শুক্রবার, ১৯ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

মমতাময়ী মায়ের চেয়েও বান্দাকে বেশি ভালোবাসেন আল্লাহ

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

মমতাময়ী মায়ের চেয়েও বান্দাকে বেশি ভালোবাসেন আল্লাহ

গভীর রাত। আকাশে থালার মতো বড় চাঁদ উঠেছে। কিছুক্ষণ পরপর মেঘে ঢাকা পড়ছে চাঁদখানা। মেঘ চলে যেতেই আবার চাঁদের হাসি দুনিয়া মাতিয়ে তুলছে। এমন মনকাড়া চাঁদনিরাতে জায়নামাজে বসে ডুকরে কাঁদছেন জামাল সাহেব। মাহফিল শেষে ক্লান্ত শরীর বিছানায় দেওয়ার পর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি। ঘুম ভেঙেছে জামাল সাহেবের কান্নার আওয়াজে। আজ মাহফিল ছিল পাশের গ্রামে। জামাল সাহেব শক্ত করে ধরেছেন রাতটুকু তার বাসায় থাকতে হবে। আমি সচরাচর মাহফিল করে ঢাকায় ফিরে আসি। তবে জামাল সাহেব এমনভাবে বললেন তার কথা ফেলতে পারলাম না। চোখ খুলে মোবাইলে সময় দেখলাম। এখনো ফজরের ঘণ্টাখানেক বাকি। জামাল সাহেব পারফেক্ট সময়ই বেছে নিয়েছেন। হাদিসের ঘোষণা অনুযায়ী প্রতি রাতে এ সময় আল্লাহতায়ালা দুই হাত মেলে বান্দাকে ডাকতে থাকেন। গুনাহগারের গুনাহ ক্ষমা করার জন্য, অসুস্থকে সুস্থতার জন্য প্রভুর এমন মায়াবী ডাক উপেক্ষা করে আমরা ঘুমিয়ে থাকি অঘোরে। হায়! এভাবেই প্রভুর প্রিয় হওয়ার সুযোগ হেলায় নষ্ট করে মানুষ। নিঃশব্দে উঠে বসলাম। হাজত শেষে অজু করে আমিও ঝাঁপিয়ে পড়লাম মাওলাপাকের ক্ষমার দরিয়ায়। জানি না সেদিন কেমন রাত ছিল। প্রতিটি মুহূর্তেই জীবনের গুনাহর কথা মনে পড়তে লাগল। ছোট্ট এ জীবনে কত নেয়ামতই না ভোগ করাচ্ছেন আল্লাহতায়ালা। এমন এমন নেয়ামত আল্লাহ দিয়েছেন যার কোনো যোগ্যতাই আমার নেই। এমন এমন সম্মানের চেয়ারে আল্লাহ বসিয়েছেন যেখানে বসার জন্য এক জীবন সাধনা করতে হয়। আমিও মোনাজাত ধরলাম। হু করে কেঁদেকেটে ক্ষমাভিক্ষা চাইলাম। ইমান-তাওয়াক্কুল-সবর চাইলাম। ভিতরটা কেমন যেন পরিষ্কার পরিষ্কার মনে হলো। আজানের বেশি বাকি নেই। কিছুক্ষণ কোরআন তেলাওয়াত করব ভেবে বাতি জ্বালানোর জন্য দাঁড়াতে যাব এমন সময় জামাল সাহেব আমার জামা টেনে বসিয়ে দিলেন। বললেন, মাওলানা সাহেব! বসেন, কিছুক্ষণ কথা বলি। মাওলার কথা বলি। মাওলার আলোচনার মধ্যে যে শান্তি পাওয়া যায় পৃথিবীর আর কোনো কিছুতে এমন শান্তি পাওয়া যায় না। মনটা আনন্দে ভরে গেল। এই জামাল সাহেবই তো বছর কয়েক আগে আমার হাত ধরে গুমরে কেঁদে বলেছিলেন সব থেকেও তার হৃদয়ে শান্তি নেই। আজ তিনি শান্তির খোঁজ পেয়ে গেছেন। মাওলার জিকিরের শান্তি। আমি বললাম, জামাল সাহেব! আজ আপনি বলবেন, আমি শুনব। আপনার ভিতর যে নুরের বাতি জ্বালিয়েছেন, সেখান থেকে একটু আলো এ গুনাহগারকে দিন। আমার কথা শুনে জিবে কামড় দিয়ে তিনি বললেন, ছিঃ ছিঃ এভাবে বলবেন না। আপনি দেশ-বিদেশে ওয়াজ করে বেড়ান। সত্যি বলতে, আপনার অসিলায় কিন্তু মাওলাপাকের পথ পেয়েছি। আসলে কি জানেন, আপনার মুখে একটা হাদিস অনেকবার শুনেছি, এখন সে হাদিসখানা জীবন্ত সত্য হয়ে ধরা দিয়েছে আমার জীবনে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, কোনো মমতাময়ী মা তার সন্তানকে যেমন ভালোবাসে তার চেয়ে নিরানব্বই গুণ বেশি আমি বান্দাকে ভালোবাসি। মরুর বুকে কোনো পথচারী তার হারানো উট ফিরে ফেলে যেমন খুশি হয়, আমার কোনো বান্দা যখন আমার কোলে ফিরে আসে আমি তার চেয়ে বেশি খুশি হই। আল্লাহ ওয়াদা করেছেন, বান্দা যখন তার জন্য উঠে দাঁড়ায়, আল্লাহ তখন বান্দার জন্য হাঁটা শুরু করেন। বান্দা যখন আল্লাহর দিকে হাঁটা শুরু করেন, আল্লাহ তখন বান্দার দিকে দৌড়াতে থাকেন। বান্দা এক বিঘত এগোলে আল্লাহ এক হাত এগোন। বান্দা এক হাত এগোলে আল্লাহ এক গজ এগিয়ে আসেন। বান্দা আল্লাহকে দুনিয়ার মজলিসে স্মরণ করলে আল্লাহ বান্দাকে আরশে ফেরেশতাদের মজলিসে স্মরণ করেন। (সহিহ মুসলিম)। মনের কান লাগিয়ে জামাল সাহেবের কথাগুলো শুনছিলাম। যদিও এ হাদিস অনেকবার পড়েছি, বলেছি; কিন্তু আল্লাহকে উপলব্ধি করা একজন মানুষের মুখ থেকে শোনার পর মনে হলো যেন নতুন করে হাদিসটি জানলাম। আজ জামাল সাহেবের মনের দুয়ার খুলে গেছে। অন্যরকম এক তৃপ্তি নিয়ে তিনি মাওলাপাকের আলোচনা করছেন। তিনি বললেন, মাওলানা সাহেব! বান্দার প্রতি আল্লাহর সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ কী জানেন? বান্দা যখন কোনো ভালো কাজের নিয়ত করে, আল্লাহ সঙ্গে সঙ্গে তার জন্য সওয়াব লেখা শুরু করে দেন। ফেরেশতারা বলেন, হে আল্লাহ! তোমার বান্দা তো কেবল নিয়ত করেছে, এখনো সে কাজে পরিণত করেনি; তাহলে তার জন্য কেন সওয়াব লেখার নির্দেশ দিয়েছেন? জবাবে আল্লাহ বলেন, নিয়তের কারণেই তাকে অঢেল সওয়াব দেওয়া হবে। যতক্ষণ সে কাজটি না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার জন্য সওয়াব লিখতে থাকো। কাজটি করা হয়ে গেলে তার জন্য আলাদা সওয়াব লেখা হবে। কিন্তু বান্দা যখন কোনো গুনাহর নিয়ত করে তখন কিন্তু তার জন্য কোনো গুনাহ লেখা হয় না। ফেরেশতারা বলেন, হে আল্লাহ! তোমার বান্দাহ তো গুনাহর নিয়ত করেছে, এখন কি গুনাহ লেখা শুরু করব? আল্লাহ বলেন, অপেক্ষা করো, হয়তো সে কাজটি করবে না। যখন বান্দা গুনাহ করে ফেলে তখনো নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গুনাহটি লেখা হয় না। আল্লাহ অপেক্ষা করেন বান্দা তওবা করে কি না। অবশেষে যখন গাফেল বান্দা তওবা করে না তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দার আমলনামায় কেবল একটি গুনাহ লিখে রাখো। সুবহানাল্লাহ। (হাকেম আল মুসতাদরাক)।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর আউলিয়ানগর

সর্বশেষ খবর