বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

একটি সোয়েটার এবং মাকে লেখা একটি চিঠি

অধ্যাপক জীবেন রায়

একটি সোয়েটার এবং মাকে লেখা একটি চিঠি

আমরা কখন সাধারণত চিঠি লিখি? খুব আনন্দে থাকলে অথবা মনঃকষ্টে থাকলে। তাছাড়া প্রেমে পড়লে কিংবা প্রেম চলাকালীন প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে চিঠি আদান-প্রদান হয়। প্রায় দুই দশক আগে থেকেই চিঠি লেখার অভ্যাসটা অবশ্য পাল্টে গেছে। মোবাইল ফোন, ফেসবুক, ওয়াটসঅ্যাপ, টেক্সটিং এবং স্কাইপের জামানায় চিঠি লেখা তো উঠেই গেছে। এমনকী ইমেইলের ব্যবহারও কমে গেছে।

আমি যখনকার কথা বলছি, ১৯৭৯ এবং পরবর্তী সময়ের কথা। আমি ১৯৭৯ সালে কানাডার সাসকাটুনে পিএইচডি করতে আসার পর থেকে মাকে চিঠি লিখতাম। মা-ই তো আমার একমাত্র শিকড়; তখনো বেঁচেছিলেন। আমার মা সাত-সাতটি সন্তান গর্ভে ধারণ করেছিলেন। আর আমাকে তো অনেক বয়সকালে। নিশ্চয় অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। আমি জানি না কোনো দাঈ এসেছিল কি না? কার কী মন্তব্য ছিল? কী ফুটফুটে ফর্সা ছেলে হয়েছে গো। পাঁচবার উলুধ্বনি দাও। আমি শতভাগ নিশ্চিত যে, আমাকে বাড়িরই চাকভাঙা মধু খাওয়ানো হয়েছিল। কোন চামচে? না না কোনো গোল্ড চামচ অবশ্যই নয়। নিশ্চয় তখন মার বুকের দুধ ততটা ছিল না। আমি জানি আমার মা দুধ বাড়ানোর জন্য অনেক টোটকা-এটা, সেটা করেছে। কে জানে সে জন্যই কি শরীরটা আমার সব সময়ই হ্যাংলা-পাতলা ছিল। তবে মুখমণ্ডলটা অবশ্যই আদর করার মতো ছিল। হয়তো তাই পাড়া-পড়শি যুবতী মেয়েরা আমাকে নিয়ে কেমন একটা কচলা-কচলি করত। তাছাড়া কনিষ্ঠতম হওয়ার কারণে হয়তো আমার প্রতি মা-বাবা দুজনেরই একটা পক্ষপাতিত্ব ছিল।

আমার সেই মাকে ইন্ডিয়াতে মেজোভাইয়ের কাছে রেখে আমি তখন পিএইচডি করতে কানাডায়। সাসকাটুনে আসার পর রেগুলার চিঠি লিখতাম। ১৯৮০ সালের সামার। বেরিয়ে পড়লাম সাসকাটুন থেকে গ্রেহাউন্ড বাসে করে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে। ফেরার পথে সেই গ্রেহাউন্ড বাসেই সোহেলীর সঙ্গে দেখা।

সালোয়ার-কামিজ এবং চেহারা দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম বাংলাদেশিই হবে। আর স্যুটকেসের ট্যাগটাও চোখে পড়েছিল।

-এক্সকিউজ মি, আর ইউ গোয়িং টু কানাডা?

-ইয়েস ইনডিড, বাট হাউ ডিড ইউ গেস ইট?

-ইনটিউশন, কানাডার কোথায় যাওয়া হচ্ছে?

-এডমন্টন, আর আপনি?

-সাসকাটুন, অবশ্যই ভায়া এডমন্টন।

-ভালোই হলো, গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে।

-গল্পটা এখান থেকেই শুরু হোক না কেন? কী করা হয়? কোথায় যাওয়া হয়েছিল? ইত্যাদি।

-এসেছিলাম সিয়াটল সাউথে, আমার বড় বোনের বাসায়। আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছি জিওসায়েন্সে।

-আমি এক বছর হলো সাসকাচেয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছি কেমেস্ট্রিতে। বাংলাদেশে কিশোরগঞ্জে বাড়ি।

-আমাদের বাড়ি ছিল কুমিল্লা শহরে। মুক্তিযুদ্ধে রাজাকাররা আমাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। আমাদের পুরো পরিবার নিয়ে বাবা টরন্টো এয়ারপোর্টে নেমে এসাইলাম চাইল।

-ইউ মাস্ট বি প্রেটি ইয়াং দ্যট টাইম। ডু ইউ রিমেম্বার এবরিথিং?

