শিরোনাম
শনিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

আমাদের সময়কার নায়ক

ইমদাদুল হক মিলন

আমাদের সময়কার নায়ক

পাভেল আর আমি দুটো বেঞ্চে বসে আছি। ভোর রাত। খানিক আগে বেনাপোলের বাস এখানে নামিয়ে দিয়ে গেছে। জায়গাটার নাম ‘নাভারণ’। আমরা যাব পারুলিয়া। সাতক্ষীরার পারুলিয়া। আফজালদের বাড়ি। আফজাল বাড়িতে আছে। আমাকে আর পাভেলকে বলেছে, ‘চলে আয়’। কীভাবে যেতে হবে সেই পথও বলে দিয়েছে। গুলিস্তান থেকে রাতের বাস। বেনাপোল পর্যন্ত যেতে হবে না। নামতে হবে নাভারণ বাসস্ট্যান্ডে। আমরা দুটি বন্ধু সেভাবেই রওনা দিয়েছি। ভোর রাতে স্টেশনে নেমে শুনলাম, এখন পারুলিয়াগামী বাস নেই। ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বাসস্ট্যান্ডের পাশে কয়েকটা গাছ। তার তলায় দুটো বেঞ্চ পাতা। আমরা তখন খুব সিগারেট টানি। সেই বেঞ্চে বসে সিগারেট টানলাম কিছুক্ষণ। ঘুমে চোখ টানছে। বালিশের মতো করে ব্যাগ মাথার তলায় দিয়ে সেই বেঞ্চে শুয়ে পড়লাম। আমার দেখাদেখি পাভেলও তাই করল। সম্ভবত ১৯৮২ সালের কথা। মাসটা মনে নেই। মার্চ-এপ্রিল হতে পারে।

সেই প্রথম আফজালের জন্য গাছতলায় শোয়া। রাতেরবেলা। আবছা আলো অন্ধকারে। পরের বার দিনের আলোয়। এবারের পটভূমি কক্সবাজারের হিমছড়ি। ওই ঘটনার বিশ-বাইশ বছর পর, না কি তার চেয়ে বেশি! আমরা ছয় বন্ধু মিলে টেলিভিশন নাটক তৈরির একটা কোম্পানি খুলেছিলাম। ‘সিক্সথসেন্স’। নামটা আমারই দেওয়া। আফজাল আরেফীন দিদার স্বপন বাবু আর আমি। সিদ্ধান্ত হলো- প্রথমে একটা টেলিফিল্ম বানাব আমরা। স্ক্রিপ্ট লেখার দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। ‘ছবির মতো মেয়ে’ নামে স্ক্রিপ্ট লিখলাম। আফজালের যা স্বভাব, কারও স্ক্রিপ্টই পুরোপুরি ওর মনের মতো হয় না। নিজে এক সময় দারুণ জনপ্রিয় সব নাটক লিখেছে বিটিভিতে। নিজের লেখা নিয়ে যেমন খুঁতখুঁতে, যে স্ক্রিপ্টে কাজ করতে হবে, সেই স্ক্রিপ্ট নিয়েও তার বেদম মাথাব্যথা। আমার স্ক্রিপ্টের ওপর চলল তার কাটাকুটি। শেষ পর্যন্ত ভালোই দাঁড়াল জিনিসটা। আফজাল নিজেই পরিচালক। প্রধান পুরুষ চরিত্রটিতে অভিনয়ও করবে সে। নায়িকা ঠিক হলো ‘চৈতি’ নামের সুন্দরী এক মডেলকন্যা। পাশাপাশি আছে জয়া আহসান। শহীদুজ্জামান সেলিম আছে। একটি বিশেষ চরিত্রে আছেন সিনেমার জনপ্রিয় নায়িকা মৌসুমী। ক্যামেরায় সালাহউদ্দিন লাভলু। শুটিং হবে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে। ইউনিটের সঙ্গে আফজাল তো আছেই, আমরা পাঁচ বন্ধুও আছি। বেশ একটা পিকনিক পিকনিক ভাব। চট্টগ্রামের শুটিং ভালোমতোই শেষ হলো। পরের অংশ হিমছড়িতে। একটা মিনিবাস ঢাকা থেকে ভাড়া করে নিয়েছি আমরা। ওটা সঙ্গেই আছে। কক্সবাজারে গিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। তখন তিনটি ঘটনা ঘটল। নায়িকার বাবা অথবা মায়ের শরীর খারাপের খবর পৌঁছাল কক্সবাজারে। চৈতি দিশাহারা। যে কোনো বিপদ-আপদ কিংবা সংকটে চট করেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে সাগর আর আরেফীন। ওই প্রজেক্টে সাগর আমাদের সঙ্গে নেই। আছে আরেফীন। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে চৈতিকে ঢাকায় পাঠাবার ব্যবস্থা করল। আমাদের ছেড়ে নায়িকা উড়ে গেল ঢাকায়। দ্বিতীয় ঘটনা হলো- জয়া ঝাল শুঁটকি খেয়ে পেটের পীড়ায় আক্রান্ত। আর তৃতীয় ঘটনার নায়ক আমি। প্রথম দিন হিমছড়ির শুটিংয়ে গেছি। এক দিকে পাহাড় আর আরেক দিকে সমুদ্র। মাঝখানে নির্জনে পড়ে আছে একটি রাস্তা। রাস্তার পাশে বিশাল বিশাল গাছ। সকাল ১০টা-১১টা হবে। সকাল থেকেই আমার শরীরটা জুত লাগছিল না। মাথাটা ভার। জ্বর জ্বর লাগছে। রোদেভরা উজ্জ্বল দিন। সমুদ্রের হাওয়া বইছে হু হু করে। এক সময় দেখি আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। কাঁপুনি দিয়ে প্রবল জ্বর এসে গেছে। মাথা ব্যথা করছে। দৃষ্টি ঘোলা। হোটেলে ফিরে যাওয়ার শক্তি নেই। বন্ধুরা কপালে গলায় হাত দিয়ে জ্বর পরীক্ষা করছে। আফজাল ফিরেও তাকাচ্ছে না। একবার কাজে মগ্ন হয়ে গেলে অন্য কোনো দিকে তার খেয়াল থাকে না। আমাদের সবার অতিপ্রিয় বন্ধু সৌরভ থাকত আমেরিকায়। ভয়াবহ রোড অ্যাক্সিডেন্টে নিউইয়র্ক থেকে ডালাস যাওয়ার পথে স্পটেই মারা গেল সে আর তার স্ত্রী। সদ্য যুবক হয়ে ওঠা ছেলেটি পৌঁছে গেছে মৃত্যুর দুয়ারে। একটানা বছর দেড়েক আমেরিকার বিখ্যাত হাসপাতালে প্রায় অচেতন ছিল ছেলেটি। পরম করুণাময় ধীরে ধীরে সেই ছেলের জীবন ফিরিয়ে দিয়েছেন। সে এখন পুরোপুরি সুস্থ। কিন্তু যেদিন সৌরভের মৃত্যুর কথা আমরা শুনলাম, সবাই ভেঙে পড়লাম। হাহাকার কান্নাকাটি। আফজাল ছিল শুটিংয়ে। শুনে সে-ও ভেঙে পড়ল। সে-ও গোপনে কাঁদল। প্রিয়বন্ধুর জন্য বুকের ভিতর তোলপাড় হাহাকার সবই তার হলো কিন্তু কাউকে কিছু বুঝতে দিল না। মনের ওই অবস্থা নিয়েও হাতের কাজ শেষ করল।

আফজাল এরকমই।

হিমছড়িতে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আমি আর দাঁড়াতে পারছি না। অবসাদে ভেঙে পড়ছে শরীর। নির্জন রাস্তাটির ধারের গাছতলায় গালিচার মতো মোলায়েম ঘাস। আমি সেই ঘাসের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। তখন আর চোখে কিছু দেখছি না। জ্বরের ঘোরে এক ধরনের হেলুসিনেসান হয় মানুষের। আমার সেই অবস্থা চলছে। সমুদ্রের মায়াবী হাওয়ায় আমি সত্যি সত্যি অচেতন হয়ে গেলাম। অদূরে আফজাল শুটিং করছে। ইউনিটের লোকজন আর বন্ধুরা সবাই ব্যস্ত। আমি গাছতলায় শুয়ে অচেতন। কতক্ষণ এই অবস্থা চলছিল মনে নেই। হঠাৎ মুখের কাছে টুং করে একটা শব্দ হলো। চোখ খুলে তাকিয়েছি। দেখি একজন পথচারী কিছু একটা আমার দিকে ছুড়ে দিয়ে আপনমনে হেঁটে চলে যাচ্ছে। কী ছুড়ে দিয়ে গেল আমার দিকে? দেখি একটা আধলি পড়ে আছে আমার হাতের কাছে। তার মানে লোকটা আমাকে ভদ্রপোশাকের ভিখিরি মনে করে আটআনা পয়সা ভিক্ষা দিয়ে গেছে। ভাবলে এমন হাসি পায়!

ভিক্ষার আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল জার্মানিতে। সেটা বড় দুঃখের। কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরব, সিনডেলফিনগেন বাসস্ট্যান্ডে বসে আছি। শেষ বিকাল। যাব স্টুটগার্ট। এক বৃদ্ধা বসে আছেন আমার পাশে। তিনি যাবেন উলটো দিকে। মহিলা টুকটাক ইংরেজি জানেন। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে জানতে চাইছিলেন আমি কোন দেশের লোক, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার আগেই তার বাস চলে এলো। বাসে ওঠার আগে মহিলা আমার একটা হাত ধরে কিছু একটা গুঁজে দিয়ে চট করে বাসে উঠে গেলেন। মুঠো খুলে দেখি, পাঁচ মার্কের একটা কয়েন। আমি দরিদ্র দেশের মানুষ ভেবে ভিক্ষা দিয়ে গেছেন। অনেকক্ষণ বাসস্ট্যান্ডে বসে আমি কেঁদেছিলাম। এই ঘটনার বেশ কয়েক বছর পর আগ্রায় বেড়াতে গেছি। এক বিদেশি ভিখিরি যুবক এসে আমার সামনে হাত পেতেছিল। তাজমহলের প্রেমে পড়ে সে বহুদিন ধরে আগ্রায় পড়ে আছে। রাস্তার ধারে শুয়ে থাকে। চেয়ে-চিন্তে খাবারের পয়সা জোগাড় করে। আমি তাকে দশটা টাকা দিয়েছিলাম। যুবক এত খুশি হলো, ধন্যবাদ দিতে গিয়ে মাতৃভাষাটা বলে ফেলল। ‘ডাংকেসুন’। আমি চমকে উঠলাম। ‘তুমি জার্মান?’ যুবক মাথা নাড়ল। আমার মনে হলো, একদিন এক জার্মান মহিলা আমাকে পাঁচ মার্ক ভিক্ষা দিয়েছিল। সেই প্রতিশোধটা আজ আমার নেওয়া হলো।

জার্মানিতে ছিলাম দুই বছর। ১৯৮৯-এর অক্টোবর থেকে ১৯৯১ অক্টোবর পর্যন্ত। এই দুই বছরে সব বন্ধুই আমাকে চিঠি লিখেছে। শুধু আফজাল লেখেনি। সে তখন মনিপুরী পাড়ায় আমাদের আরেক বন্ধু পান্নার সঙ্গে ফ্ল্যাট ভাগাভাগি করে থাকে। কাছেই আরেক বন্ধু আলীমুজ্জান হারু থাকে। এক বিকালে আফজালের সঙ্গে দেখা করতে গেছি। আমাকে দেখেই হাসিমুখে আফজাল বলল, ‘কী হে জার্মান যুবক? কেমন আছ?’ বলেই আমাকে জড়িয়ে ধরল। মুহূর্তে আমি ভুলে গেলাম দুই বছরে আফজাল আমাকে একটিও চিঠি লেখেনি।

আফজাল এরকমই।

দুপুরের মুখে মুখে আমরা পারুলিয়ায় গিয়ে পৌঁছেছিলাম। নাভারণ থেকে নাশতা করে পারুলিয়ার বাসে চড়েছিলাম। দু’পাশের মাঠঘাট আর গাছপালার ভিতর দিয়ে পারুলিয়ার পথ। আফজালদের সেই সময়কার বাড়িটির চেহারা আবছামতো মনে আছে। রাস্তার ধারে পুরনো দুটো দালান। আফজালের বাবা ডাক্তার। একটিতে তার চেম্বার। রাস্তার দিকে দরজা আছে। সেই দালানের দক্ষিণে বাড়িতে ঢোকার গেট। বড় দালানটিতে বেশ কয়েকটি কামরা। সামনে চওড়া বারান্দা। বড় উঠোন। গাছপালা আছে বিস্তর। উত্তর দিকে আরেকটা দালান নাকি বনেদি টিনের ঘর, ঠিক মনে করতে পারছি না। সম্ভবত দক্ষিণ দিকে একটা পুকুর ছিল। আফজালরা দুই ভাই এক বোন। বোনটি ছোট। তখন তার বয়স দশ এগারো বছরের বেশি হবে না। ডাকনাম ‘মনা’। আশ্চর্য ব্যাপার, আফজালের স্ত্রীর ডাকনামও ‘মনা’। আফজালের জীবনে ‘না’-এর প্রভাব অনেক। একমাত্র বোনটির নামের শেষে ‘না’। স্ত্রীর নামের শেষে ‘না’। বিজনেস পার্টনার আর সর্বক্ষণ আফজালকে আগলে রাখা মানুষটির ডাকনাম ‘সানা’। এখানেও ‘না’। আমার নামের শেষে ‘ন’ আছে। একটা ‘া’কারের অভাবে আমি ওখানটায় পৌঁছাতে পারিনি।

সানার পুরোনাম সানাউল আরেফীন। বন্ধুদের মধ্যে সানার সঙ্গে আমার পরিচয় ও বন্ধুত্ব প্রথম ’৭৮ সালে, রোববার পত্রিকাতে কাজ করতে গিয়ে। আমরা দু’জনেই সেখানে কাজ করতাম। সানার বড়ভাই মাকসু বন্ধু। শাহবাগের ‘রেখায়ন’ এ আড্ডা দিতে গিয়ে মাকসুর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল। ওদের পরিবার বিজ্ঞাপন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বড়বোন নীলাবুর স্বামী শরফুদ্দিন সাহেব ছিলেন এ দেশের বিজ্ঞাপন জগতের শুরুর দিককার বিশিষ্ট একজন। সানার মেজোভাই সজল আরেফীন, সজলদা, মাকসু, সানা আর ওদের চাচাতো ভাই ফারুক প্রত্যেকেই শরফুদ্দিন ভাইয়ের বিজ্ঞাপনী সংস্থার সঙ্গে জড়িত ছিল। সানাদের পরিবারের সঙ্গে নিবিড় ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল আমার। সানাদের পরিবারের সবাই আমাকে পছন্দ করে। যাঁরা চলে গেছেন তাঁরা ভালোবাসতেন। যারা বেঁচে আছেন, তারা ভালোবাসেন। ‘রেখায়ন’ এ আড্ডা দিয়ে একরাতে ফিরছি। বিরাশি সালের শুরুর দিককার কথা। সঙ্গে মাকসু আছে। জার্মানি থেকে ফিরে আমার তখন দিশাহারা অবস্থা। ফিরে এসে ‘রোববার’-এ জয়েন করেছিলাম। সেই চাকরি চলে গেছে। দশটা টাকাও পকেটে থাকে না। মাকসু বলল, ‘‘চল একটা অ্যাড এজেন্সি করি। সামান্য কিছু টাকা হলেই করা যাবে।’’ ‘দোয়েল’ নামে অ্যাড এজেন্সি করলাম। বিজয়নগরে শরফুদ্দিন ভাই তখন রাস্তার ধারে দোতলা একটা বিল্ডিংয়ে চায়নিজ রেস্টুরেন্ট করার পরিকল্পনা করছেন। দোতলায় একটা রুম দিলেন আমাকে। সেই রুমে শুরু হলো ‘দোয়েল’। আমি ডেকে ডেকে বন্ধুদের নিয়ে এলাম ‘দোয়েল’-এ যুক্ত হওয়ার জন্য। আবদুর রহমান, পাভেল রহমান, শোয়েব সিদ্দিকী নামে আমাদের আরেক বন্ধু। তারপর সানাউল আরেফীন, আফজাল হোসেন। মাকসুও আছে আমার সঙ্গে। সে এক উন্মাতাল দিন। সজলদা হয়ে গেলেন আমাদের উপদেষ্টা। এই মানুষটি কী যে ভালোবাসতেন আমাকে! আমিও ছিলাম সজলদা বলতে অজ্ঞান। কত দিনরাত সজলদার বাসায় আমরা কাটিয়েছি। শরফুদ্দিন ভাইয়ের বাড়িতে কাটিয়েছি। সানার বড়বোন নীলাবু আমাকে তাঁর আপন ভাইয়ের মতো ভালোবাসেন। তাঁর তিন ছেলেমেয়ে ‘মিলনমামা’ বলতে অজ্ঞান। সানাদের পরিবারের ভালোবাসার ঋণ একজীবনে শোধ করা যাবে না। পরে ‘দোয়েল’ ভেঙে গেল। আফজাল আর আরেফীন ‘মাত্রা’ প্রতিষ্ঠা করল। ‘মাত্রা’ এখন বাংলাদেশের বিখ্যাত বিজ্ঞাপনী সংস্থা। ‘দোয়েল’ ভাঙার কারণে আমরা একটু বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বের টান মারাত্মক। এই টান কাটানো কখনোই সম্ভব না। ধীরে ধীরে আবার সবাই একত্রিত হলাম। আমি একবার ঠাট্টা করে আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কের নাম দিয়েছিলাম ‘রসুন সম্পর্ক’। সব রসুনের...

এখন প্রায়ই আমরা সবাই একত্রিত হই। কখনো ‘মাত্রা’য়, কখনো সাগরের চ্যানেল আইতে। কখনো কখনো বন্ধুদের ফ্ল্যাটে। একত্রিত হওয়ার পর আমাদের আলাপ-আলোচনা, হাসি-ঠাট্টা আর খুনসুটি এমন পর্যায়ে পৌঁছায়, মনে হয় আমাদের বয়স বাড়েনি। আমরা এখনো চব্বিশ-পঁচিশ বছরের যুবক। অথবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘নীললোহিত’। যার কখনো বয়স বাড়ে না। বয়স সাতাশ। আর যখন আমরা বেড়াতে যাই ঢাকার বাইরে, তখন আমাদের যেসব দুষ্টুমি, হাসিঠাট্টা মজা করা, তার কোনো তুলনা হয় না।

আফজালের বাবা ছিলেন খুবই কম কথা বলার মানুষ। একটু ভাবুক ধরনের সুদর্শন পুরুষ। মায়ের মুখটি সারাক্ষণ হাসিমাখা। আফজালের ছোটভাই বাবুলও কথা কম বলে। আর বোনটি, মনা কথা প্রায় বলেই না। সেবার পারুলিয়ায় গিয়ে মনার মুখে আমি একটিও কথা শুনিনি। কোনো চঞ্চলতাও ছিল না তার মধ্যে। উত্তর দিককার ঘরটিতে পুরনো খাট পাতা। চেয়ার টেবিল আছে। আফজাল পাভেল আর আমি সেই ঘরে ঘুমাই। একটা গ্রামোফোন আছে ঘরে। কয়েক বাক্স রেকর্ড। সেভেনটি এইট আরপিএম রেকর্ড। প্রায় সবই হিজ মাস্টারস ভয়েসের। হঠাৎ হঠাৎ সেই ঘরে ঢুকে গ্রামোফোনে রেকর্ড চাপাত মনা। একটাই গান বাজাত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘জল ভর কাঞ্চনকন্যা, জলে দিয়া মন’। তারপর থেকে এই গানটির কথা আমি কোনো দিন ভুলতে পারি না। হঠাৎ হঠাৎ মনে আসে গানটি। আর চোখের সামনে আফজালদের বাড়িটা দেখতে পাই। দুপুরের নির্জনতায় উত্তরের ঘরে বসে গ্রামোফোনে এই গান শুনছে দশ এগারো বছরের মনা। কোনো কোনো গান মানুষকে স্মৃতির অনেক ভিতরে টেনে নিয়ে যায়।

কী যে আনন্দে কেটেছিল পারুলিয়ার দিনগুলো! আমরা তিন বন্ধু গ্রামের এদিক ওদিক বেড়াতে চলে যাচ্ছি। ফিরে এসে আড্ডা আর আনন্দ হইচই। আফজাল তাঁর মাকে ‘আম্মা’ ডাকে। আমিও আম্মাই ডাকি। সামনে বসিয়ে গভীর মমতায় তিনি আমাদের খেতে দেন। এটা তুলে দেন পাতে, ওটা তুলে দেন। এক দুপুরে পাটি বিছিয়ে বারান্দায় খেতে বসেছি আমরা তিনজন। পারুলিয়ায় তখন সদ্য শুরু হয়েছে মাছের ঘেরের ব্যবসা। প্রচুর চিংড়িমাছ পাওয়া যাচ্ছে বাজারে। সেদিন দুই-তিন রকমের চিংড়ি রান্না করা হয়েছে। খেতে খেতে একটা চিংড়ির অর্ধেকটা আমি রেখে দিয়েছি। আম্মা বললেন, “ওকি বাবা, ওটুকু রাখলে কেন?” আমি চটজলদি বললাম, “ওটা তো লেজ, আম্মা।” চিংড়ির লেজ? এই নিয়ে বেশ হাসাহাসি হলো। কথাটা আফজাল আজও মনে রেখেছে। ওই নিয়ে আমরা হাসাহাসি করি। আফজালের ফ্ল্যাটে গেলেই আলাদা করে আম্মা আমাকে ডাকতেন। বুকে জড়িয়ে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতেন। তাঁর কাছে গেলেই আমি শিশু হয়ে যেতাম। আমার মায়ের কাছে গেলে আমি যেমন হতাম। আহা, আমাদের মাথার ওপর ছায়া হয়ে থাকা সেই মানুষগুলো কোথায়, কোন জগতে চলে গেছেন!

পারুলিয়াতে আফজালের বাবার সঙ্গে তেমন কথা আমার হয়নি। মনে হতো একটু রাশভারী গম্ভীর মানুষ। সেই ধারণা বদলে গেল অনেক দিন পর। আফজালের ফ্ল্যাটে একবার তাঁর সঙ্গে দেখা হলো। সেদিন অনেকক্ষণ আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ধীর শান্ত ভঙ্গিতে কথা বলেন। কথায় যুক্তি ও তীক্ষè বুদ্ধির ছাপ স্পষ্ট। কিছুক্ষণ কথা বলেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তাঁর ভিতরটা পবিত্র এক আলোয় ভরা। অত্যন্ত খাঁটি মনের মানুষ তিনি।

পারুলিয়ার সেই সময়টাতেই আফজাল টিভি নাটকের জনপ্রিয় নায়ক হয়ে উঠছে। তখন বাংলাদেশে জনপ্রিয় ও বিখ্যাত নায়ক-নায়িকাদের ‘ভিউকার্ড’ ছাপার একটা ব্যবসা শুরু হয়েছিল। আমার যতদূর মনে পড়ে আইডিয়াটা এসেছিল আজাদ প্রোডাক্টের আজাদ ভাইয়ের মাথা থেকে। পরে আজাদ ভাইয়ের সঙ্গেও আমাদের বন্ধুত্ব হয়। আফজালেরও ভিউকার্ড বেরিয়েছে। শহরের দোকানগুলোতে তো সেসব ভিউকার্ড দেদার বিক্রি হয়ই, গ্রামগঞ্জের মুদি-মনিহারি দোকানেও পাওয়া যায়। পারুলিয়া বাজারে আমরা তিন বন্ধু ঘুরছি। তখন তো আর এখনকার মতো গার্মেন্টের টি-শার্ট আর ট্রাউজার্স পাওয়া যেত না। আমাদের পরনে হাফহাতা শার্ট আর লুঙ্গি। তিন বন্ধু বাজারে ঘুরছি। বড় একটা মনিহারি দোকানের সামনে সুতলিতে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে আফজালের অনেক ভিউকার্ড। দোকানটির সামনে কাদাপানি। পাশের দোকানে আমরা যাব চা-মিষ্টি খেতে। কাদা বাঁচাবার জন্য লুঙ্গি হাঁটুর কাছে তুলে ধরেছে আফজাল। আমার আর পাভেলেরও একই অবস্থা। নিজের ঝুলন্ত বিভিন্ন পোজের ভিউকার্ডগুলোর পাশ দিয়ে লুঙ্গি হাঁটুর কাছে তুলে আফজাল নির্বিকার ভঙ্গিতে হেঁটে গেল। কাছের-পিঠের কেউ বুঝতেই পারল না, কে ওখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে?

এরকম কত স্মৃতি আফজালকে নিয়ে। [চলবে]

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর