রবিবার, ১৪ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

মহররম মাসের তাৎপর্য, গুরুত্ব ও ফজিলত

মো. আমিনুল ইসলাম

মহররম মাসের তাৎপর্য, গুরুত্ব ও ফজিলত

আরবি সালের প্রথম মাস হলো মহররম। এর গুরুত্ব ও ফজিলত অপরিসীম। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের কাছে চারটি আরবি মাসের গুরুত্ব অত্যন্ত সম্মানিত। এই চারটি মাস হলো- মহররম, জিলকদ, জিলহজ ও রজব। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আসমানসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহতায়ালার বিধানে মাসের সংখ্যা বারোটি, এটা রয়েছে আল্লাহর কিতাবে, এ বারোটি মাসের মধ্যে চারটি হচ্ছে নিষিদ্ধ মাস, এটা আল্লাহ প্রণীত নির্ভুল ব্যবস্থা, অতএব তার ভিতরে হানাহানি করে তোমরা নিজেদের ওপর জুলুম করো না’ (সুরা তওবা-৩৬)। মহররম মাসের প্রতি সম্মানের ব্যাপারে রসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর মাস মহররমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে। কেননা যে ব্যক্তি মহররমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে, তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত দান করে সম্মানিত করবেন আল্লাহতায়ালা’ (মুসলিম, ইবনে মাজাহ)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘রমজানের পর সবচেয়ে উত্তম সিয়াম হলো আল্লাহর মাস মহররমের সিয়াম। আর ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামাজ হলো রাতের নামাজ (তাহাজ্জুদের নামাজ) মুসলিম শরিফ।

জনৈক সাহাবি নবীজির কাছে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসুল! রমজানের পর আপনি কোনো মাসে সিয়াম পালন করতে বলেন? নবীজি বলেন, তুমি যদি রমজানের পর সিয়াম পালন করতে চাও, তাহলে মহররমের সিয়াম পালন করো। কেননা মহররম হচ্ছে আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে যেদিন আল্লাহতায়ালা অনেকের তওবা কবুল করেন এবং ভবিষ্যতেও অনেকের তওবা কবুল করবেন’ (তিরমিজি)। ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষকরা এই দিনটিকে আশুরার দিন বলে উল্লেখ করেছেন। সৃষ্টির শুরু থেকে ১০ মহররম বা আশুরার দিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আল্লাহ এই দিনে হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেছেন। হজরত নুহ (আ.)-এর প্লাবন ও বন্যার এই দিনে সমাপ্তি ঘটেছে। হজরত ইব্রাহিম (আ.) এই দিনে নমরুদের অগ্নিকুন্ড থেকে মুক্তিলাভ করেছেন। হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তিলাভ করেন। হজরত আইয়ুব (আ.) এই দিনে রোগমুক্ত হন। হজরত সুলায়মান (আ.) এই দিনে তাঁর রাজত্ব ফিরে পান। হজরত ইয়াকুব (আ.) এই দিনে হারানো পুত্র হজরত ইউসুফ (আ.)-কে ৪০ বছর পর ফিরে পান। এই দিনে হজরত ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন এবং আল্লাহ রব্বুল আলামিন তাঁকে এই দিনে আসমানে উঠিয়ে নেন। এত সব ঘটনা এই মহররমের ১০ তারিখের।

আগে মুসলমানদের জন্য আশুরার রোজা ফরজ ছিল। দ্বিতীয় হিজরির শাবান মাসে রমজানের রোজা ফরজ হলে আশুরার রোজা সুন্নতের মর্যাদা লাভ করে। তবে সুন্নত রোজার মধ্যে আশুরার রোজা সর্বাধিক ফজিলতপূর্ণ (আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ)।

নবী করিম (সা.) হিজরত করে মদিনায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করলে দেখতে পান ইহুদিরাও আশুরার দিনে রোজা রাখছে। তিনি এর কারণ জানতে চাইলে সাহাবারা বলেন, এই দিনে মুসা (আ.) তাওরাত কিতাব লাভ করেন এবং তিনি বনি ইসরাইলিদের ফেরাউনের কবল থেকে উদ্ধার করে নীল নদ অতিক্রম করেন এবং ফেরাউন বাহিনীর সলিলসমাধি ঘটান। তাই তারা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এই দিন রোজা রাখেন। এই কথা জানার পর রসুল (সা.) বলেন, ‘আমরা মুসার (আ.) চেয়ে অধিক আপন অর্থাৎ মুসা (আ.)-এর অনুসরণের ক্ষেত্রে আমি তোমাদের অপেক্ষা অধিক হকদার। তোমরা ইহুদিদের থেকে ব্যতিক্রম করো। আশুরার এক দিন আগে বা পরে দুটি রোজা রাখো’ (মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ)। আমাদের সবার জানা আছে যে এই দিনেই সংঘটিত হয়েছিল বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ও মর্মান্তিক কারবালার যুদ্ধ। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সপরিবারে নিহত হন রসুল (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র এবং ফাতেমা (রা.)-এর আদরের সন্তান হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)। সত্য ও ন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে নির্যাতিত ও মজলুমের পক্ষে সাড়া দিয়ে তিনি শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাঁর এই ত্যাগ ও শাহাদাত বরণের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক।

উমাইয়া শাসক মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদ ক্ষমতার আসনে বসে নবী দৌহিত্র ইমাম হোসাইনের (রা.) পেছনে শত্রুতা শুরু করেন। ইয়াজিদের অরাজনৈতিক আচরণ ও বৈষম্য সে সময়ে মুসলমানদের কাছে ব্যাপক বিদ্রোহের জন্ম দেয়। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ইয়াজিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং অনৈতিকতার কাছে মাথানত না করে শাহাদাত লাভ করেন। তাঁর দৃঢ়তা এবং নৈতিকতা ও সততার আদর্শ আমাদের জন্য মহররমের শিক্ষা। তাঁর জীবনের মূল্যবোধগুলো ছিল রসুল (সা.)-এর আদর্শ ও শিক্ষা থেকে প্রাপ্ত।

সুতরাং মুসলমান হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো ইসলামী চেতনা, অনুশাসন ও মূল্যবোধকে অন্তরে ধারণ করে এবং মহররমের শিক্ষায় জীবনে চর্চা করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই তৌফিক দান করুন।

♦ লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার

সর্বশেষ খবর