রবিবার, ২১ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

চিকিৎসার জন্য চাই স্বাস্থ্যবিমা

আসিফ হাসান নবী

চিকিৎসার জন্য চাই স্বাস্থ্যবিমা

২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। এটা অর্জন করতে হলে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত উপাদানগুলো বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যবিমা চালু করাও অপরিহার্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যে মোট ব্যয়ের ১৫ শতাংশ হওয়া দরকার, কিন্তু সেক্ষেত্রে আমরা একেবারে পিছিয়ে। এ দেশে চিকিৎসা সেবা নিতে মানুষের নিজস্ব ব্যয় যেখানে বর্তমানে প্রায় ৭২ শতাংশের ওপরে সেখানে স্বাস্থ্যবিমার মতো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা জরুরি।

সরকার যদিও স্বাস্থ্যবিমা চালুর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য ২০১৭ সালে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর, ঘাটাইল ও কালিহাতীতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি (এসএসকে) নামে একটি পরীক্ষামূলক স্বাস্থ্যবিমা কার্যক্রম চালু করেছে। ওই পাইলট কার্যক্রমে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারের সদস্যদের ৭৮টি ভর্তিযোগ্য রোগের বিনামূল্যে অন্তঃরোগী সেবা প্রদান করে আসছে। ওই কার্যক্রম সফল হলে সব উপজেলায় এই কর্মসূচি চালু করার কথা। কিন্তু প্রকল্পটি চালু থাকলেও এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতি নেই।

অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের মতো চিকিৎসাও একটি মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয় প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। আর্থিক অসংগতির কারণে অল্পসংখ্যক মানুষ প্রয়োজনে চিকিৎসাসেবা নিতে পারে। নিরাময় অযোগ্য রোগে আক্রান্ত প্যালিয়েটিভ রোগীসহ দরিদ্র লোকজনের জন্য তা দুরাশাই বটে। ফলে যে কোনো রোগের বা জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন মেটাতে তাকে হিমশিম খেতে হয় বা পড়তে হয় দৈন্যদশায়। এমনকি নিজের যে সম্বল আছে তার শেষটুকু বিক্রি করে বা ঋণ নিয়ে চিকিৎসাসেবা চালাতে হয়। এত কিছু করেও চিকিৎসা নিয়ে আরোগ্য হবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। নির্মম সত্য হলো- চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে পরিবারটি যে পথে বসতে পারে বা আর্থিক দৈন্যে পড়বে, তা শতভাগ সত্য। এ অবস্থায় পড়তে হতো না যদি তাদের স্বাস্থ্যবিমা থাকত। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা চালু করা অপরিহার্য। স্বাস্থ্যবিমা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এর মাধ্যমে যে কোনো ব্যক্তি খুব অল্প পরিমাণ প্রিমিয়াম প্রদানের বিনিময়ে প্রয়োজনীয় আর্থিক সুরক্ষা পেতে পারেন। এ ছাড়া চিকিৎসা ব্যয়সহ বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অপারেশনের জন্য যা খরচ তার পুরোটা বা আংশিক বিমা কোম্পানির কাছে থেকে নিতে পারেন বা কোম্পানি সেটা দিতে বাধ্য থাকবে। স্বাস্থ্যবিমার আরও অনেক সুবিধা আছে। যেমন- হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় রোগ নির্ণয়ের সব পরীক্ষা, ডাক্তারের পরামর্শ ফি, অপারেশন খরচ এবং যে কোনো অনাকাক্সিক্ষত অসুস্থতা, দুর্ঘটনা বা মেডিকেল জরুরি হলে স্বাস্থ্যবিমা আর্থিক সুরক্ষা দেয়। এর ফলে যে কোনো বিপদের মুহূর্তে বিমা পরিকল্পনার মাধ্যমে অ্যাম্বুলেন্স চার্জ থেকে শুরু করে ডে-কেয়ার পর্যন্ত সবকিছুর জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সুবিধা পাওয়া যায়। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যবিমার ব্যবহার এখনো খুব বেশি পরিমাণে নেই, কারণ অধিকাংশ বিমা কোম্পানি ব্যক্তিগত পর্যায়ে স্বাস্থ্যবিমা পলিসি প্রদান করে না। যদিও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের জন্য গ্রুপ স্বাস্থ্য ও জীবনবিমা পলিসি করে থাকে। একটি জরিপে দেখা গেছে, ব্যক্তিপর্যায়ে ‘বিপর্যয়কর’ স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে প্রতি বছর বাংলাদেশে ৪ শতাংশ মানুষ দরিদ্র হচ্ছে। দেশের চিকিৎসা পদ্ধতির এই অব্যবস্থাপনার হাত থেকে সমাজের দরিদ্র মানুষদের বাঁচাতে ‘কমিউনিটি স্বাস্থ্যবিমা’ একটি নব অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে। কমিউনিটি স্বাস্থ্যবিমা গতানুগতিক বাণিজ্যিক বিমার চেয়ে আলাদা। এটি একটি অলাভজনক বিমা ব্যবস্থা যা সমাজের মানুষের চিকিৎসা ব্যয় মেটানোর জন্য আর্থিক সুরক্ষা ও দরিদ্রদের গুণগত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে একটি কার্যকর মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। আইসিডিডিআরবি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চল চকরিয়াতে ২০১২ সাল থেকে ‘আমাদের স্বাস্থ্য’ নামে এ প্রকল্প চালু করে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং চিকিৎসাসেবায় ব্যক্তিগত খরচ ও বিপর্যয়কর স্বাস্থ্য ব্যয় কমিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে এটি একটি মডেল হিসেবে কাজ করছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন করতে হলে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি নিশ্চিত করতে হবে। দেশের কোনো মানুষ যেন চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত না হয় এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী চিকিৎসা করাতে গিয়ে যেন আরও দরিদ্র বা নিঃস্ব না হয়ে পড়ে, সে লক্ষ্যে বাংলাদেশে সবার স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্বাস্থ্যবিমা কার্যকর করা জরুরি। স্বাস্থ্যবিমা করার উদ্দেশ্যই হচ্ছে ব্যক্তির চিকিৎসা খরচ মেটানো। স্বাস্থ্যসেবার সামগ্রিক ঝুঁকি ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী, একজন বিমাকারী বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যবিমা গ্রহণ করতে পারেন। যেমন মাসিক প্রিমিয়াম অথবা পে-রোল ট্যাক্স, যা বিমার চুক্তি অনুযায়ী তার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় খরচ জোগাবে। যার ভিতর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় সব খরচ, প্রতিবন্ধিত্ব অথবা দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ প্রদান ইত্যাদি। স্বাস্থ্যবিমা কর্মসূচির আওতা প্রসারিত করে এবং স্বাস্থ্যসেবা খরচের জন্য ভর্তুকি প্রদান করে স্বাস্থ্যের জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যয় কমানো যায়। সরকার আরও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা তৈরি করে, আরও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ ও পরিষেবাগুলোকে আরও সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে পারে।

লেখক : গবেষক

সর্বশেষ খবর