-সারটেইনলি, আই ওয়াজ টুয়েলভ ইয়ার্স ওল্ড। আমরা এক মাস আগে গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। আমার বাবা ডাক্তার ছিলেন।

চলমান গ্রেহাউন্ড বাসের সঙ্গে সঙ্গে সময়ও চলছিল। লাঞ্চের সময় প্রায়। আমি বললাম

-লেটস টেইক এ কুইক লাঞ্চ। হোয়াট ডু ইউ লাইক টু হ্যাভ? চিকেন বার্গার অর পিৎজা?

-নো প্রিফারেন্স, আই এম নট দ্যাট হাংরি, মাই দিদি অলরেডি প্রোভাইডেড মি টু ক্যারি হট বক্স ফর ডিনার। আই ডোন্ট নো হোয়াট ইজ দেয়ার ইন সাইড।

-সে তো ডিনারে দেখা যাবে’খন। আচ্ছা আমি নিয়ে আসছি।

আমি ম্যাকডোনাল্ডস থেকে চিকেন বার্গার, নাগেটস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস এবং কোক নিয়ে আসলাম। খাওয়া শেষ করেই আমরা বাসে উঠে পড়লাম। উইন্ডো সিটে সোহেলী। আমি একটু রসিকতা করে বললাম :

-পাশের সিটটায় কি বসার অনুমতি পাব?

-আমার কিন্তু মোশন সিকনেস আছে। তাছাড়া আমি হয়তো ঘুমিয়েই পড়ব।

-কৈ বাত নেহি। তবে ঘুমাতে দিচ্ছি না। কথা বলে বলেই রাতটা পার করতে চাই।

-রাত হতে তো অনেক দেরি।

-তা বটে। আই এসিউম ইউর সিস্টার ইজ ম্যারিড।

-ইয়েস, সি ইজ। মাই জামাইবাবু ওয়ার্কস ইন মাইক্রোসফট। দিদি অলসো ওয়ার্কস।

-ইউ আর অনলি টু সিস্টারস? এনি ব্রাদার?

-ওয়ান ইয়াংগার ব্রাদার, ফ্রেশম্যান ইন দ্য ইউনিভার্সিটি।

-সো ইউ আর ইন দ্য মিডিল। ইউ নো আই এম দ্য ইয়াংগেস্ট আউট অব সেভেন। কারেন্টলি মোস্ট অব দেম আর ইন ইন্ডিয়া।

-হাউ কাম?

-দুই ভাই, দুই বোন ব্রিটিশ আমল থেকেই পশ্চিমবঙ্গে। তাই বলে আমি কিন্তু ব্রিটিশ আমলের লোক নই। তবে বর্তমানে মা আছেন জলপাইগুড়িতে। বাবা অনেক আগেই গত হয়েছেন।

ইত্যাদি কথোপকথনের পরে এক সময় সোহেলী ঘুমিয়ে পড়ল। আর আমি তো চলমান বাসে বা প্লেনে ঘুমাতে পারি না। এদিকে পিচঢালা রাস্তা বলে বাসও গ্রেহাউন্ডের মতোই ছুটে চলছে। মাঝখানে একটা কফি স্টপ দিয়ে আবার এক ঘণ্টায় সত্তর মাইল। বলতে গেলে একটা অবাক করা ঘটনা। সেই মেয়ে সোহেলী আমার একান্ত বন্ধু হয়ে গেল।

গ্রেহাউন্ড বাসে সোহেলীর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর মাকে আপডেট করতাম। মাকে লিখেছিলাম, মেয়েটি মেম নয়। মাকে অনেকেই ধারণা দিয়েছিল, “তোমার এই ছেলে একটা সাদা মেম আনল বলে। “কাজেই নিশ্চিত করার জন্য লিখেছিলাম, খাঁটি বাংলাদেশের মেয়ে। কুমিল্লার। মা একেবারে নিশ্চিন্ত। সোহেলী তো আমার জন্য একটা লটারি পাওয়া। সব নম্বর মিলতে হবে এবং ভাগ্যক্রমে মিলে গিয়েছিল। এমনকি পাওয়ার বলও। অতএব মার খুশি না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কবে দেখতে পাবে সেই একমাত্র চিন্তা। আমি মাকে জানিয়েছিলাম, অবশ্যই তুমি দেখবে। আমার ডিগ্রিটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সোহেলীকে নিয়ে আসব। এরই মধ্যে একটি মেইলে সোহেলীর পাঁচটি ছবি পাঠালাম।

মাকে আমি সোহেলী সম্পর্কিত শেষ চিঠিটা লিখি ১৯৮৩ সালের প্রথম দিকে আর সেই চিঠিটার কথাই বলছি এখানে।

শ্রী চরণেষু, মা

তুমি ভালো আছ তো। তোমার খাওয়া-দাওয়া ঠিকঠাক চলছে তো। মা, আমি তোমার ছোট্ট ছেলে রঞ্জু বলছি। তোমাকে আরও অনেকটা দিন বেঁচে থাকতে হবে। তুমি দেখবে না তোমার কনিষ্ঠতম সন্তান, তোমার আদরের রঞ্জু পিএইচডি ডিগ্রি পেতে যাচ্ছে। তার নামের আগে ড. লেখা হবে। এটা ঠিক ডাক্তার নয়, যারা তোমাকে মাঝে-মধ্যে চিকিৎসা করে থাকে। তবে আমি হব সেই বিষয়ের ডাক্তার যা বাবা একবার উচ্চারণ করেছিলেন। তোমার মনে নেই, সেই বইটা আমি বাবার নামে উৎসর্গ করেছিলাম।

মা তুমি নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছ, আমি তো আর তেমন করে সোহেলীর কথা লিখছি না। অবশ্য অনেক তো লিখেছি। আমার চিঠি মানেই সোহেলী। তোমার সর্ব কনিষ্ঠ বউমা। মা, তুমি যেরকম বাবাকে একদিন বিয়ে করে সুখী হয়েছিলে। নিশ্চয়ই সুখী হয়েছিলে। তাই নয়কি? সাত-সাতটি সন্তান জন্ম দিয়েছিলে। তাই অনেক শাখা প্রশাখা হয়েছে। তোমাকে সবাই আগলে রাখছে। আমি তো দারুণ খুশি। তোমার ছোট্ট ছেলেটা তো বিয়েই করেনি, তাই সংসারও হয়নি।

তোমার সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও সবাই আদর-যত্ন এবং ভালোবাসে। আমি কানাডা থেকে বেড়াতে আসলে সবাই জড়ো হয় তোমার এখানে। এক সপ্তাহের জন্য হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত।

সবার জন্য লাগেজ ভর্তি টুকিটাকি কত কিছু নিয়ে আসতাম। প্রতিদানে কারও কাছ থেকে কিছুই নিতাম না। তবে একটা জিনিস আমি আশা করেছিলাম। আমার আত্মীয়স্বজনের অনেকেই সোয়েটার বুনত, কিন্তু কেউ আমার বুকের মাপ নিয়ে একটা সোয়েটার বানিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করেনি।

আমার এত দিনকার ছোট্ট একটি চাওয়া কী করে টের পেল গ্রেহাউন্ডের সোহেলী নামের মেয়েটি! মা বলো সোহেলী কী করে বুঝল, আমার এটাই চাই। আমি হাতের পরশটা বুকে অনুভব করতে চাই। তা সে যেই হোক না কেন? কিন্তু আমি যখন পেলাম, আমি সারা রাত কেঁদেছি।

সাসকাটুন ও এডমন্টনের মাঝামাঝি লয়েডমিনিস্টার শহরটিতে আমরা দুজনে একদিনের জন্য দেখা করেছিলাম। আমি ওর জন্য ক্রিস্টেলের নেকলেস সেট নিয়ে গিয়েছিলাম। ও কিন্তু কিছুই দেয়নি। কথাটা হয়তো ঠিক হলো না। ও আমাকে বৈষয়িক কিছুই দেয়নি। কিন্তু চিরদিন মনে রাখার মতো সবই দিয়েছে। সাসকাটুনে ফিরে আসার এক সপ্তাহ পর এডমন্টন থেকে একটা পার্শ্বেল পেলাম। লিখেছিল ‘আমার হাতের পরশ’। মা তুমি বুঝতে পেরেছ এই মেয়েটাই তোমার বউমা হবে। মা আমি এতটুকু জীবনে কত কিছু দেখেছি। কিন্তু আমাকে কখনো তেমন হতাশ করেনি। করেনি এজন্য যে আমি তো মানুষের ভিতর পজিটিভটা একমাত্র দেখতে চাই, নেগেটিভ নয়।

সোহেলী মেয়েটি রীতিমতো শিক্ষিত। আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি করছে। খুবই ইন্টেলিজেন্ট মেয়ে। না মা ভয় পেও না। তেমন কোনো হিপ্পি টাইপের মেয়ে নয়। ও তোমার সামনে ঘোমটা দেবে। ও তোমাকে সপ্তাহে দুই-তিন দিন রান্না করে খাওয়াবে। ও কালিজিরার ফোঁড়ন দিতে পারবে। তুমি হয়তো ভাবছ ওর কি বাবা-মা নেই? ওর বাবা-মা দুজনই আছে। একটি ছোটভাইও আছে। সত্যি কথা বলতে কী ও তোমার ছেলেকে দেখে এবং পরিচিত হয়ে বুঝে গেছে ওর জন্যই আমি। অথবা আমার জন্যই ও। আমি জানি তুমি আমার এই চিঠি সবাইকে পড়তে দেবে। আমার কোনো অসুবিধে নেই। মা, অনেকে বলবে মেয়ে সুন্দরী বটে কিন্তু আমার জন্য উপযুক্ত নয়। মা উল্টোভাবে দেখ, তোমার ছেলে পটানশিয়েল কিন্তু এখনো একজন ছাত্রমাত্র। ডিগ্রি হলে একটা চাকরি হয়তো পাব। আর কী আছে তোমার ছেলের? ইনফ্যাক্ট, আমরা বাংলাদেশেও মধ্যবিত্ত ছিলাম, ইন্ডিয়াতেও মধ্যবিত্ত আর এদেশে এসেছি একটা স্কিল নিয়ে, আর তো আমার বা আমাদের কিছু নেই। তাছাড়া মা, কে কার উপযুক্ত এসব দিয়ে বিয়ের পাত্রপাত্রী কি যাচাই করা উচিত?

মা, তুমি যেমন আমার খোঁজ নাও, আমি খেয়েছি কি না? আমার শরীর ভালো আছে কি না? আমি যেন সাবধানে চলি ইত্যাদি। সোহেলীও কিন্তু তাই করে। তুমিই তো বলতে আমাকে দেখার কেউ নেই এদেশে। এখন তো একজন হলো যে তোমার আদর্শকে ফলো করছে।

মা, তুমি কি আর কিছু জানতে চাও সোহেলী সম্পর্কে? বুঝেছি, তোমার বউমা যে হতে যাচ্ছে সে কি ফর্সা? মা তোমার ছেলেই তো ফর্সা, বউ একটু কম ফর্সা হলে ক্ষতি কি? তবে সত্যি কথাটিই বলি, সোহেলী আমার চোখে বেশ ফর্সা। তারপরও জানতে চাইবে লম্বা কতটুকু? হ্যাঁ আমরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দেখেছি ওর চোখ আমার মুখের কাছে।

তোমার কী মনে আছে আমার ছোট্ট বয়সে কিশোরগঞ্জে রংমহল সিনেমা হলে তোমার সঙ্গে জীবনের প্রথম সিনেমা, ‘সবার উপরে’ দেখতে গিয়েছিলাম। উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা।

ওর মা ডাক শুনলেই তুমি জড়িয়ে ধরবে। আর তোমার হাজবেন্ড বেঁচে থাকলে বলত, বউমা হুঁক্কাটা একটু সাজিয়ে দেবে। তোমার জন্য পানও বানাতে পারবে। আমি কি তোমার সামনে তোমার কনিষ্ঠতম ছেলের ‘সুচিত্রা সেন’কে দাঁড় করাতে পেরেছি?

দেখ কি কাণ্ড? সোহেলী এখন আর এডমন্টনে থাকে না। ওর ফোনও আর পাই না। ও মাঝে-মধ্যে কেমন একটা ধমকের সুরে বলত র-ন-জু। আমি বুঝে ফেলতাম একটা গড়বড় হয়েছে। আর শুনতে পাই না সেই নরম শরীরের মতোই কোমল কণ্ঠস্বর। কেন এমন হলো?

আমাকে দেওয়া গেরুয়া রঙের সোয়েটারটা এক মাস ধরেই পরে আছি। সোয়েটার খুলতে বলায় আমার রুমমেট প্রিয়কে ঘুষি মেরেছিলাম। আরেক রুমমেট, অ্যান বলেছিল আমাকে নাকি হাসপাতালে নিতে হয়েছিল। আমি এখনো জানি না আমার কী হয়েছিল? শুধু মনে আছে সোহেলীর ভাইয়ের একটা ফোন রিসিভ করেছিলাম। ওর ভাই আমাকে প্রায় ছয় মাস ধরে দাদাবাবু বলে ডাকতে শুরু করেছিল। সেদিনের কণ্ঠটা কেমন যেন কান্নার মতো মনে হচ্ছিল। আমি প্রিয়কে চিৎকার করে ডেকেছিলাম- এটুকুই মনে আছে।

মা, মেয়েটা তোমার বউমা হয়েই গিয়েছিল। শুধু সিঁদুরটা পরানো বাকি ছিল। তবে একটা লালটিপ পরিয়েছিলাম। দেখ না ওর কি আহ্লাদিপনা। হঠাৎ করে বলে এখন থেকে তুমি আর আমি তুই করে ডাকব। ও কথা দিয়েছিল তোমার সামনে আমাকে তুই বলবে না। তবে আমার দারুণ লাগত। এই রঞ্জু শোন এদিকে দেখ কী সুন্দর বুনোহাঁসগুলো উড়ে যাচ্ছে -কী সুন্দর দেখাচ্ছে না? চল আমরা জলপাইগুড়ি থেকে ঘুরে আসি। মাকে প্রণামটা করে আসি।

আমি শুধু একবারই লয়েডমিনিস্টারে আসার বুদ্ধিটা দিয়েছিলাম। তারপর থেকে ওই বুদ্ধি বের করে চলে আসত। ওর বাবা মাও জানত এবং খুব একটা অমত করত না। সাসকাটুনে একবার এসেছিল। কী আশ্চর্য দেখ, ও তো অসিতদাদের পরিচিত। অসিতদার কথা তোমাকে বলেছি। বাংলাদেশের, সাসকাটুনে একমাত্র ফ্যামিলি। দেখলে তো সোহেলী কেমন ম্যানেজ করে সাসকাটুনে চলে আসত আমাকে দেখার জন্য। আমাকে বলেছিল তোর যখন সোয়েটারটা এত পছন্দ, তখন প্রতি বছর একটা করে বুনে দেব।

মা, এমন একজন সোহেলীকে আমি সারা জীবনের জন্য হারিয়ে ফেললাম। আমার তো পুণ্যের ভাগ শতভাগের কাছাকাছি থাকার কথা। তারপরও কেন এমন হলো?

একটা আঠারো চাকার ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ওর গাড়িতে ধাক্কা দেয়। হাসপাতালে নেওয়ার পথেই সব শেষ হয়ে গেল।

বাবার মৃত্যুর পর এক মাস নুনভাত খেয়েছিলাম। ও তো আমার লালটিপ পরানো আত্মার আত্মীয়। ওর জন্য আমি তাই করলাম।

মা চিন্তা কর না। আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। খুব শিগগিরই আমার পিএইচডি ডিগ্রি শেষ হচ্ছে এবং ইতোমধ্যে একটা পোস্ট ডক্টরেল পজিশন পেয়েছি হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি হয়তো চেষ্টা করব, হাওয়াইতে জয়েন করার আগে তোমার কাছে কটা দিন থেকে আসব। সেই ছোট্টবেলার মতো রোজ তোমার সঙ্গে ঘুমাব।

তুমি আমার প্রণাম নেবে সবার জন্য শুভেচ্ছা রইল।

ইতি

তোমার রঞ্জু

লেখক : বিজ্ঞান ও অঙ্ক বিভাগ, মিসিসিপি ইউনিভার্সিটি ফর উইম্যান, কলম্বাস, যুক্তরাষ্ট্র

Email: [email protected]

সর্বশেষ খবর