বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

মধ্যরাতের স্লোগান কি সতর্ক সংকেত?

ফজলে হোসেন বাদশা

মধ্যরাতের স্লোগান কি সতর্ক সংকেত?

মাঝরাতের একটা স্লোগান অনেককে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। আমার মন খারাপ হয়েছে, কিন্তু হতবাক কিংবা স্তম্ভিত হইনি। কারণ, ১৪ জুলাই মধ্য রাতে যা ঘটেছে, তা হঠাৎ করে ঘটেনি। যারা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক গতিপ্রবাহ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন, অন্তত তাদের কারও কাছেই এই আঘাত আকস্মিক কিছু নয়। কোটা সংস্কারের নামে যে পাল্টাপাল্টি আলোচনা চলছে, সেটিও এই পরিস্থিতি বিনির্মাণের একমাত্র উপলক্ষ নয়। বরং এই  পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে পর্দার অন্তরালে ঘটে চলা নানাবিধ অনাকাক্সিক্ষত ও অপ্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহের সম্মিলিত ফসল।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নিদারুণ দুঃশাসনের সময়কালে দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক শক্তির ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছিল সময়ের দাবি। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাভাই, হুজিসহ সামগ্রিক জঙ্গি তৎপরতার বাড়বাড়ন্ত এতটাই চরমে ওঠে, সেই সময় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যার উদ্দেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। বাংলাদেশবিরোধী অপশক্তির সেই ভয়াবহ চক্রান্ত আমরা মোকাবিলা করেছিলাম ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। মূলত সে সময় গড়ে ওঠা ১৪-দলীয় জোট দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের গন্তব্যকেই নির্ধারণ করে দিয়েছিল। ২০০৫ সালে গড়ে ওঠা এ জোটের ভিত্তি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ২৩ দফা লক্ষ্য ও কর্মসূচি। অথচ সরকার গঠনের পর থেকে দিন যত গড়িয়েছে, ততই যেন এই জোটের গুরুত্ব কমেছে। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের চুলচেরা জবাব খুঁজে বের করতে পারলে আজকের এই মধ্যরাতের ঘটনাপ্রবাহের নেপথ্যের প্রক্রিয়াও বোঝা সহজ হতে পারে।

এ দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি বিকশিত করার ক্ষেত্রে ১৪ দলের ভূমিকার কথা মাথায় রেখেও এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ২৩ দফা পুরোপুরি অর্জনের আগেই এই রাজনীতিকে দুর্বল করে দেওয়ার নানাবিধ অপচেষ্টা চলেছে। দুঃখের বিষয় হলো, জোটের সব থেকে বড় শরিক হয়েও খোদ আওয়ামী লীগ প্রায়শ এই ফাঁদে পা দিয়েছে। অঞ্চলভেদে প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী গোষ্ঠী দীর্ঘদিন কতিপয় চিহ্নিত আওয়ামী লীগ নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক কার্যক্রম সচল রেখেছে।

সেই আর্থিক সুবিধা ওইসব কতিপয় চিহ্নিত আওয়ামী লীগ নেতা গ্রহণও করেছেন। ফলাফল হিসেবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারক-বাহকেরা ছদ্মবেশে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। কেউ কেউ আবার আওয়ামী লীগের ছাতার তলেই আশ্রয় নিয়ে বসেছে। বারবার এ বিষয়গুলো সামনে তুলে আনার চেষ্টা করেও খুব বেশি লাভ হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। এখন পর্যন্ত এসব প্রক্রিয়ায় যেসব আওয়ামী লীগের নেতারা যুক্ত, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। উদাহরণ হিসেবে আমি যদি শুধু আমার রাজশাহী অঞ্চলের কথাই বলি, তাহলেও এক ভয়ংকর দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। পত্রিকার খবরে বারবার উঠে এসেছে, অঞ্চলের আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা ও তার পরিবারের কথা, যারা জামায়াতপন্থি ব্যবসায়ীদের পার্টনার হয়েছেন। ওইসব ব্যবসায়ী যে শুধু ব্যবসাই করেছে, তা তো নয়। তারা ওই আওয়ামী লীগের নেতাকে সামনে রেখে পুরো অঞ্চলজুড়ে নিজেদের আর্থিক সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে। তারা বেসরকারি আবাসন প্রকল্প করেছে, ব্যাংকের চেয়ে বেশি সুদে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রায় হাজার কোটি টাকা তুলেছে, রিয়েল এস্টেট ব্যবসা চালিয়েছে। প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিয়েছে জামায়াত-শিবিরের লোকজনকে। আবার তারাই বিভিন্ন নামে কোম্পানি খুলে ব্রিটেনে অননুমোদিতভাবে বিনিয়োগ করেছে। সেখানে দুবাই ও পাকিস্তানভিত্তিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে তারা যুক্ত হয়েছে। এটা আমার কথা নয়। খবরের কাগজে এ নিয়ে বিস্তারিত খবর প্রকাশিত হয়েছে।

গত সংসদ নির্বাচনের আগে আমি এরকম একটি সন্দেহ পোষণ করে রাজশাহীতে আমাদের দলীয় কর্মসূচিতে এই কোম্পানিগুলো ও তাদের আশ্রয়দাতাদের চিহ্নিত করার আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমার সেই আহ্বান কার্যকর হয়নি। ফলে তাদের সাহস আরও বেড়ে। এই সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা আওয়ামী লীগের সেই কেন্দ্রীয় নেতাকে দিয়ে আরও বড় সব চক্রান্ত চালাতে লাগল। এ কারণেই আমরা দেখতে পাই, ওই নেতা ১৪ দলের শরিকদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করতে শুরু করেন। এখানেই শেষ নয়, তিনি বিগত সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের বিরোধিতা করে রাজশাহীর একটি বাদে সব আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মাঠে নামিয়েছেন, তাদের পেছনে বেশুমার টাকা ঢেলেছেন।

স্পষ্টভাবে তিনি রাজশাহীর মতো স্পর্শকাতর একটি অঞ্চল, যেখানে দীর্ঘ সময় ধরে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও জঙ্গিদের তৎপরতা চলেছে, সেখানে বসে সেই অপশক্তিরই এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করে চলেছেন। অথচ আজ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এর কোনো বিহিত করতে পারেনি। রাজশাহী অঞ্চলের ঘটনা একটা উদাহরণ। সারা দেশেই আওয়ামী লীগের চিহ্নিত কতিপয় নেতা একই ধরনের তৎপরতায় যুক্ত রয়েছেন। স্থানীয় রাজনীতি তাদের ইশারায় পরিচালিত হয়।

দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটিও তাদের পছন্দ মাফিক হয়। এসব নিয়েও অনেক কথা শোনা যায়। কিন্তু এ কথা নিশ্চিত যে, এই নেতাদের হাত ধরে বর্তমানে আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে প্রতিক্রিয়াশীলরা নেতৃত্ব পেয়েছেন। দুঃসময়ের পুরনো ত্যাগী নেতারা নিপীড়িত হতে হতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। এবং এই সমস্ত প্রক্রিয়া প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঘটে চলেছে। বিপরীতে ইসলামী ছাত্রশিবির তাদের সেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বদৌলতে নিজেদের নেতা-কর্মীদের মধ্যে জনে জনে বাইসাইকেল আর মোবাইল ফোন বিতরণ করে নিজেদের নেটওয়ার্ক আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্জনগুলো ম্লান করার জন্য এসব অশুভ সিন্ডিকেটই যথেষ্ট। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তারা বসে নেই। বরং সময় নিয়ে একটু একটু করে তারা পরিস্থিতি তৈরি করে চলেছে। বাজার সিন্ডিকেট, অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট আর টাকা পাচারের পেছনে রয়েছে এদেরই ভূমিকা। তাদের সামনে ঢাল হিসেবে রয়েছে সরকারি দলেরই কতিপয় অসৎ নেতৃত্ব। তারা দেশ থেকে টাকা পাচার করছে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিপন্ন করে চলেছে। তারা জানে, এসব পরিস্থিতি তৈরি হলে সাধারণ মানুষ বিক্ষুব্ধ হবে। তারা সেই মাহেন্দ্র্যক্ষণের অপেক্ষাতেই দিন গুনছে আর তাদের অস্ত্রে শান দিচ্ছে।  

এই সত্য অনস্বীকার্য যে, আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিদ্যমান অসংখ্য ত্রুটি-বিচ্যুতি আমরা সারাতে পারিনি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী ও আধুনিক করে তৈরি করতে পারিনি, যেই শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের শিক্ষার্থীদের সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক ও মুক্ত চিন্তার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। পাঠ্যপুস্তক নিয়ে অযাচিত বিতর্কে আমাদের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে সরকার প্রতিক্রিয়াশীলদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করেছে। এসবের সম্মিলিত ফলাফল আজ আমাদের চোখের সামনে। যে কোনো ইস্যু নিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রাম দেশে নতুন কিছু নয়। কিন্তু এই আন্দোলন-সংগ্রামের ফাঁক গলে কেউ যদি দাবির মুখকে বিপথগামী করতে চায়, তাহলে তা বুঝতে পারা এবং নিজেদের করণীয় নির্ধারণ করাও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অন্যতম পূর্বশর্ত।

নচেৎ, যারা এসব আন্দোলন-সংগ্রামের কাঁধে বন্দুক রেখে নিজেদের ফায়দা হাসিল করতে চায়, তারা জিতে যায়। স্লোগান, কর্মসূচির প্রাণ তো বটেই, ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দই খুব সতর্কতার সঙ্গে ব্যবচ্ছেদ করা জরুরি। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা করার ফলাফল তো কারও জন্যই সুখকর হতে পারে না, ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশবিরোধী সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তি। কাজেই এ মুহূর্তে দেশের অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তিকে বুঝেশুনে  পদক্ষেপ নিতে হবে। মধ্য রাতের এই স্লোগান আমাদের জন্য একটি সতর্ক সংকেত। হয়তো এখনো এতটাই দেরি হয়ে যায়নি, যেখান থেকে ফেরা যায় না। কিন্তু ফিরতে হলে চাই অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ নিখাদ প্রয়াস। সেই পথে আমরা যত দ্রুত চলতে শুরু করব, ততই মঙ্গল।

লেখক : বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক

সর্বশেষ খবর