রবিবার, ২১ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

চেতনা ও সংঘবদ্ধতা জরুরি

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

চেতনা ও সংঘবদ্ধতা জরুরি

দেশে হত্যা, আত্মহত্যা, ধর্ষণ আমরা দেখছি, মন্তব্যও করছি এবং যথারীতি বিষণ্ন হচ্ছি। আইন আছে, তবে বোঝাই যাচ্ছে যে আইন দিয়ে কুলাচ্ছে না। গোটা ব্যবস্থাটাই নারীর প্রতি বিরূপ। আগেও তা-ই ছিল; এখন কমেনি, বরং বেড়েছে। মেয়েদের নিরাপদ রাখা যাচ্ছে না। একাত্তরে হানাদার পাকিস্তানি দস্যুরা যা করত, এখন স্বদেশি যুবকরা সেই একই কাজ করছে। একাত্তরে আমরা লড়ছিলাম দস্যুদের তাড়াতে; ভরসা ছিল তারা পালাবে। এখন তো সেই ভরসাটা আর নেই; এখন তো স্বদেশিরাই ঘাতক।

তা স্বাধীনতা পেয়ে আমরা অবশ্যই অনেক দূর এগোলাম; মেয়েরাও এগিয়েছে। সব ক্ষেত্রেই বলা যাবে। যে চার নারী ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকার মদের দোকানের সামনে মদ্যপ অবস্থায় মারামারি করেছেন, চুলোচুলিতেও থামেননি, পরস্পরকে বিবস্ত্র করার উদ্যোগ নিয়েছেন একাত্তরের আগে তাঁরা যে অতটা স্বাধীনতা ভোগ করতেন এমনটা অবশ্যই বলা যাবে না; কিন্তু ওই যে বললাম, মেয়েদের নিরাপত্তার খবর কী? যৌন হয়রানি বাড়ল না কমল? বোরকা ও হিজাবের ব্যবহার তো স্বাধীনতার আগে অতটা দেখা যায়নি, এখন যতটা দেখা যাচ্ছে। এসবের ব্যাখ্যা কী? ব্যাখ্যা একটাই এবং সেটা বেশ সরল। ব্যাখ্যা হলো উন্নতি অবশ্যই ঘটেছে, তবে সেটা পুঁজিবাদী লাইনে। পুঁজিবাদী উন্নয়ন পিতৃতান্ত্রিক এবং বৈষম্যমূলক। সে উন্নয়ন সবলকে প্রবল করে, দুর্বলকে করে দুর্বল। সব ক্ষেত্রেই সেটা সত্য, বিশেষভাবে সত্য মেয়েদের বেলায়।

নারীর নিরাপত্তাহীনতার কাহিনি শেষ হওয়ার নয়। লেখাটি শেষ করার আগেই জানা গেল, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় সংঘবদ্ধ একটি ডাকাত দল গভীর রাতে একটি ঘরে প্রবেশ করে। সেখানে ঘুমাচ্ছিলেন এক মা ও তার মেয়ে। ডাকাতরা যথারীতি তাঁদের হাত-পা বেঁধে জিনিসপত্র খুঁজতে থাকে। মূল্যবান কিছু না পেয়ে তারা ক্রুদ্ধ হয় এবং কিশোরী মেয়েটিকে পাশের ঝোপে নিয়ে গিয়ে সবাই মিলে ধর্ষণ করে। জানা গেছে, ডাকাত দলের সরদার স্থানীয় একটি সুতার কলে কাজ করত। কাজ ছেড়ে দিয়ে সে এখন পেশাদার ডাকাত হয়েছে এবং ১০-১২ জনের একটি দল গড়েছে [খবরের কাগজ, ২১ মে]। আরও একটি খবর চট্টগ্রাম থেকে : ডেকে নিল পুলিশ, নিয়ে গেল র‌্যাব, পরে পাওয়া গেল লাশ, একজন মহিলার [আজকের পত্রিকা, ১৯ এপ্রিল]। ঢাকার মোহাম্মদপুরে এক মহিলাকে শেকলে বেঁধে দলবদ্ধ ধর্ষণের খবরও বেরিয়েছে কয়েকটি পত্রিকায়। তাঁকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছিল প্রবাসী এক ব্যারিস্টারের নির্দেশে। কারণ পারিবারিক কলহ। ওদিকে মেয়েরাও যে বেপরোয়া হতে পারে তার নজিরও একেবারে বিরল নয়। যেমন এ খবরটা বলছে যে, মেয়ে তার মাকে হত্যা করেছে, মা তার বিয়ে দিচ্ছেন না বলে [প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ২৯ এপ্রিল]। গাজীপুরে দুজন পোশাককর্মী গিয়েছিলেন বৈশাখী মেলায়। একজন পুরুষ সহকর্মী ছিলেন তাদের সঙ্গে। সন্ধ্যার পর স্থানীয় কয়েকজন যুবক তাদের ধরে নিয়ে যায় একটি ক্লাবে। পুরুষটিকে আটকে রেখে মহিলাদের নিকটবর্তী এক জঙ্গলে নিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে [ডেইলি স্টার, ১৯ এপ্রিল]। ব্রিটিশ আমলে অনেক ক্লাব বিপ্লবীরা শরীরচর্চার জন্য ব্যবহার করতেন; পাকিস্তান আমলেও ক্লাব ছিল খেলাধুলার জায়গা; এখন সেখানে কাজকর্ম হয় ভিন্ন ধরনেরও।

২. এই যে ছোট ছোট সব গল্প, এগুলো তো আসলে বড় একটা গল্পেরই অংশ। সে গল্পটা উন্নতির। উন্নতি ঘটছে-সবেগে এবং সশব্দে। সভ্যতার ওপরের দিকে ওঠার ব্যাপারে বিশ্বজুড়েই এখন কোনো বিরাম নেই। প্রকৃতি জয়ের তেমন কিছু আর বাকি আছে বলেও তো মনে হয় না। মহাকাশে মানুষের যাতায়াত যে শুধু শুরু হয়েছে তা-ই নয়, সেখানে রেস্তোরাঁ পর্যন্ত চালু হতে যাচ্ছে, বিনোদনের জন্য। আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তো দরজায় টোকা দেওয়া শেষ করে এখন ধাক্কা দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে রয়েছে।

কিন্তু গল্পটা তো এ কথাও বলছে যে, এ উন্নতি মানুষকে অবনত করে দিচ্ছে। মানুষ আত্মকেন্দ্রিক, মুনাফালিপ্সু ও ভোগবাদী হয়ে উঠছে। মানুষের মনুষ্যত্ব খর্ব করার সব রকমের বন্দোবস্তই পাকাপোক্ত করা হয়ে গেছে। যে কোনো ঘটনা থেকেই এটা টের পাওয়া যায়।

গল্প নয়, সম্পূর্ণ বাস্তবিক একটি ঘটনার দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। উন্মুক্ত কয়লা খনি তৈরির সর্বনাশা উদ্যোগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের এক সমাবেশে ফুলবাড়ীতে গিয়েছিলেন; ফেরার পথে ট্রেন থেকে নামার সময় তাঁর এক পা আটকে যায় ট্রেনের চাকার নিচে। তাঁর সঙ্গে একজন সহকর্মী ছিলেন, তিনি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে না দিলে যা ঘটেছে তার চেয়েও ভয়ংকর কিছু ঘটতে পারত। আহত হয়ে আনু মুহাম্মদ যখন পড়ে গেছেন উপস্থিত লোকজনের মধ্যে তখন দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অধিকাংশই ভূমিকা নিয়েছেন দর্শকের; কিন্তু দর্শকের ভিতরও ইতরবিশেষ ছিল। কোনো কোনো দর্শক ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন মোবাইলে ছবি তোলায়। একজন নাকি ভিডিও ক্যামেরাও ব্যবহার করছিলেন। উল্লেখযোগ্য একটি দৃশ্য, সব সময় পাওয়া যায় না। উপভোগ্য, ফেসবুকে তুলে বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করার মতো। বলা যাবে স্বচক্ষে দেখেছি। কিন্তু অন্তত একজন মানুষ ছিলেন, যিনি ওই ট্রেন থেকে নেমেছেন এবং ভিড় ঠেলে অতিদ্রুত এগিয়ে এসেছেন আহত অধ্যাপককে সাহায্য করতে। এগিয়ে গিয়ে তিনি আনু মুহাম্মদের সঙ্গীর সঙ্গে মিলে রক্তাক্ত মানুষটিকে ধরাধরি করে সিএনজিতে তুলেছেন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইমারজেন্সি বিভাগে পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁর সহায়তা না পেলে ভীষণভাবে আহত ও অসহ্য যন্ত্রণায় কাতর মানুষটির পক্ষে অবশ্যম্ভাবী বিলম্ব ঘটত হাসপাতালে পৌঁছাতে।

আনু মুহাম্মদের সঙ্গে কিন্তু ওই মানুষটির কোনো পরিচয় ছিল না, জানতেন না তিনি আনু মুহাম্মদ কে। তিনি দেখেছেন একজন মানুষ আহত হয়েছেন, দেখে ভিতর থেকে তাগিদ অনুভব করেছেন তাঁকে সাহায্য করতে। তাই এগিয়ে গেছেন। পরে খবরের কাগজ পড়ে তিনি অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের পরিচয় জেনেছেন। জানতে পেরে মেডিকেলের ইমারজেন্সিতে খোঁজ নিয়েছেন এবং রোগী বার্ন ইউনিটে রয়েছেন জেনে সেখানে গেছেন জানতে আনু মুহাম্মদ কেমন আছেন। নিজের পরিচয় দিয়েছেন এই পুরান ঢাকার একজন বাসিন্দা বলে। মসলার ব্যবসা করেন। এ রকমের মানুষ কিন্তু সমাজে অনেক আছেন। এ লেখাটি লেখার সময়ই তো কলেজের এক শিক্ষার্থীর খবর পড়লাম, যে তার প্রাণ দিয়েছে একটি শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে। গাইবান্ধায়। সেটাও ট্রেনেরই ঘটনা। মা তাঁর দেড় বছর বয়স্ক শিশু সন্তানটিকে নিয়ে চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, আত্মহত্যা করবেন বলে। শিক্ষার্থীটি ছুটে গেছে তাদের বাঁচাতে। শিশুটিকে বাঁচাতে পেরেছে, মাকে বাঁচাতে পারেনি; বাঁচাতে পারেনি সে নিজেকেও [সমকাল, ২ এপ্রিল]। এ রকমের ভালো মানুষ আছেন বলেই বিপন্ন সমাজ এখনো টিকে আছে। তবে তারা বিচ্ছিন্ন, তাই ক্ষমতাহীন। ক্ষমতাবানেরা তাঁদের পীড়ন করে এবং পীড়নের আদর্শ চাপিয়ে দেয় সমাজের কাঁধে ও মস্তিষ্কে। তারা ছবি তোলে, সাহায্য করে না।

এই যে বৈপরীত্য এও বাস্তবতা। তবে শেষ ভরসা কিন্তু ওই অচেনা অজানা মানুষই। আরও স্পষ্ট বলা চলে ভরসা এঁদের মনুষ্যত্বই, যে মনুষ্যত্ব অবদমিত, পারলে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার সব রকমের চেষ্টায় পুঁজিবাদী উন্নয়নের ধারাটি সর্বদা ব্যস্ত রয়েছে। ভালোমানুষ আছেন এবং তাঁদের সংখ্যাই অধিক; তাঁরা একত্র হলে সমাজে বিপ্লব ঘটবে-কোনো এক দেশে নয়, পৃথিবীজুড়েই।

কিন্তু তাঁদের একত্র হওয়ার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সংগঠন।

প্রয়োজন বঞ্চিত মানুষের ভিতর এ বোধের সক্রিয় সঞ্চার যে বিদ্যমান ব্যবস্থাটা কোনোমতোই গ্রহণযোগ্য নয়, একে বদলানো দরকার এবং বদলানো সম্ভব। প্রতিপক্ষের ক্ষমতা আছে, কিন্তু মানুষের জাগরণ ঘটলে সে ক্ষমতা তৃণকূটার মতো ভেসে যেতে বাধ্য। তবে এটা অত্যন্ত সত্য যে, বঞ্চিত মানুষমাত্রেই বিপ্লবী নয়, বঞ্চিতরা হতাশার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে এবং করেও। তাদের জন্য এমনকি ভিক্ষুকে পরিণত হওয়াটাও কোনো কঠিন কাজ নয়। বঞ্চিত মানুষ বিপ্লবী হবে না যদি না বিপ্লবী চেতনায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে; এবং সংঘবদ্ধ হয়।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর