মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

সহযোগিতা করে খোঁটা দেওয়া কবিরা গুনাহ

মুফতি রুহুল আমিন কাসেমী

সহযোগিতা করে খোঁটা দেওয়া কবিরা গুনাহ

আল্লাহতায়ালা মানুষকে উঁচু-নিচু করে সৃষ্টি করেছেন, সচ্ছলতা ও দরিদ্রতা দিয়ে পরীক্ষা করেন। যাতে করে একে অপরের সহযোগী ও পরিপূরক হয়। ধৈর্য, সহানুভূতি ও মানবতার চর্চা হয়। এসবই স্রষ্টার সৃষ্টি রহস্যের নিদর্শন। ইসলামে পরোপকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। এটা ইমানের দাবি এবং আল্লাহর অত্যন্ত পছন্দনীয় কাজ। হাদিসে বর্ণিত আছে, ‘যে ব্যক্তি মানুষের বেশি উপকার করে, সেই শ্রেষ্ঠ মানুষ’। এ উপকার করা যায় বিভিন্নভাবে, অর্থ দিয়ে, শক্তি দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে এবং বিদ্যা দিয়ে। যে খোদাপ্রদত্ত যোগ্যতাকে মানব সেবায় নিয়োজিত করে, তার যোগ্যতা সার্থক হয় এবং সে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানে সাফল্যমন্ডিত হয়। পরোপকার যে পন্থায়ই করা হোক, তা আল্লাহতায়ালার কাছে কবুল হওয়া এবং মর্যাদাপূর্ণ সওয়াবের কাজ হিসেবে গণ্য হওয়ার জন্য শর্ত হলো পার্থিব যে কোনো প্রকার উদ্দেশ্য ও স্বার্থহীনভাবে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তা করে যাওয়া। অর্থাৎ উপকৃত ব্যক্তির কাছ থেকে কোনো প্রকার বদলা পাওয়া, কিংবা সুনাম সুখ্যাতি লাভ করা, সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন করা বা অন্য কোনো রকম সুবিধা ভোগ করা। অথবা দান করে তা খোঁটা দিয়ে কাউকে আঘাত করা বা ছোট করা অথবা দমিয়ে রাখা। আল্লাহতায়ালা বলেন : আমরা তো তোমাদের খাওয়াই কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে। আমরা তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাই না এবং কৃতজ্ঞতাও না। (সুরা দাহার-৯) কেননা আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত নিজের জানমাল তাঁরই রাস্তায় ব্যয়কারীকে আল্লাহতায়ালা জান্নাত দান করবেন। মহান আল্লাহ বলেন : আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও তাদের সম্পদ খরিদ করে নিয়েছেন, তাদের জন্য জান্নাতের বিনিময়ে। (সুরা তওবা-১১১)। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দুনিয়াবি সংকটসমূহের কোনো একটি সংকট বিমোচন করে দেয়, দয়াময় আল্লাহ তার আখেরাতের সংকটসমূূূহ থেকে একটি মোচন করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবগ্রস্তের অভাব মোচনে সাহায্য করবে আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখেরাতে স্বাচ্ছন্দ্য দান করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ গোপন করবে, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখেরাতের সব দোষ গোপন করবেন। আল্লাহ বান্দার সাহায্যে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে। (মুসলিম)। পরোপকারের লাভ কেবল আখেরাতে নয়, দুনিয়াতেও পাওয়া যায়। তবে তা তখনই, যখন লক্ষ্যবস্তু হয় শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি। যদি কারও উদ্দেশ্য খারাপ হয় এবং উপকৃত ব্যক্তিকে খোঁটা দিয়ে আঘাত করে, খাটো করে, অপমান করে, তাহলে সেই ব্যক্তির সব ধরনের বিনষ্ট হয়ে যায় এবং সওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন : যারা নিজ সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে, আর ব্যয় করার পর খোঁটা দেয় না এবং কোনো কষ্ট দেয় না, তারা নিজ প্রতিপালকের কাছে তাদের প্রতিদান পাবে। তাদের কোনো ভয় থাকবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না। (বাকারা-২৬২)। সুতরাং দান করা অনেক বড় নেকির কাজ, কিন্তু তার ওপর ভিত্তি করে কাউকে আঘাত করা, কাউকে ছোট করা এবং দানের কথা মানুষের কাছে প্রকাশ করে তার অসহায়ত্ব জাহির করে প্রচার করা কবিরা গুনাহ। দানকারীর সব দানের নেকি নষ্ট হয়ে গুনাহগার হিসেবে পরিগণিত হবে। এজন্যই খোঁটা দেওয়াকে কোরআন মাজিদে কাফের বেইমানের কাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহপাক বলেন : হে মুমিনগণ! তোমরা খোঁটা দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান-সদকাকে সেই ব্যক্তির মতো নষ্ট করো না, যে নিজের সম্পদ ব্যয় করে মানুষকে দেখানোর জন্য এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে না। সুতরাং তার দৃষ্টান্ত এরকম, যেমন এক মসৃণ পাথরের ওপর মাটি জমে আছে, অতঃপর তাতে প্রবল বৃষ্টি পড়ে এবং তা সেই মাটিকে ধুয়ে নিয়ে যায় এবং সেটিকে পুনরায় মসৃণপাথর বানিয়ে দেয়। এরূপ লোক যা উপার্জন করে, তার কিছু তারা হস্তগত করতে পারে না। আর আল্লাহ এরূপ কাফেরদের হেদায়েত দান করেন না। (সুরা বাকারা-২৬৪)। সুতরাং উপকৃত ব্যক্তির থেকে কোনো ধরনের সুবিধা লাভে বঞ্চিত হয়ে তাকে অপমান করা, নেয়ামকহারাম, অকৃতজ্ঞ ও অবাঞ্ছিত বলে গালিগালাজ করা ও তার সমালোচনা করা, কুফুরি ও কবিরা গুনাহের কাজ। এরূপ ব্যক্তির পরিণতি সম্পর্কে নবীজি (সা.) বলেন : কেয়ামতের দিন আল্লাহ এরূপ ব্যক্তিকে বলবেন, তোমাকে আমি যে অর্থ-সম্পদ দিয়েছিলাম তা দ্বারা তুমি আমার জন্য কী করেছো? সে বলবে হে আমার রব! আমি তা তোমার পথে ব্যয় করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো। তুমি তো এজন্য দান করেছিলে যে, লোকে তোমাকে দাতা বলবে, তা বলাও হয়েছে দুনিয়ায়। আজ আমার কাছে তোমার কোনো বদলা নেই। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (হাকিম-২৫২৮)। যে ব্যক্তি কারও উপকার নেয়, সে এমনিতেই মানসিকভাবে দুর্বল থাকে, তার ওপর যদি খোঁটা দেওয়া হয়, তবে তা তার জন্য অত্যন্ত অপমান ও কষ্টের কারণ হয় এবং অন্তরে রীতিমতো রক্তক্ষরণ ঘটায়। সেই রক্তক্ষরণের বিপরীতে তার সব দান-খয়রাত কোনো প্রকার নেক কাজের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে না। আল্লাহতায়ালা বলেন : উত্তম, কথা বলে দেওয়া ও ক্ষমা করা, সেই দান-সদকা অপেক্ষা উত্তম, যার পরে কোনো কষ্ট দেওয়া হয়। আল্লাহ অতি মুখাপেক্ষীহীন ও সহনশীল। (সুরা বাকারা-২৬৩)। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন : তিন ব্যক্তি এমন কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা যাদের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না, তাদের পরিশুদ্ধ করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। হজরত আবু যর বলেন রসুলুল্লাহ (সা.) এ কথাটি তিন তিনবার বলেছেন। আমি বললাম ইয়া রসুলুল্লাহ! তারা কারা? তারা তো সর্বস্বান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেল। তিনি বললেন ১. যে ব্যক্তি পরিধেয় কাপড় টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে রাখে, ২. যে ব্যক্তি উপকার করার পর খোঁটা দেয়। ৩. যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় করে। (সহিহ মুসলিম)। অন্য হাদিসে নবীজি বলেন : তুমি দান করো এমনভাবে, যেন তোমার ডান হাতের দান, বাম হাত জানতে না পারে। (আল হাদিস)।

 

লেখক : ইমাম ও খতিব; কাওলার বাজার জামে মসজিদ, দক্ষিণখান, ঢাকা

সর্বশেষ খবর