শুক্রবার, ১৯ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ এবং অতঃপর

অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন

প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ এবং অতঃপর

১৭ জুলাই, ২০২৪-এ জাতির উদ্দেশে প্রায় ১০ মিনিটের ভাষণে প্রথমেই যা ভালো লেগেছে তা হলো শোক প্রকাশের প্রতীক কালো শাড়ি পরে গভীর বেদনার সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। যে ছয়টি প্রাণ ঝরে গেল, তাদের এবং তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশে তাঁর অভিব্যক্তি ছিল আন্তরিক।

প্রথমেই তাঁর বক্তব্যের ইতিবাচক অংশগুলো তুলে ধরি। তিনি বলেছেন- ১. ‘হত্যাকাণ্ডসহ যেসকল অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে, সুষ্ঠু বিচারের ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে সেসকল বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা হবে। যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে, তাদের পরিবারের জন্য জীবনজীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে যে সহযোগিতা দরকার তা আমি করব।’

২. ‘আমি বিশ্বাস করি যারা কোটা সংস্কার আন্দোলনে জড়িত তাদের সাথে এসকল সন্ত্রাসীদের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং সন্ত্রাসীরা এদের মধ্যে ঢুকে সংঘাত ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।’

৩. ‘সর্বোচ্চ আদালতের রায় আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার জন্য আমি সকলকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি। আমার বিশ্বাস আমাদের ছাত্রসমাজ উচ্চ আদালত থেকে ন্যায়বিচারই পাবে, তাদের হতাশ হতে হবে না।’

এবার প্রবন্ধের শিরোনামের ‘এবং অতঃপরের’ কথা। একটি কথা চালু আছে, বর্তমানে বাংলাদেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথা ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না। তিনি ছাড়া তাঁর সরকার কিংবা দলের পক্ষ থেকে অন্য কারও বক্তব্যকে কেউ কোনো গুরুত্ব দেয় না। সবাই জানে প্রধানমন্ত্রী কী বললে খুশি হবেন, তা বিবেচনায় নিয়ে এসব পারিষদ কথা বলেন। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় নিঃসন্দেহে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কিন্তু পরিতাপের কথা, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে তেমন রাষ্ট্র এবং সমাজের ধারেকাছেও আমরা নেই। এই যখন বাস্তবতা, তখন বলতেই হবে, কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হওয়ার পর একটা লম্বা সময় পার হয়েছে, দেশব্যাপী রাস্তায় নেমে আসা বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং স্কুলের বিপুলসংখ্যক আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কোনো প্রকার যোগাযোগ করা হয়নি। সমস্যার সমাধান চেয়ে এমনকি মাননীয় রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার পরও।

স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে ‘শর্ষের ভিতরেই ভূত আছে’। ছয়টি তাজা প্রাণ ঝরে যাওয়ার আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার চারপাশের আস্থাভাজনেরা আপনাকে পরামর্শ দেননি সময়ের কাজ সময়ে করার জন্য। তারা ভুল পরামর্শ দিয়ে আপনাকে আজ ছাত্র, শিক্ষক ও জনতার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এখনো সময় আছে। আপনি আন্দোলনরত কোমলমতি ছাত্রদের আপনার কাছে টেনে নিন। তাদের ডেকে নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসুন এবং উত্তরণের একটি পথ খুঁজুন। সে আলোচনা চলার সময় কিছু বিষয় আপনার মাথায় রাখতে অনুরোধ করব।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, একমাত্র কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে দেশের নতুন প্রজন্ম এমন এক সর্বব্যাপী আন্দোলনে নেমে পড়েনি। একটু খোঁজ নিলেই দেখবেন, বছরের পর বছর ছাত্রলীগের হাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা কীভাবে নিগৃহীত হয়েছে। তারুণ্যের স্বভাবজাত সুবৃত্তি কীভাবে আঘাত করেছে সরকারি মদতপুষ্ট এ সংগঠনটি। এমন ছাত্রলীগকে নিয়ে আপনাকে গভীরভাবে ভাবতে হবে। সাধারণ ছাত্রদের থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন এ সংগঠনের ওপর নির্ভরতা অনেকাংশে আপনাকেই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারি দলের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে এদের ভূমিকা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে অতীতের সামরিক-বেসামরিক স্বৈরাচারী সরকারের পেটোয়া বাহিনীর কথা। আমরা ছাত্র-শিক্ষকরা সমবেতভাবে তাদের মোকাবিলা করেছি, পরাজিতও করেছি।

কয়েক দিন ধরে চলমান আন্দোলনে অংশ নেওয়া অসংখ্য সাধারণ ছাত্রছাত্রী ছাত্রলীগের হাতে নিগৃহীত হয়েছে। এ ক্ষত তাদের মন থেকে সরতে বহুকাল লেগে যাবে। ছাত্রলীগের যারা হামলায় অংশ নিয়েছে এবং এখনো নিচ্ছে, তাদের বিচারের আওতায় আনুন। অবিলম্বে রাস্তা থেকে ছাত্রলীগকে প্রত্যাহার করুন।

সময় এসেছে স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান প্রণীত ‘প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব ছাত্র সংগঠন থাকবে’-এমন কালো আইন অবিলম্বে রদ করার। ক্ষমতাসীন দলের আশ্রয়প্রশ্রয়ের নিরাপদ বেষ্টনীর বাইরে থাকলে ছাত্রলীগের মতো ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটির পক্ষে সম্ভব হবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে জনগণের সেবক হিসেবে একটি আদর্শস্থানীয় ছাত্র সংগঠন হিসেবে নিজেদের সংগঠিত করা। এমন সংগঠনের গর্বিত নেতা, কর্মী হওয়ার আকাক্সক্ষা ছাত্রলীগে নেই আমি তা মনে করি না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। অনতিবিলম্বে আলোচনা শুরু হবে। দেরিতে হলেও এটি একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। ইতোমধ্যে হাই কোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতিকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আশা করব এ কমিশনে আন্দোলনরতদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি যেন থাকে। এ কমিশন অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে ‘অ্যাফারমেটিভ অ্যাকশন’-এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে গভীরভাবে ভেবে, সব পক্ষের মতামত বিবেচনা করে একটি সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত দেশবাসীকে উপহার দেবে।

এবার আমি শিক্ষকমণ্ডলী, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উদ্দেশে কিছু কথা বলব। ‘শিক্ষকরা জাতির বিবেক’, দুঃখজনকভাবে এ অভিধা এ দেশের শিক্ষকরা এখন আর ধারণ করেন না। এর পুরো দোষ শিক্ষকদের নয়। সব ক্ষেত্রে নৈতিকতার যে ধস নেমেছে, তা থেকে নিজেদের মুক্ত রাখা কঠিন বটে। রাষ্ট্র, সরকার, সমাজ যারা প্রতিনিয়ত চায় শিক্ষকদের পদানত রাখতে, তাদের দায়ও কম নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার দীর্ঘ শাসনামলে বর্তমান সময়ে শিক্ষকদের যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন তাঁদের কাছ থেকে কাক্সিক্ষত ন্যায়বোধ, প্রজ্ঞা এবং কঠিন সত্য উচ্চারণের সাহস। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক, যারা পদটি পেয়ে তা উপভোগ করছেন এবং দেশের এমন সংকটে নিজেদের নির্বাক রাখছেন, তাঁদের থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামের শিক্ষক, যারা বিভিন্ন সরকারি কাজ যেমন নির্বাচনকালে পোলিং এজেন্টের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কালো টাকা, সরকারি দলের প্রতিপত্তি এবং প্রশাসনের প্রভাবের কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের কারও ওপর ছাত্র, অভিভাবক এবং আমজনতার ভোটারদের কোনো আস্থা আর অবশিষ্ট নেই। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এ শিক্ষকদের অসহায় অবস্থা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষক নেতৃত্ব কি দেশে বিদ্যমান ঔপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক চেতনার রাষ্ট্র, যা প্রতিনিয়ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দেয়, কীভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের অধীন রাখতে, তেমন রাষ্ট্রের স্থলে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পত্তনের মধ্য দিয়ে জ্ঞানবিজ্ঞানে উন্নত, অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যের কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলায় ছাত্রছাত্রী এবং জনগণকে শিক্ষিত করে তুলতে পারবেন?

আমার অতি প্রিয় সম্মানিত শিক্ষকগণ, আপনাদের সামনে সারা দেশের আন্দোলনরত নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীরা এক মহাসুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। শিক্ষাঙ্গন এবং ছাত্রাবাসগুলো অছাত্র এবং সন্ত্রাসীদের হাত থেকে মুক্ত করে শুধু বৈধ ছাত্রছাত্রীদেদের জন্য তা অবারিত রাখার ব্যবস্থা করা এ মুহূর্তে আপনাদেরই কর্তব্য। আমি জানি, উপাচার্য থেকে শুরু করে প্রভাষক পর্যন্ত সব শিক্ষক এমন একটি শিক্ষাঙ্গনের প্রত্যাশায় কত যুগ থেকে অপেক্ষা করছেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষকদের সাহায্যে এগিয়ে আসুন, আমলাদের পরামর্শে তাঁদের অনুগত করার বদলে মুক্তচিন্তার অগ্রদূত হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করুন। বাজেটে অন্য খাত থেকে কমিয়ে হলেও শিক্ষা ও গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ অন্ততপক্ষে দ্বিগুণ করুন। নির্বাচনে শিক্ষকদের অনৈতিক কাজে নিয়োজিত করার বদলে তাঁদের ন্যায় ও সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে দিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে দলীয় বিবেচনার বদলে যোগ্য শিক্ষকদের নিয়োগ দিয়ে স্বাধীনভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে দিন। এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাজীবন শেষে যে আত্মমর্যাদাবোধ ও প্রকৃত মেধাসম্পন্ন ছাত্রছাত্রীরা সামনের দিনগুলোয় কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করবে, তারা নিজেরাই অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশে নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। শুধু সরকারি চাকরির জন্য যৌবনের অমিত সম্ভাবনা গাইড বই মুখস্থে অপচয় করে মেধাহীন পদাধিকারী হওয়ার ইঁদুরদৌড়ে যোগ দেওয়ার প্রয়োজন তাদের পড়বে না।

মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে কথিত রাষ্ট্র মেরামতের কাজ জামায়াত-বিএনপি এবং পথভ্রষ্ট বামদের নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, আপনি বাংলাদেশের জন্য Last of the Mohicans। শুধু একজন প্রধানমন্ত্রী নয়, একজন নির্মোহ, সাহসী সংস্কারক হিসেবে কঠিন হাতে দল, পরিবার ও চারপাশের স্তাবকদের বেড়াজাল থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে বাংলাদেশে সুশাসন, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ, স্বচ্ছ, টেকসই ও কালো টাকা মুক্ত নির্বাচনব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে সংস্কারকাজে জীবনের বাকি দিনগুলো উৎসর্গ করুন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা আপনি। সামনের হাজার বছরে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার যে সুযোগ এখনো আপনার সামনে আছে, তা হেলায় হারাবেন না। সিদ্ধান্তগুলো নিঃসন্দেহে কঠিন। তবে আপনাকেই তা নিতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, সত্যিকার অর্থেই আপনার হারাবার কিছু নেই।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর