সোমবার, ২২ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

সংবাদপত্রের ভূমিকা এবং দুর্নীতি

জীবেন রায়

সংবাদপত্রের ভূমিকা এবং দুর্নীতি

যে যাই বলুক আমি সংবাদপত্রকে ভীষণ ভালোবাসি। আজ প্রায় পাঁচ-ছয় দশক ধরে ঘুম থেকে উঠে যে কাজটা প্রথম করি তা হলো সংবাদপত্র পড়া, নিদেনপক্ষে ১-২ ঘণ্টা চোখ বুলানো। ছোট্টবেলায়, নিত্যনৈমিত্তিক হয়তো হতো না। আর ঘুম থেকে উঠেও হতো না। তবে হাতের কাছে পেলেই অথবা লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়ে নিতাম। আর এখন তো এই ডিজিটাল যুগে বিনে পয়সায় ইন্টারনেট আর ল্যাপটপ থাকলেই পড়া যায়। কমপক্ষে ৩-৪টা পত্রিকা তো পড়তে হয়।  তারপর কোনো নির্দিষ্ট দেশের খবরের জন্য অনেক সময় সে দেশের পত্রিকা বের করে পড়ি। ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ সংক্রান্ত খবরের জন্য আল-জাজিরা অবশ্যই পড়তে হবে। 

১৭৮৭ সালে টমাস জেফারসন বলেছিলেন, আমাকে যদি সংবাদপত্র ছাড়া সরকার অথবা সরকার ছাড়া সংবাদপত্র-এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়, তবে দ্বিতীয়টি বাছাই করতে দ্বিধা করব না। পাঠকবৃন্দ, বুঝতেই পারছেন সংবাদপত্র কতটা জরুরি এবং প্রয়োজনীয়। অন্যদিকে মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, তথ্য জানার জন্য সংবাদপত্র পড়া উচিত। তবে স্বাধীন চিন্তার অভ্যাসকে হত্যা করে নয়। গান্ধীজি বলতে চেয়েছেন এই যে আমরা মতামত কলাম লিখি, সব কিন্তু বিশ্বাস করবেন না।

তবে সংবাদপত্র ও সাংবাদিক কতটা প্রভাবশালী তার একটা উদাহরণ দিই :

১৯৭২ সালে দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্টার থাকাকালীন, বব উডওয়ার্ড এবং কার্ল বার্নস্টেইন-দুজনে মিলে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির মূল খবর প্রকাশ করেছিলেন। এই কেলেঙ্কারির কারণে অনেকগুলো সরকারি তদন্ত হয় এবং তখনকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। দুজন সাংবাদিকের কারণে প্রসিডেন্টের পতন-এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে সম্ভব? একেবারেই নয়। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি এবং এই দুই সাংবাদিককে নিয়ে প্রায় আটটি সিনেমা হয়েছে, তার মাঝে ডাস্টিন হফম্যান ও রবার্ট রেডফোর্ড অভিনীত ‘অল দি প্রসিডেন্টস ম্যান’ অন্যতম। ইউটিউব থেকে দেখে নিতে পারেন। পাবলিক সার্ভিসের জন্য পুলিৎজার পুরস্কারসহ নানাবিধ পুরস্কার পেয়েছেন এই সাংবাদিকদ্বয়।

এক সময় আমার সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছা ছিল। এমন একটা মহৎ পেশা তবে এই মহৎ পেশার লোকজনও বাংলাদেশে নাকি বিক্রি হয়ে যায়! ছাগলকান্ডের একজন দুর্নীতিবাজের স্ত্রী সাংবাদিকদের কিনে ফেলার কথা বলেছিলেন। তার মানে সাংবাদিকদেরও কেনা যায়! কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় নানারকম কান্ড হচ্ছে আর সাংবাদিকরাও মজা করে লিখছেন। আমি চারটি পত্রিকা-বাংলাদেশ প্রতিদিন, প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ, জনকণ্ঠ প্রতিদিন ইন্টারনেটে পড়ি। তাছাড়া রয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট, সিএনএন, আল-জাজিরা এবং আজ প্রায় ৩০ বছর ধরে সাপ্তাহিক টাইম সাবক্রাইভ করে আসছি।

কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশ সংবাদপত্রগুলোতে একটিই বিষয় হেডলাইন হয়ে যাচ্ছে আর তা হলো দু-র-নী-তি। দুর্নীতি মাপার কি যন্ত্র আছে? যুক্তি ও প্রমাণ ছাড়া বিজ্ঞান চলে না। বিজ্ঞানের অগ্রগতিও হয় না। মনে হচ্ছে দুর্নীতি মাপাও একটি বিজ্ঞান এবং সত্যি সত্যিই দুর্নীতি মাপার যন্ত্র আছে। সেটাকে ইংরেজিতে বলা হয় Corruption Perception Index, বাংলায় দুর্নীতি নির্ধারণ সূচক বলা যেতে পারে।

দুর্নীতি নির্ধারণ সূচক কম্পাইল করার জন্য ব্যবহৃত ডাটা বিশেষভাবে সরকারি খাতের দুর্নীতির নিম্নলিখিত বিষয়গুলোকে কভার করে :

১. ঘুষ

২. সরকারি তহবিল অপসারণ

৩. পরিণতির সম্মুখীন না হয়েই ব্যক্তিগত লাভের জন্য কর্মকর্তারা তাদের পাবলিক অফিস ব্যবহার করে

৪. সরকারি খাতে দুর্নীতি দমনে সরকারের ক্ষমতা

৫. সরকারি খাতে অতিরিক্ত লাল ফিতা দুর্নীতির সুযোগ বাড়িয়ে দিতে পারে

৬. সিভিল সার্ভিসে স্বজনপ্রীতির সুযোগ

৭. আইন নিশ্চিত করে যে সরকারি কর্মকর্তারা তাদের অর্থ এবং সম্ভাব্য স্বার্থের দ্বন্দ্ব প্রকাশ করে

৮. ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগকারী ব্যক্তিদের আইনি সুরক্ষা

৯. সরকারি কর্মকর্তা/সরকারের কর্মকান্ডের তথ্য জানার সুযোগ

উপরোক্ত বিষয়গুলো দেখাশোনা করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারনেশন্যাল। তাদেরই তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের স্কোর হলো ১০০ মধ্যে ২৬ মানে, যত কম তত খারাপ। সেই সঙ্গে বিশ্বে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪৭। অবশ্যই সন্তোষজনক নয়। আমার একজন সাইকাট্রিস্ট বন্ধুর কথা-প্রায় ১৭ কোটি মানুষের মাঝে ১৫ কোটি মানুষই হয়তো দুর্নীতিপরায়ণ। তার মানে গরিব লোকজনও কিছু না কিছু দুর্নীতি করে থাকেন? ইদানীং তার প্রমাণও পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশে পরমবিক্রমশালী ক্ষমতাধর মাত্রই হয়তো দুর্নীতিবাজ এবং তাদের দুর্নীতি আকাশছোঁয়া। তখন গরিব বা নিম্নমধ্যবিত্তগণ ভাবছে আমরাই বা কী দোষ করলাম? কিন্তু ধমক দিয়ে বা ভয় দেখিয়ে তারা টাকা বানাবে কী করে? সুতরাং অন্য পন্থা অবলম্বন করতে হবে। মাথায় খানদানি টুপি পরে পরহেজগার সাজতে হবে আর সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হবে। সম্প্রতি একজন তো সেই কাজটি করেই ধরা পড়ে গেছেন। এক যুগ ধরে কাজটি করে যাচ্ছেন। ভদ্রলোক শিক্ষক না হয়েও শিক্ষা-পরীক্ষা ইত্যাদিতে হাত বাড়িয়েছেন। আর ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ হয়ে গেছেন। শুধু তাই নয়, পিএসসির একজন অফিস সহকারী ও প্রহরী দুজনই কোটিপতি।

এ সম্পর্কে একটি ছোট্ট ঘটনা বলি। ধরুন এই নতুন ক্রোড়পতির কথাই বলি। ফেসবুকের কল্যাণে আগেই বলেছি ভদ্রলোক পরহেজগার; পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। নামাজ পড়াকালীন একজন পিএসসি পরীক্ষার্থী প্রশ্নক্রেতা এলো টাকা দিতে। ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি নামাজে আছি হাত দিয়ে নিতে পারছি না, আপনি বরং আমার ডান পকেটিতে ঢুকিয়ে দিন। আমরা মানুষ ধর্মটাকেও কত সুন্দরভাবে ব্যবহার করছি দুর্নীতিকান্ডে!’

আমার বন্ধুর কথা অনুযায়ী ২ কোটি লোকও যদি সৎ হয়, তাহলে তারা কোন গ্রুপের হতে পারে? আমার ধারণা মতে (যদিও আমার বাংলাদেশে বন্ধুগণ দ্বিমত পোষণ করে), বিরোধী দলের লোকজনের পক্ষে দুর্নীতি করা সহজ নয় বলে হয়তো একটু ভালো অবস্থানে। শিক্ষক সমাজের দুর্নীতি করার সহজ পথও নেই, সুতরাং তারাও হয়তো ভালো অবস্থানে। সব চেয়ে যে বড় গ্রুপটি দুর্নীতিতে নেই বলে আমার বিশ্বাস, তারা হলো খেটে খাওয়া মানুষ এবং কৃষক সমাজ।  সুতরাং আমার বন্ধুর ধারণাটা পরিবর্তন করে বলতে পারি ৩০% লোক এখনো হয়তো সৎ ভালো মানুষ।  তবে একজন রিকশাচালক যদি ৫-১০ টাকা বেশি চায়, সে ক্ষেত্রে আমার ৫০ টাকা বেশি দিতেও আপত্তি নেই। অথবা একজন দিনমজুর বা কাজের মহিলাকে একটু বেশি টাকা দেওয়াই উচিত। অকথ্য গালি নয়, শরীরে গরম পানি ঢেলে দেওয়া নয়।

পরিশেষে একটা কোটেশন দিয়ে লেখাটা শেষ করছি। ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) বলেছেন, ‘অপরের কষ্ট দূর করার জন্য কষ্ট করার মাঝে রয়েছে মহত্ত্বের প্রকৃত নির্যাস।’

লেখক : বিজ্ঞান ও অঙ্ক বিভাগ, মিসিসিপি ইউনিভার্সিটি ফর উইম্যান, কলম্বাস, যুক্তরাষ্ট্র

Email: [email protected]

সর্বশেষ খবর