৬-এর দশকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যখন দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, তখন রাওয়ালপিন্ডি থেকে আইয়ুব খান ভারতের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলাকে তছনছ করার জন্য ফারাক্কা বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা সামনে নিয়ে আসে। আর এতদিন পর দেখা যাচ্ছে, আইয়ুব যে মেজাজে উসকানি দিয়েছিল পূর্ববাংলার সাম্প্রদায়িক শক্তিকে, সেই একই পদ্ধতিতে দুই দেশের মধ্যে নদীর পানি নিয়ে ভারতের অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অহরহ বাংলাদেশকে শুধু আক্রমণই করছেন না, বিরোধিতাও করছেন। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে এক যুগ ধরে মমতা তার জেদ বজায় রেখে চলেছেন। মমতা হয়তো জানেন না, পানির এই সুষম বণ্টনের অভাবে নদীমাতৃক পূর্ববাংলার একটার পর একটা খাল-নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী- নদীর উৎস যে দেশে তারা যেমন পানি পাবে তেমন ভাটি এলাকা বা আর নিচের দিকের দেশগুলোকে পানি অবশ্যই দিতে হবে। মমতা কেন কিছু বুঝতে চাইছেন না? সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই দিনের সফরে দিল্লি এসেছিলেন। এই সফরে তিনি দিল্লি ও ঢাকায় সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, উভয় দেশের মধ্যে যে সম্পর্ক ’৭১ সালে স্থাপিত হয়েছিল তার মর্যাদা ভারত এখনো দিচ্ছে। আশা করি, ভবিষ্যতেও দেবে।

তিনি দিল্লির সঙ্গে ১০ দফা চুক্তি ও সমঝোতা করে গেছেন। এই চুক্তির মধ্যে আছে দুই দেশের অভিন্ন নদী তিস্তা নিয়েও কিছু কথা। তিস্তার বাংলাদেশ অংশে বাঁধ দিয়ে জল ধরে রাখা হবে এবং শুষ্ক মৌসুমে সেই জল চাষের জন্য ব্যবহার করা হবে। ১২ বছর আগে তিস্তা চুক্তি করার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী উত্তর-পূর্ব সীমান্তের সাতজন মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় গিয়েছিলেন। কিন্তু মমতা তার সঙ্গে যাননি।

তখনই অভিযোগ ওঠে, বিএনপি-জামায়াত এবং তৃণমূলের মধ্যে অলিখিত চুক্তি আছে। এমনকি সেই চুক্তির আগে খালেদা জিয়ার আমলের এক সাবেক মন্ত্রী খুব গোপনে কলকাতায় এসেছিলেন। ২০১৪-এ বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে মমতার এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী কলকাতার এক টিভি চ্যানেলে বলেছিলেন, আমরা বাংলাদেশকে পানি দেব শেখ হাসিনাকে জেতানোর জন্য। দিল্লির সঙ্গে শেখ হাসিনার যে চুক্তি হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে ওই বাঁধ নির্মাণের জন্য ভারত বাংলাদেশকে ১ বিলিয়ন ডলার অল্প সুদে সাহায্য দেবে। চীন বহু আগে থেকে বাংলাদেশকে ওই সাহায্যের প্রস্তাব দিয়ে আসছিল। শেখ হাসিনা চীনের প্রস্তাব গ্রহণ করেননি।

আইয়ুবের আমলে ভারত সরকারকে অনুরোধ জানাতে তিনি তিন সদস্যের একটি দলকে পাঠিয়েছিলেন ফারাক্কায়। তার প্রধান ছিলেন দিনাজপুরের বি এন আব্বাস। তখন ফারাক্কার জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন দেবেশ মুখার্জি। দেবেশ আর আব্বাস বিংশ শতাব্দীর তিনের দশকে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তেন। তারা রুমমেটও ছিলেন। বি এন আব্বাস ফিরে গিয়ে আইয়ুবকে রিপোর্ট দেন। আইয়ুব তার রিপোর্ট অনুযায়ী আবার ভারতকে আক্রমণ করে বিবৃতি দেয়। ঠিক এখন যেমন মমতা করে চলেছেন। শেখ হাসিনার এই সফরে ফারাক্কা থেকে বর্তমানে যে পানি বাংলাদেশে যাচ্ছে, তার মেয়াদ নিয়ে তিনি মোদির সঙ্গে কথা বলেছেন। সেই খবর প্রকাশের পর মমতা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছেন। তাকে বাদ দিয়ে কথা বলা হলো?

১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা তাঁর সেচমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাককে দিল্লিতে পাঠিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু তখন অসুস্থ হয়ে দিল্লিতে অবস্থান করছিলেন। হাসিনার চিঠি নিয়ে রাজ্জাক সাহেব তাঁর সঙ্গে দেখা করে গঙ্গার পানি বণ্টনের প্রস্তাব দেন। জ্যোতি বসু তাকে বলেছিলেন- এ বিষয়ে আমরা তো দিল্লিকে আমাদের সম্মতি জানিয়ে চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছি। তবে মালদার বরকত গনি খান চৌধুরীকে ছাড়া এ কাজ করা সম্ভব হবে না। আপনারা কলকাতায় গিয়ে সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত এবং কংগ্রেস নেতা সৌমেন মিত্রের সঙ্গে দেখা করুন।

সেই মতো রাজ্জাক সাহেব কলকাতায় এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করে বলেন, দিল্লি থেকে জ্যোতি বাবু আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে বলেছেন। কিন্তু সে সময় বরকত-গনি খান চৌধুরী মালদায় অবস্থান করছিলেন। আমি আর সৌমেন রাজ্জাক সাহেবকে নিয়ে পরদিন মালদায় গেলাম। কোতোয়ালিতে পৌঁছে দেখি বরকত দা প্রায় শ-দুয়েক লোককে নিয়ে বসে তাদের অভাব-অভিযোগ শুনছেন। আমাদের দেখেই চিৎকার করে উঠলেন, কেন তাকে না জানিয়ে আমরা মালদায় গেছি। আমরা তাকে তার শোবার ঘরে নিয়ে যাই। সেখানে গিয়ে জ্যোতি বাবুর কথা তাকে জানাই। তিনি তখনই বললেন, আমাকে কী করতে হবে বলুন। আমরা তার লেটার হেডে সম্মতিসূচক চিঠি পাঠিয়ে তখনই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়া এবং দিল্লির বঙ্গভবনে জ্যোতি বসুর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তার কয়েকদিনের মধ্যে শেখ হাসিনা দিল্লিতে আসেন এবং ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে ৩০ বছরের চুক্তি হয়। ভারত সরকারের পক্ষে এই চুক্তির খসড়া তৈরি করেছিলেন জে এন দীক্ষিত। তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার পদে কর্তব্যরত ছিলেন।

আমি এ ঘটনা ভুলে গিয়েছিলাম। কয়েক বছর আগে ঢাকায় তোফায়েল আহমেদ এ ঘটনার কথা বলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এত কথা কী করে জানলেন। তোফায়েল ভাই বলেছিলেন, সে সময় ভারত সফর সেরে আবদুর রাজ্জাক ক্যাবিনেটে গোটা ঘটনা রিপোর্ট করেছিলেন। সেখানেই তিনি জানতে পেরেছিলেন।  আবদুর রাজ্জাক ভাই এখন নেই। দীর্ঘদিন দিল্লির হাসপাতালে থাকার সময় একবার আমাকে বলেছিলেন, লন্ডনে চিকিৎসা করাতে যাব। একবার আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। আমি দিল্লি গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম।

গত কয়েক বছরে বিহার এবং উত্তরপ্রদেশ খাল কেটে কিছু পানি নিয়ে গেছে। ফলে ফারাক্কায় এখন পানির টান পড়েছে। বর্তমানে যে চুক্তি বহাল আছে সেই চুক্তির বিষয়ে উভয় দেশ গত ২৮ বছর ধরে কেউ কোনো কথা বলেনি। এখন সেই চুক্তি নিয়ে মমতা হঠাৎ কেন আইয়ুবের মেজাজ দেখাচ্ছেন, সেটাই রহস্য। শেখ হাসিনার ভারত সফর সম্পূর্ণ সফল। তার এই সফর নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস এবং বামপন্থিরা খুবই খুশি। হাসিনার এই সফর প্রমাণ করে দিল, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে সম্পর্ক ইন্দিরা ও বঙ্গবন্ধু তৈরি করে দিয়েছিলেন, সরকার বদল হলেও সেই সম্পর্কে আদৌ ভাটা পড়েনি।

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর