সোমবার, ১৫ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ-চীন প্রতিরক্ষা সম্পর্ক

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

বাংলাদেশ-চীন প্রতিরক্ষা সম্পর্ক

আসছে ১৫ আগস্ট চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ৪৯ বছর পূর্তি তথা ৫০তম বছরে পদার্পণের দিনক্ষণ শুরু হবে। দীর্ঘ ৯ মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বহু ত্যাগের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নামের নতুন দেশের জন্ম হয়। স্বাধীনতার ৩ বছর ৮ মাস পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘাতকদের হাতে প্রাণ হারানোর দিনে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘটনা ইতিহাসের অপ্রিয় অথচ চরম সত্য এক অধ্যায়।

এ কথাও সত্য, আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে চীন পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। চীনের উত্তরে ও পূর্ব দিকে একটা অংশজুড়ে রয়েছে বর্তমান রাশিয়ার (পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন) সীমান্ত। ১৯৬৯ সালের ২ মার্চ থেকে ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬ মাস ১ সপ্তাহ ২ দিন ধরে এই সীমান্তে উভয় দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে উত্তেজনা, তর্ক-বিতর্ক ও গুলিবিনিময় চলতে থাকে। এতে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায় বলে ধারণা করা হয়। এ ছাড়াও মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের বাস্তবিক ব্যাখ্যা এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে চীন ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) মধ্যে মতপার্থক্য ঘটতে থাকে, যা চলে স্নায়ুযুদ্ধ (১৯৪৭-১৯৯১) পর্যন্ত। এমন উত্তেজনার ঠিক দুই বছর পর রাশিয়া যখন ভারত তথা স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের পক্ষ অবলম্বন করে, চীন তখন স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ায়। স্বাধীনতার আগে তৎকালীন বর্ষীয়ান রাজনৈতিক নেতা ও ধর্মীয় গুরু মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও কিছুটা হলেও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মাধ্যমে চীন তার রাজনৈতিক আদর্শ তথা সাম্যবাদ (চীনা কমিউনিজম) কায়েম করতে চেয়েছিল এই অঞ্চলে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের তিন দিকের ভারতীয় বহু জনপদে তখন মাওবাদী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করেছিল।

আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের ৯ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৬২ সালের ১২ অক্টোবর থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত সীমানা নিয়ে বিরোধ থেকে এক ভয়াবহ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে চীন ও ভারত। এই যুদ্ধে চীন তাদের ৭৭২২ জন সৈন্যের মৃত্যু ও ১৬৫৭ জন আহত হওয়ার কথা স্বীকার করলেও ভারতীয়রা প্রায় ১৩ চৈনিক সৈন্য হত্যার দাবি করে। অন্যদিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৩৮৩ জন সৈন্য নিহত, ১৬৯৬ জন নিরুদ্দেশ, সহস্রাধিক আহত এবং ৩৬৬৮ জন চীনের হাতে বন্দি হয়। তবে চীন ৪৮৯৭ জন ভারতীয় সৈন্য হত্যার তথ্য প্রকাশ করে (সূত্র : উইকিপিডিয়া)।

এরপর ১৯৬৭ সালেও চীন-ভারত সীমান্তে প্রথমে সেপ্টেম্বর মাসে ৪ দিন এবং ১৬ দিনের মাথায় অক্টোবর মাসে আরও ১ দিনব্যাপী সীমান্ত সংঘাত হয়। এই সংঘাতেও উভয় পক্ষের কয়েক শ সৈন্য আহত, নিহত ও নিরুদ্দেশ হয়। তাই যুদ্ধের ৪ বছর পর অর্থাৎ উভয় দেশের তিক্ততা বা রক্তের দাগ না শুকাতেই শুরু হয় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধে ভারত যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা তথা পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পৃথক করার জন্য নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, সর্বোপরি সামরিক ক্ষেত্রে সহায়তার হাত প্রসারিত করে, তখন চীন ভারতের বিপক্ষে তথা পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। সেই রেশ হয়তো ১৯৭৫ পর্যন্ত বহমান ছিল।

চীনের পাশাপাশি ভারতের সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারের সঙ্গে। আর ভারতের সমুদ্রসীমা রয়েছে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের সঙ্গে। সামরিক শক্তিতে বলীয়ান ভারতের প্রতিরক্ষা সক্ষমতার বড় অংশ যদি কেবল চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়, তবে চীনের জন্য তা অবশ্যই একটি বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হবে। পক্ষান্তরে চীন যদি ভারতের প্রতিরক্ষা সক্ষমতাকে খণ্ডবিখণ্ড করে পাকিস্তান, মিয়ানমার, বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের স্থলসীমান্তে এবং একই সময়ে শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে বিদ্যমান সমুদ্রসীমায় সদা ব্যস্ত রাখতে পারে, তবে তা চীনকে অবশ্যই অতিরিক্ত সাময়িক সুবিধা এনে দেবে। এ লক্ষ্যেই ১৯৭৫ সালে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি ১৯৭৬ সাল থেকে সামরিক সহযোগিতারও নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়।

বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় মিসর থেকে ৩০টি ৫৪ (টি-৫৪) মডেলের ট্যাংক সংগ্রহ করেন। চীনের সহায়তায় এসব ট্যাংক পরবর্তীতে চীনা টি-৫৯ মডেলের ট্যাংকে রূপান্তর করা হয়। ১৯৮০ সালের মধ্যে চীন বাংলাদেশকে ৩৬টি টাইপ-৫৯ ট্যাংক সরবরাহ করে। চীন থেকে পাওয়া ট্যাংকের আধিক্যের কারণে আশির দশকে বাংলাদেশের সাঁজোয়া (ট্যাংক) বাহিনীর অফিসারদের মৌলিক প্রশিক্ষণ হতো চীনে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ছত্রীসেনাদের প্রবর্তন চীনা প্রশিক্ষণ সামগ্রী ও চীনা প্রশিক্ষকদের কাছে ঋণী। উইকিপিডিয়ার বর্ণনা মতে, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী চীনা ট্যাংক দ্বারা সুসজ্জিত/শক্তিশালী হয়েছে, নৌবাহিনীতে রয়েছে চীনা ফ্রিগেট ও মিসাইল বোট এবং বিমান সেনারা চালায় চীনা যুদ্ধবিমান।’

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উন্মুক্ত ষান্মাসিক প্রকাশনা ‘অদম্য সেনা’ (৪র্থ প্রকাশনা) ও অন্যান্য উন্মুক্ত প্রকাশনায় প্রকাশিত তথ্য মোতাবেক বাংলাদেশ চীন থেকে নতুন করে ৪৪টি হালকা ট্যাংক লাভ করেছে, যা রাখা হয়েছে মিয়ানমারের সবচেয়ে কাছের সেনানিবাস রামুতে। ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ভাসমান সেতু চীনে নির্মিত। যুদ্ধকালে শত্রুর জঙ্গিবিমান বা আকাশপথে আসা যে কোনো যুদ্ধজাহাজকে ঘায়েল করতে চীন থেকে আনা হয়েছে আকাশ নিরাপত্তা কাজে ব্যবহৃত নানা ধরনের গোলন্দাজ ভারী অস্ত্র তথা দূরপাল্লার বিমান বিধ্বংসী কামান এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক গোলাবারুদ। নানা প্রকৃতির মিসাইলও এসেছে চীন থেকে।

‘অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো জয়িতা ভট্টাচার্যের দৃষ্টিতে ‘চীন বাংলাদেশের সব ঋতুর বন্ধু’ (অল ওয়েদার ফ্রেন্ড)। ২০২১ সালের ১১ মে তারিখে প্রকাশিত তার লেখা মতে, ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশে আমদানি ৭৪ শতাংশ অস্ত্র এসেছে চীন থেকে। ২০০২ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি বলে বাংলাদেশ নানা ধরনের অস্ত্র গোলাবারুদ, সাঁজোয়া যান, ট্যাঙ্ক, নৌবাহিনীর নানা ধরনের যুদ্ধজাহাজ, মিসাইল, জঙ্গিবিমান ও নানা ধরনের যুদ্ধ সরঞ্জাম ও খুচরা যন্ত্রাংশ নিয়মিত পাওয়া শুরু করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় পাওয়া ছিল ২০১৬ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে বিশেষ মূল্যহ্রাসে কেনা দুটি চীনা সাবমেরিন। যদিও এই সাবমেরিন ক্রয় এবং পরবর্তীতে কক্সবাজারের পেকুয়ায় ১.২ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের চীনা সহায়তায় বিএনএস শেখ হাসিনা নামক সাবমেরিন ঘাঁটি নির্মাণকে ভারতসহ বহু দেশ সহজে গ্রহণ করতে পারেনি, তার পরও বাংলাদেশ অন্তত প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে চীনের হাত ধরে হেঁটেছে দীর্ঘদিন। এই প্রেক্ষিতে ভারতীয় অনলাইন গণমাধ্যম ‘প্রিন্ট’ বিগত ৭ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে শিরোনাম করেছিল ‘বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে চীনের অস্ত্রবাদী খেলা ভয়ংকর হয়ে উঠছে-বিএনএস শেখ হাসিনা একটি শুরু মাত্র।’

এরই মাঝে গত ১৫ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের পারস্পরিক সম্পর্কের ৫০ বছর স্মরণে “গোল্ডেন ফ্রেন্ডশিপ-২০২৪” নামে চীন বাংলাদেশ যৌথ সামরিক মহড়ার ঘোষণা দেন চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র কর্নেল উ কুয়ান। কুয়ানের ঘোষণা মতে, উভয় দেশের সেনা কর্তৃপক্ষের সম্মতিতে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) অচিরেই বাংলাদেশ বাংলাদেশি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম চলাকালে সন্ত্রাসমূলক অপরাধ বা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উগ্রতা মোকাবিলায় যৌথ প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করার কথা ছিল।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সামরিক মহড়া করলেও চীন ও বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রথমবারের মতো যৌথ সামরিক মহড়ার সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যম বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বিরাজমান সামরিক সম্পর্কের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে। ভারতের ইংরেজি দৈনিক ‘টি স্টেটসম্যান’ ১০ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে প্রতিবেদনে দেখায় যে, ২০১৮ সালে, বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে একটি সামরিক চুক্তিতে প্রবেশ করে, যার মধ্যে কে-৮ ডব্লিউ মধ্যবর্তী প্রশিক্ষণ জেট ক্রয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরের বছর চীন তাদের নৌবাহিনী থেকে বাংলাদেশকে দুটি টাইপ ০৫৩ (জিয়াংওয়েই-টু) ফ্রিগেট প্রদান করে, যেগুলোকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে বিএনএস উমর ফারুক এবং বিএনএস আবু উবাইদাহ নামকরণ করা হয়। বাংলাদেশ ২০২১ সালে চীন থেকে এফ-৭ বিজিআই বিমান আমদানি করেছে, যা অত্যাধুনিক মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, চীনা সশস্ত্র বাহিনী সম্ভবত বাংলাদেশের মতো দেশে অতিরিক্ত ঘাঁটি এবং অনুপ্রবেশের দ্বার (অ্যাক্সেস পয়েন্ট) স্থাপনের কথা ভাবছে, যা বাংলাদেশে নৌ জাহাজের একটি প্রধান সরবরাহকারী হিসেবে চীনের ভূমিকার প্রতিফলন।

সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশ এখন চীনের সঙ্গে সামরিক সম্পর্কের এক ক্রস রোডে দাঁড়িয়ে আছে বলা যায়। ভারত সফরের পরপর প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এ সময় বিভিন্ন বিষয়ে ২১টি স্মারক স্বাক্ষরিত হলেও প্রতিরক্ষা বিষয়ক স্মারক একটিও ছিল না। সবদিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ সঠিক পথে এগিয়ে যাক- এটাই প্রত্যাশা।

(নোট : এ লেখায় উদ্ধৃত সব তথ্য-উপাত্ত বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত উন্মুক্ত সূত্র থেকে সংগৃহীত)

 

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর