শিরোনাম
শনিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

টেকসই কৃষি পদ্ধতিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে

শাইখ সিরাজ

টেকসই কৃষি পদ্ধতিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে

বাংলাদেশ তথা এই ভূখণ্ডের হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এখানকার কৃষকই সবচেয়ে বেশি শোষিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত। বেশি না, দুই শ বছর পেছনে ফিরে তাকালেও তা দেখা যায়। ইংরেজরা মূলত কৃষক প্রজাদেরই শোষণ করেছে। ইংরেজদের পর জমিদার এবং ব্রিটিশ শাসন শেষ হওয়ার পর পাকিস্তান শাসনের খড়গ এ দেশের কৃষককেই বহন করতে হয়েছে। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রের বিবিধ সুবিধা থেকে কৃষক বঞ্চিত। এখনো কৃষকের অবস্থান অতি সাধারণের মধ্যে তলানিতে। তার পরও আমাদের কৃষক ফসল ফলানোর তীব্র নেশায় ফসল ফলিয়ে গেছেন। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর আমরা যে ক্ষুধামুক্ত এই বাংলাদেশ দেখতে পাচ্ছি, আমি মনে করি এর পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশের কৃষক। এ ছাড়াও গবেষক, কৃষি উদ্ভাবন এবং সরকারি সহায়তায় বাংলাদেশ কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। দেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে এবং ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ। সবজি, ফল, মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম উৎপাদনেও ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে আমাদের দেশ। বাংলাদেশের কৃষি খাত বর্তমানে নগরায়ণ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধির বাস্তবতা সামনে রেখে উন্নয়নের পথে অগ্রসর হচ্ছে। বর্ধিত উৎপাদন, কৃষিপণ্যের গুণমানের প্রক্রিয়াজাতকরণ, জলবায়ু সহনশীল ফসল উদ্ভাবন এবং উন্নত কৃষি অনুশীলনসহ শস্য, উদ্যানবিদ্যা, প্রাণিসম্পদ, জলজ চাষ, সুনীল অর্থনীতির (ব্লু-ইকোনমি) বিকাশ এবং কৃষির আরও অনেক ক্ষেত্রে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের।

বিবিএসের হিসাবে, বাংলাদেশ বছরে ৩ কোটি ৮০ লাখ টনের মতো চাল উৎপাদন করে। ইউএসডিএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর (২০২৩-২৪) শেষে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন ৩ কোটি ৬৩ লাখ টনে দাঁড়াবে। একই সময়ে ভোগের পরিমাণ হবে ৩ কোটি ৭৬ লাখ টন। অর্থাৎ ভোগ আর উৎপাদনের মধ্যে পার্থক্য ১৩ লাখ টন।

বাংলাদেশের গবেষকরা জানিয়েছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে ধানের উৎপাদন ৪০ দশমিক সাত মিলিয়ন টন, ২০৪০ সালের মধ্যে ৪৩ দশমিক নয় মিলিয়ন টন ও ২০৫০ সালের মধ্যে ৪৬ দশমিক সাত মিলিয়ন টনে উন্নীত করা সম্ভব। ২০৫০ সালে বাংলাদেশকে আনুমানিক ২১ কোটি ৫৪ লাখ মানুষের খাবারের জোগান দিতে হবে। বর্তমান চালের বার্ষিক ব্যবহার জনপ্রতি ১৪৮ কেজি, যা প্রতি বছর শূন্য দশমিক সাত শতাংশ করে কমছে। আশা করা হচ্ছে, ২০৪০ সালের মধ্যে জনপ্রতি বছরে ১৩৩ কেজি চাল প্রয়োজন হবে। বর্তমানে প্রতিবছর ধানের উৎপাদন শূন্য দশমিক ৩৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই হারে বাড়তে থাকলে ২০৫০ সালে দেশে ধানের উৎপাদন ৪৭ দশমিক দুই মিলিয়ন টনে পৌঁছতে পারে।

২০৩০ সালের মধ্যে দেশে ধানের উৎপাদন ৪০ দশমিক ৭ মিলিয়ন টন, ২০৪০ সালের মধ্যে ৪৩ দশমিক ৯ মিলিয়ন টন ও ২০৫০ সালের মধ্যে ৪৬ দশমিক ৭ মিলিয়ন টনে উন্নীত করা সম্ভব। ২০৫০ সালে বাংলাদেশকে আনুমানিক ২১ কোটি ৫৪ লাখ মানুষের খাবারের জোগান দিতে হবে

কিন্তু মাথায় রাখতে হবে ধান চাষের জমি কমে আসছে। কৃষকও ধান চাষ করতে আগ্রহী হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে আমাদের ধানের উৎপাদন আদৌ বাড়বে কি না সে আশঙ্কা রয়েছে। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা দিন দিন হুমকির মুখে পড়বে কি না তা-ও ভেবে দেখতে হবে। বাংলাদেশে বছরে ৭০ লাখ টনের মতো গমের চাহিদা রয়েছে। আমদানি করতে হয় ৬০ লাখ টন। আর ১০ লাখ টনের মতো দেশে উৎপাদিত হয়। গম আমদানি রাতারাতি কমিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। দেশে উৎপাদন বাড়াতে আবহাওয়ার বিষয় রয়েছে। তবে উচ্চফলনশীল জাত ছড়িয়ে দেওয়া ও কার্যকর পরিকল্পনার মাধ্যমে আমরা গমের উৎপাদন এখনকার চেয়ে আরও বাড়াতে পারি। বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে চার লাখ হেক্টর জমি এখন অনাবাদি। ২০ লাখ হেক্টর জমি এক ফসলি। এ জমিগুলো আবাদের আওতায় আনার মাধ্যমে আমদানির পরিমাণ অনেকাংশে কমানো সম্ভব।

ভুট্টা চাষে কৃষক লাভবান হচ্ছে। এর ফলে আমাদের প্রাণিখাদ্যের একটি বড় জোগান আসছে। সনাতন কৃষি থেকে আধুনিক কৃষির দিকে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে দেশের কৃষি ও কৃষক। তবে এখন সময় এসেছে স্মার্ট কৃষির দিকে অগ্রসর হওয়ার।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের (ফোরআইআর) ফলে কৃষি উৎপাদন যেমন শিল্পের আকার পেয়েছে, কৃষি পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের বিকাশও সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে। ইন্টারনেট অব থিংস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স এবং অন্যান্য উন্নত প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে, কৃষি খাতে বিপ্লব ঘটানোর একটি যুগান্তকারী সুযোগ রয়েছে, কারণ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্য মূলত গ্রামীণ অর্থনীতিকে একটি রূপান্তরমূলক পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং গ্রাম-অঞ্চলে দক্ষ ব্যক্তিদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। ফোরআইআর বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতিতে কৃষিতে উৎপাদনশীলতা পরিচালনা করার জন্য একটি স্মার্ট কৃষি ব্যবস্থাপনার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফোরআইআরে কৃষি রোবোটিক্স প্রযুক্তি ব্যবহারে শ্রমিক খরচ হ্রাস পাবে এবং নিরাপদ কৃষিপণ্যের গুণমান অটুট থাকবে, যা উন্নত বিশ্বে আমরা হরহামেশা দেখছি। কৃষক যাতে ইন্টারনেট এবং অনলাইন প্ল্যাটফরমগুলোতে প্রবেশাধিকার পান এবং তাদের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে হালনাগাদ তথ্য সম্পর্কে অবগত থাকতে সক্ষম হন সেটি এখন ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণা দেওয়া সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ, যেখানে স্মার্ট কৃষি বড় একটি নিয়ামক। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় স্মার্ট কৃষির বিকল্প নেই।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে বাংলাদেশ যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে তা মোকাবিলা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাটি, পানি ও বনভূমির অবক্ষয় টেকসই কৃষির জন্য হুমকিস্বরূপ। উপরন্তু আবাদি জমির পরিমাণ কমছে এবং অনিশ্চিত আবহাওয়া কৃষিখাতে উন্নয়নের পথে উদ্বেগগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। প্রান্তিক ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি, বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ এবং মূল্যস্ফীতি মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে অবশ্যই টেকসই কৃষি পদ্ধতিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা মেটাতে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে এবং তা সময়ের প্রয়োজনে, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়াতে হবে। দেশের জন্য নিরাপদ ও টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে কৃষি উৎপাদনশীলতা এবং পরিবেশ সংরক্ষণের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা অপরিহার্য।

কৃষি-সংশ্লিষ্ট সবাইকে স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তির বিশাল সম্ভাবনার জায়গাটি উপলব্ধি করতে হবে; যা আগামীর বাংলাদেশের কৃষির ভবিষ্যৎ আমূল পাল্টে দেবে। আমরা জানি, পরিবর্তন তখনই ঘটে যখন কোনো দূরদৃষ্টি থাকে। যখনই কৃষি কোনো মারাত্মক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় তখনই দ্রুত এটি সমাধানের দাবি রাখে। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি সমাধান কী তা আমরা জানি না, কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, আমাদের কৃষক সর্বদা মাটিতেই আছেন, তারা শুনছেন, শিখছেন এবং প্রতিদিন বিকশিত হচ্ছেন। একই অবস্থা সরকার, নীতিনির্ধারক, উন্নয়ন অংশীদার এবং কৃষি খাতের অন্যান্য অংশীজনের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। বাংলাদেশ শুধু একটি উন্নত কৃষি খাতের স্বপ্নই দেখছে না, আমরা ধীরে ধীরে উন্নয়ন করছি, আর দৃঢ় আশা ব্যক্ত করছি যে এই কৃষি খাত এবং কৃষককে আমরা আরও বেশি শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে পারব এবং আমাদের সবাইকে এই ইতিবাচক প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে এবং নিরলসভাবে কাজ করে যেতে হবে। হাল ছেড়ে দিলে চলবে না।

ষাট দশকে সবুজ বিপ্লব এসেছিল এবং এখন আরেকটি বিপ্লবের জন্য সেরা সময় যার ব্যবস্থাপনা এবং ব্যবহার স্মার্ট এবং দক্ষ হতে হবে। ডিজিটাল দক্ষতা অর্জনে পর্যাপ্ত এবং কার্যকরী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যেগুলো কৃষকের জন্য বাস্তবসম্মতভাবে সহজ ও কার্যকরী হবে। এগুলো সম্ভব হলে অর্থাৎ বাস্তবায়িত হলে আমরা একসঙ্গে একটি টেকসই/মজবুত পথে হাঁটতে পারব বলে বিশ্বাস রাখি। স্মার্ট বিপ্লব কৃষির দৃশ্যপটে একটি বিবর্তনমূলক পরিবর্তন আনবে যা আমরা সবাই বুঝতে পারছি। এটি কেবল কৃষি খাতকে শক্তিশালী করবে তা নয়; বরং কার্যকরভাবে আমাদের জীবন-জীবিকা পরিবর্তন করবে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর