শনিবার, ২০ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

আমাদের সময়কার নায়ক

ইমদাদুল হক মিলন

আমাদের সময়কার নায়ক

॥ দুই॥

বন্ধুদের মধ্যে সবচাইতে প্রতিভাবান আফজাল হোসেন। সবচাইতে আত্মমগ্ন। সবচাইতে খুঁতখুঁতে। আবেগ চেপে রাখার বিস্ময়কর ক্ষমতা আছে তার। বুক ফেটে গেলেও চোখে সহজে পানি আসবে না। একই সঙ্গে বহু বিষয়ে ভাবতে পারে। হাঁটাচলা, পোশাক-আশাক, জীবন আচরণে সম্পূর্ণ এক শিল্পীমানুষ। এক সময় নতুন ধরনের পোশাক পরতে শুরু করেছিল আফজাল। শার্টের কার্টিং নতুন ধরনের। প্যান্টগুলো অন্য রকম। নিমার মতো অভিনব ধরনের হাফশার্ট বা ফতুয়া। কারও সঙ্গে মেলে না এমন ফুলসিøভ শার্ট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিউমার্কেট কিংবা গাউছিয়া মার্কেটের থান কাপড়ের দোকানগুলোতে ঘুরে বেড়াত। চার পাঁচ ছয়ঘণ্টা ঘুরে নানা রকমের কাপড় কিনত। আমরা বন্ধুরা কেউ না কেউ তার সঙ্গে আছি। দিদার কিংবা আমি। আরেফীন কিংবা আলম। এক দোকানে একটি কাপড় অনেকক্ষণ ধরে দেখে আরেক দোকানে গেল। সেই দোকানেও অনেকটা সময় কাটিয়ে আবার হয়তো ফিরে এলো আগের দোকানটিতে। হয়তো প্রথম দেখা কাপড়টিই কিনল। এই ফাঁকে দুই-তিনঘণ্টা কেটে গেছে। আমার এত রাগ লাগত! সঙ্গে আলম আরেফীন বা দিদার যেই থাকুক, ওদের সঙ্গে গজগজ করতাম। কিন্তু আফজালকে বলা যাবে না কিছুই। সে নির্বিকার চিত্তে তার মতো করে কাপড় কেনার জন্য ঘুরছে। তারপর আছে নির্দিষ্ট দর্জির দোকান। দর্জিকে নানা রকমভাবে বোঝানো। সেখানেও এক দেড়ঘণ্টা। আমার শুধু মনে হতো, এত দেখাদেখির কী আছে! যেটা পছন্দ হয়েছে, কিনে নিলেই তো হয়। অযথা সময় নষ্ট। কিন্তু যখন নতুন তৈরি শার্ট বা প্যান্ট পরে বেরুত আফজাল, আমরা মুগ্ধ হয়ে যেতাম। একই মানুষ যে একই হাতে এত রকমের কাজ করতে পারে, আফজালকে গভীরভাবে যারা না দেখেছে, তারা তা ভাবতেই পারবে না।

কিশোর বয়স থেকে ছবি আঁকে। ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটের স্নাতক। ফ্ল্যাটে ছবি আঁকার স্টুডিও। প্রতিদিন ছবি আঁকে। ছবিতে ছবিতে ফ্ল্যাট অফিস ভর্তি। প্রায় পঞ্চান্ন বছর ছবি আঁকার জীবনে একটিও একজিবিশন করল না। কতবার আমরা উৎসাহিত করেছি। ওর শিক্ষক কিংবা সহশিল্পীরা উৎসাহিত করেছেন। ‘‘এই তো এবার করব। ছবি গুছাচ্ছি।’’ এত এত বছর ধরে ছবি গুছানো চলছেই। একজিবিশনটা আর হচ্ছে না। এক সময় আমি প্রায়ই তাগিদ দিতাম। এখন আর বলি না। এত খুঁতখুঁতেও মানুষ হতে পারে? অথচ আমাদের চারপাশের কত তরুণ ও তরুণতর, নবীন শিল্পী নিজের ছবির একটার পর একটা একজিবিশন করছেন। আফজাল সেসব একজিবিশন দেখতে যায়। কোনো কোনো শিল্পীর প্রশংসায় মুখর হয়। শুধু নিজের একজিবিশনটা করা হয় না তার। এক সময় ‘অর্ক’ নামে কার্টুন করত। সম্ভবত ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকায় ছাপা হতো। ’৭৪/’৭৫ সালের কথা। ‘পূর্বদেশ’-এর ছোটদের পাতা ‘চাঁদের হাট’ এর গল্পগুলোর ইলাশট্রেশন করত। ‘কিশোর বাংলা’য়ও একই কাজ। পাশাপাশি ছোটদের গল্প-কবিতা লেখা। পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের (বাহাদুর শাহ্ পার্ক) উল্টো দিককার সরু একটা গলির ভিতর ছিল ‘রোমাঞ্চ’ পত্রিকার অফিস। অলক বারি ছিলেন সম্পাদক। বুলবুল চৌধুরী, শেখ আবদুল হাকিম, পরবর্তীতে কিছুটা আমি নিয়মিত লিখতাম ওই পত্রিকায়। রহস্য-রোমাঞ্চ ঘেরা গল্প-উপন্যাস। পত্রিকাটি জনপ্রিয় ছিল। এই পত্রিকাতেও ইলাশট্রেশন করত আফজাল। শাহজাহান সাহেব ‘চিত্রকল্প’ নামে মাসিক পত্রিকা করতেন। সাইজ কলকাতার ‘উল্টোরথ’ ধরনের। চরিত্রও তাই। পরে পত্রিকাটির দায়িত্ব নিয়েছিলেন লেখক বুলবুল চৌধুরী ও সিরাজুল ইসলাম। তাঁদের সঙ্গে আমিও ছিলাম। এই পত্রিকাতেও আফজাল ইলাশট্রেশন করত। অনেক পরে সাপ্তাহিক ‘বিপ্লব’ নামে একটি পত্রিকা বেরিয়েছিল। সেখানে আফজাল কাজ করত। গেটআপ, মেকাপ, প্রচ্ছদ ইত্যাদি সবই তার। খুবই দৃষ্টিনন্দন পত্রিকা। আঙ্গিকটা ছিল ‘বিচিত্রা’ কিংবা ‘রোববার’ পত্রিকার মতো। অফিস সেগুনবাগিচায়। পরে সেই বাড়িটিতে ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’ হয়েছিল। আফজাল যেখানেই কাজ করত আমরা কোনো না কোনো বন্ধু তার সামনে বসে থাকতাম। আফজাল একা থাকতে পছন্দ করে না। তখন ‘প্রচ্ছদশিল্পী’ হিসেবেও ধীরে ধীরে নিজের একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করছিল সে। আমার প্রথম কিশোর উপন্যাস ‘চিতা রহস্য’র প্রচ্ছদ করল। ‘মুক্তধারা’ থেকে বইটা বেরিয়েছিল। সেই প্রচ্ছদ আজও আমার চোখে লেগে আছে।

‘চিতা রহস্য’ নিয়ে একটা মজার কাণ্ড হয়েছিল। ততদিনে আফজাল যুক্ত হয়েছে ‘ঢাকা থিয়েটার’ এর সঙ্গে। সেলিম আল দীন, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী, শিমুল, আসাদ, সুবর্ণা, পীযুষ, তারও পরে ফরীদি। এঁরাই ‘ঢাকা থিয়েটার’। অন্যদিকে আফজাল টেলিভিশনেও যুক্ত হয়েছে। আবদুল্লাহ আল মামুনের প্রযোজনায় ‘রাইফেল’ নাটক দিয়ে তার নায়ক জীবন শুরু হলো। আফজাল ধীরে ধীরে তার পাপড়ি ছড়াতে লাগল।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এসেছেন ঢাকায়। বোধহয় ’৭৮ সাল। ‘কিশোর বাংলা’ তখন খুবই জনপ্রিয় পত্রিকা। প্রথম ঈদ সংখ্যায় রহমানের তাড়ায় আমি ‘চিতা রহস্য’ লিখেছি। ছবি এঁকেছে আফজাল। শহীদ আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী মিনুআপা থাকেন পুরানা পল্টনের একটি বাড়িতে। ‘জোনাকী’ সিনেমা হলের ওদিককার রাস্তায় বাড়িটি। সেখানে ‘ঢাকা থিয়েটার’ এর রিহার্সেল হয়। এক বিকেলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাঁকে ঘিরে আড্ডা। আফজাল আমাকে নিয়ে গেছে। আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন ছোট। বোধহয় সিক্স সেভেনে পড়ে। ভিতর থেকে কে যেন তাকে বলে দিয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অটোগ্রাফ নিয়ে আসতে। শাওন ‘চিতা রহস্য’ পড়েছে। সে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে চেনে না, চেনে ‘চিতা রহস্য’র লেখককে। খাতা-কলম নিয়ে এসে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। ‘অটোগ্রাফ দাও।’ আমি হতভম্ব ও লজ্জিত। কে যেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখিয়ে বলল তাঁর অটোগ্রাফ নিতে। শাওন নেবে না। সে শুধু আমাকে বলছে, ‘না না, তুমি দাও’। এই ঘটনা নিয়ে পরে আফজাল ‘কিশোর বাংলা’য় একটা লেখা লিখেছিল, ‘শাওনদের চিতা রহস্য’।

আমার বহু বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছে আফজাল। ‘মাত্রা’র অফিস তখন পুরানা পল্টন থানার উল্টো দিককার গলির ভিতর। প্রচ্ছদের জন্য আফজালের ওখানে গিয়ে বসে থাকতাম। এই আঁকছি, এই আঁকছি করে দিনের পর দিন পার করছে। আমিও লেগেই আছি। একদিন হয়তো অনেকটা রাত পর্যন্ত বসে থাকলাম। এক সময় বলল, ‘কাল আসিস’। সেই ‘কাল’ আর সহজে আসত না। তারপর হয়তো এক স্বর্ণালী সন্ধ্যায় আঁকতে বসল। আঁকে আর ছিঁড়ে ফেলে। হয়তো প্রচ্ছদ শেষ হয়ে গেছে, অনেকক্ষণ সেই প্রচ্ছদের দিকে তাকিয়ে নির্বিকার চিত্তে ছিঁড়ে ফেলে দিল। “না হয়নি। কাল আয়”। আমার তো প্রচ্ছদটা ভালোই লাগছিল। কিন্তু আফজাল বলে কথা! অমন খুঁতখুঁতে চরিত্র! নিজের পছন্দ না হওয়া পর্যন্ত কিছুতেই সেই কাজ ছাড়বে না। তবে আমার বইয়ের অবিস্মরণীয় কয়েকটি প্রচ্ছদ আফজাল করেছিল। ‘নায়ক’, ‘দিনগুলি’, ‘তোমাকে ভালোবাসি’। এই প্রচ্ছদগুলোর কোনো তুলনা হয় না। আফজাল প্রচ্ছদ আঁকছে, আর আমি সিগারেট টানছি। সে সিগারেট খায় না। আমি খুব চেষ্টা করি ওকে সিগারেট ধরাবার। একবার বাজি ধরলাম, সিগারেট ওকে ধরাবই। আফজাল বলল, ‘পারবি না’। পরদিন থেকে প্রতিদিন আফজালকে এক প্যাকেট করে ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেট কিনে দিতে লাগলাম। সে খেতেও লাগল। এভাবে এক মাস। তারপর আর সিগারেটের ধারে-কাছেও নেই। সিগারেট ওকে ধরাতেই পারলাম না। ছুঁয়েও দেখে না। কী অসম্ভব মনের জোর! আফজালের জন্য আমিও একদিন একটা মনের জোর দেখিয়ে ফেললাম। অবিরাম ফুঁক-ফুঁক করে সিগারেট টানি। দেড়-দুই প্যাকেট সিগারেট লাগে রোজ। আফজাল একদিন রেগে গেল। ‘তোর কোনো মনের জোর নেই। সিগারেটটা তুই ছাড়তেই পারলি না।’ কথাটা আমার খুব মনে লাগল। হাতের সিগারেট অর্ধেক শেষ হয়েছে। অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে বললাম, ‘এই মুহূর্ত থেকে আর খাব না।’ স্থান, ‘মাত্রা’ অফিস, পুরানা পল্টন। তারিখ ২০ অক্টোবর, ১৯৮৮। তারপর থেকে আমি আর সিগারেট খাইনি। কত কত বছর কেটে গেল!

অভিনব আইডিয়ায় আফজালের কোনো তুলনা হয় না। সে গল্প-কবিতা লেখে। হাসান হাফিজ আর মাসুদুজ্জামানের ছোট সাইজের কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছে। ওই আঁকতে আঁকতে প্ল্যান করল, ওর আর আমার যৌথ একটি গল্পের বই বের করবে। বইটির দুই দিকেই প্রচ্ছদ। দুই দিক থেকেই খোলা যাবে। একদিক থেকে খুললে ওর গল্প, অন্যদিক থেকে খুললে আমার গল্প। বইয়ের নাম ‘যুবকদ্বয়’। ’৮০র দশকের শুরুর দিককার খুবই আলোচিত বই। উপন্যাস লেখার জন্য আফজালকে আর আমাকে আরামবাগের অফিসে মোস্তাফা জব্বারভাই তাঁর অফিসের একটা রুমে তালাবন্ধ করে রেখেছিলেন। তিনি ‘নিপুণ’ পত্রিকার ঈদ সংখ্যা করবেন। দেশে ফটো কম্পোজ এসেছে। বন্দি অবস্থায় আমরা দু’জন উপন্যাস লিখলাম। আফজালের উপন্যাসের নাম ‘বিরহকাল’। আমারটা ‘দেবদাস ’৮১। পরে ‘আজকের দেবদাস’ নামে বই হয়েছিল। আফজাল বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখেছে। কবিতা লিখছে নিয়মিত। গত দশ পনেরো বছরে কবিতার বইও বেরিয়েছে তিন চারটা। জার্মানিতে যাওয়ার আগে ‘রোববার’ পত্রিকায় কাজ করতাম আমি। ‘আশপাশে’ নামে কলাম লিখতাম সেখানে। একটি কলামে সেই সময় লেখা ওর একটা কবিতার লাইন ব্যবহার করেছিলাম। লাইনটি এখনো মনে গেঁথে আছে। ‘নদীর কাছে পাওনা ছিল গোপন বিহার’। আফজালের গল্প-উপন্যাস আর কবিতা পড়ে আমার মনে হয়েছে অন্য কোনো কাজ না করে সে যদি শুধু লেখালেখি করত, তা হলেও আমাদের সাহিত্যে একটি ভালো অবস্থান তৈরি করতে পারত।

আফজাল চমৎকার ছবি তোলে। শুধু ছবি তোলার ক্ষেত্রে লেগে থাকলেও সেই জায়গাটি অনেকখানি আলোকিত করতে পারত। ’৮৬ সালে প্রথমবার কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিলাম আমরা। সীবিচে আমার আর আমার স্ত্রীর একটা ছবি তুলে দিয়েছিল। তখন বাংলাদেশে ছবির বড় প্রিন্ট হত না। ছবিটা ব্যাংকক থেকে বড় করে আনাল। বাঁধাই করে আমাকে উপহার দিল। সেই ছবি এখনো আমার বেডরুমে। আফজাল আরেফীন আর আমি গিয়েছি ইন্দোনেশিয়ার বালিদ্বীপে, একটা সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে। একদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বেশ কয়েক ঘণ্টা আফজাল শুধু আমার ছবি তুলল। হলিডে ইন হোটেলের পিছন দিককার বাগানে আর সীবিচে। ওর এরকমই নেশা। কোনও কিছু মাথায় ঢুকলে, যতক্ষণ সেটা মাথা থেকে না নামবে, চালিয়ে যাবে। আমি খুবই বিরক্ত হচ্ছিলাম। কিন্তু প্রকাশ করার উপায় নেই। আমার দিকে তাকিয়ে আরেফীন মিটিমিটি হাসছিল।

আফজালের জন্য দুটো নাটকে অভিনয় করতে হয়েছে আমাকে। দুটোতেই উপস্থিত ছিলাম লেখক হিসেবে, নিজস্ব পরিচয়ে। একটি সেলিম আল দীনের লেখা, আরেকটি আনিসুল হকের। আনিসুল হকের একটি সিরিজেও নিজের চরিত্রে অভিনয় করেছি। একটি মাত্র দৃশ্য। পরিচালক মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী। আমাকে নিয়ে একটা বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরি করেছিল আফজাল। ধানমন্ডির একটা শুটিং হাউসে প্রায় সারারাত শুটিং করল। একজন লেখককে নিয়ে বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণের চমৎকার আইডিয়া। একটি ব্যাংকের বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনচিত্রটি প্রচারিত হলো না। পরে শুনেছি, ব্যাংক পরিচালকদের একজন বিজ্ঞাপনচিত্রটি প্রচারে বাধা দিয়েছেন। তার বক্তব্য, “একজন লেখককে কেন প্রমোট করবেন”। শুনে আমার খুব হাসি পেয়েছিল। ভদ্রলোকটি মূর্খ। তিনি বুঝতেই পারেননি, একজন নগণ্য ব্যাংক পরিচালকের লেখককে প্রমোট করার কোনো যোগ্যতাই নেই। বরং লেখকই তাদের প্রমোট করছিল।

তখনো ‘মাত্রা’ পথচলা শুরু করেনি। ‘দোয়েল’-এর শেষ পর্যায়। ‘পিয়ারসন্স’ নামের একটি পোশাক কোম্পানির বিজ্ঞাপনের কাজ এসেছিল হাতে। আফজাল বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ করল। কয়েকটি ঘোড়া ব্যবহার করা হলো বিজ্ঞাপনচিত্রে। তখন একটি মাত্রই টিভি চ্যানেল। ‘বিটিভি’। বিটিভিতে প্রচারের পর সেই বিজ্ঞাপনচিত্র নিয়ে দিকে দিকে সাড়া পড়ে গেল। আফজালের হাতে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের আধুনিক বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণের যুগ। পথটা দেখিয়ে দিল সে। তারপর থেকে একের পর এক অসামান্য সব বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ করেছে। এক্ষেত্রে আফজালের তুলনা আফজালই। মনে আছে, ‘পিয়ারসন্স’-এর খুদে মডেল হয়েছিল ফেরদৌস নামে একটি শিশু। শিশুটি আরেফীনের এক ভাইয়ের। আমাদের ‘চাচা’ ডাকে। পরবর্তীতে সেই শিশুই নায়ক ফেরদৌস। অভিনেতা থেকে এক সময় নেতা হলো ফেরদৌস। সংসদ সদস্য হলো।

আফজালের প্রথম সিনেমা ‘নতুন বউ’। নায়িকা ববিতা। রিলিজের পর প্রথম শো দেখতে বন্ধুরা আফজালকে নিয়ে দলবেঁধে গিয়েছিলাম ‘মধুমিতা’ সিনেমা হলে। সে তখন বেশ সিøম। দৃশ্য ধারণের জন্য ববিতাকে পাঁজাকোলে নিতে গিয়ে বাঁকা হয়ে গিয়েছিল। মঞ্চনাটকে আফজাল স্মরণীয় হয়ে আছে সেলিম আল দীনের ‘কেরামত মঙ্গল’ নাটকের জন্য। সেই নাটকে তার চরিত্রের নাম ছিল ‘চশমা ডাকাত’। মঞ্চ-নাটকপ্রিয় দর্শক এখনো সেই চরিত্রের কথা মনে রেখেছে, আফজালের কথা মনে রেখেছে। সেলিম ভাইয়ের ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসি’ নাটকেও মঞ্চ মাতিয়ে দিয়েছিল আফজাল। ‘ঢাকা থিয়েটার’-এর বেশ কয়েকটি নাটকের মঞ্চ পরিকল্পনা তার। অসামান্য সব পোস্টার আঁকত নাটকের জন্য। বেইলি রোড এলাকার দেওয়ালগুলো ভরে থাকত সেসব পোস্টারে। আমার ‘নদী উপাখ্যান’ উপন্যাস অবলম্বনে মঞ্চনাটক করেছিল বরিশালের ‘শব্দাবলী গ্রুপ’। এক রঙে অপূর্ব একটা পোস্টার করে দিয়েছিল আফজাল।

কত স্মৃতি আফজালকে নিয়ে। এরশাদের আমল। দেশে সেনা শাসন চলছে। রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে হয় সাবধানে। সেনা সদস্যরা টহল দিচ্ছেন। রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকছেন। আফজাল আরেফীন আর আমি তিনজন চড়েছি এক রিকশায়। সজলদা থাকেন মালিবাগের আবুজর গিফারী কলেজের গলিতে। তাঁর ফ্ল্যাটে যাচ্ছি। দু’জন সেনা রিকশা থামালেন। অপরাধ তিনজন রিকশায় চড়েছি। রিকশা থেকে নামালেন। আফজাল আর আরেফীন গিয়ে সামনে দাঁড়াল। আফজাল টিভি নায়ক। জনপ্রিয় মুখ। আরেফীনের চেহারা ভালো। ভাবলাম, ওদের দু’জনকে সেনা সদস্যরা কিছুই বলবেন না। আমার নাকের তলায় লম্বা গোঁফ। চেহারা খারাপ। নিশ্চয় আমাকে ধরবেন। পেছন থেকে নিঃশব্দে পালিয়ে গেলাম। এই নিয়ে পরে অনেক হাসাহাসি হয়েছে। আফজাল আরেফীনকে কিছুই বলেননি সেনা সদস্যরা।

বিটিভিতে নাটক করার ফাঁকে ফাঁকে বেশ কয়েকটি ‘ঈদ আনন্দমেলা’ করেছে আফজাল। প্রতিটিই জনপ্রিয় হয়েছে। ‘আপনপ্রিয়’ নামে একটি শো করত। সঙ্গে সুবর্ণাও ছিল। সেই অনুষ্ঠানটি যে কী জনপ্রিয় হয়েছিল! একটি অনুষ্ঠানে আমিও একবার যোগ দিয়েছিলাম। আমাকে টেলিভিশনের পথটা আসলে আফজালই দেখিয়েছিল। আমার গল্প থেকে প্রথম নাটক হলো ‘মায়াকানন’। আফজাল-সুবর্ণা অভিনয় করল। তখন এই জুটির নাটক মানেই তুমুল জনপ্রিয়। ‘মায়াকানন’ও জনপ্রিয় হলো। আমি তখনো নাটক লিখতে শিখিনি। আবদুল্লাহ আল মামুন বললেন সিরিজ নাটক লিখতে। বেশ ফাঁপরে পড়ে গেলাম। উদ্ধার করল আফজাল। তখন আমি প্রায় রাতই কাটাই ওর সঙ্গে। ওর মনিপুরী পাড়ার ফ্ল্যাটে থেকেছি বহু রাত। মতিঝিল কলোনির বাসায় থেকেছি। গ্রিন রোডের ফ্ল্যাটে কাটিয়েছে সবচাইতে বেশি রাত। পান্নার সঙ্গে আফজাল শেয়ার করে থাকে। ওর রুমে বসে শুরু হলো নাটক লেখার কাজ। আফজাল সাজিয়ে দেয় আর আমি লিখি। নাটকের নাম ‘নায়ক’।

এই নাটক নিয়ে হয়ে গেল অনেক নাটক। পরিচালনা করার কথা ছিল আবদুল্লাহ আল মামুনের। শেষ পর্যন্ত করতে পারলেন না মামুনভাই। দায়িত্ব দিলেন ফিরোজ মাহমুদকে। ব্যাপারটা আফজাল বা আমার কারুরই পছন্দ হলো না। তারপরও নাটকের দুটি পর্ব তৈরি হলো। প্রথম পর্ব প্রচারের পরই বন্ধ হয়ে গেল। অপরাধ? নাটকটি অতি আধুনিক। ছেলেমেয়ের বন্ধুত্ব এবং তুই তুকারি সম্পর্ক ইত্যাদি ইত্যাদি কারণে ‘নায়ক’ আর প্রচারিতই হলো না। অভিমান করে বিটিভিতে যাওয়া ছেড়ে দিলাম আমি। আফজাল একের পর এক নাটকে অভিনয় করছে। ‘কূল নাই, কিনারা নাই’, ‘রক্তের আঙুরলতা’ এরকম অসামান্য সব নাটক। নিজে লিখছে, ‘চোরকাঁটা’র মতো নাটক। জয় জয়কার অবস্থা। আমি জার্মানিতে থাকা অবস্থায় ‘পারলে না রুমকি’ লিখে, ও সুবর্ণার সঙ্গে অভিনয় করে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে চলে গেল। এক পর্বের টিভি নাটকের ক্ষেত্রে ‘পারলে না রুমকি’ একটি মাইলফলক। আমার ‘ফুলের বাগানে সাপ’ নাটকে অভিনয় করল আফজাল। নায়িকা ওর বিজ্ঞাপনচিত্রের মডেল মুনা নামের একটি মেয়ে। এই নাটকও অতি আধুনিকতার দোষে পড়ল। অন্যদিকে তুমুল জনপ্রিয়ও হলো। আমার ‘অপরবেলা’ নাটকটিও আফজালের কারণে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। সব মিলিয়ে আমার জীবনের বহু কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আফজাল। চ্যানেল আই চত্বরে মঞ্চ তৈরি করে অনুষ্ঠান হচ্ছে। সাগর আফজাল আর আমি দাঁড়িয়ে আছি। অনুষ্ঠান ঘোষণায় একটি মেয়ে।

আফজালকে মঞ্চে ডাকার আগে পরিচয় দিল শুধু অভিনেতা হিসেবে। ব্যাপারটা আমার পছন্দ হলো না। কারও কোনো অনুমতি না নিয়ে মঞ্চে উঠে গেলাম। আফজাল কী সেটা বোঝাবার জন্য মিনিট তিনেক কথা বললাম। নেমে আসার পর সাগর বলল, ‘এই হচ্ছে বন্ধুত্ব’। আফজাল আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, ‘আজকাল কেউ কাউকে নিয়ে এভাবে বলে না রে। আমরাই বোধহয় শেষ প্রজন্ম যাদের কাছে বন্ধুত্বের মূল্য অপরিসীম।’ [আগামী সংখ্যায় সমাপ্য]

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর