শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

মানবিক হোক চিকিৎসাসেবা

তপন কুমার ঘোষ

মানবিক হোক চিকিৎসাসেবা

দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি খাত- একটি স্বাস্থ্য, অন্যটি শিক্ষা। আমাদের স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশা নিয়ে ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ পত্রিকায় বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে জুন-জুলাই মাসে। স্বাস্থ্য খাতের নানা অনিয়ম ও সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়েছে এসব প্রতিবেদনে। করণীয় কী, সে ব্যাপারেও সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয়েছে। অসুস্থ হলে রোগ নিরাময়ের জন্য আমরা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরাই মুমূর্ষু রোগীর পাশে থাকেন। এমন বহু চিকিৎসক আছেন যারা ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে নিজেদের সমর্পণ করেছেন রোগীর চিকিৎসায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ডাক্তারদের সম্পর্কে ইতিবাচক খবর কমই ঠাঁই পায় গণমাধ্যমে। নেতিবাচক খবরগুলো বেশি গুরুত্ব পায়। চিকিৎসকদের প্রতি পাবলিক পারসেপশন বা জনধারণা কিছুটা নেতিবাচক, এ কথা সত্য। নানা কারণে দেশের চিকিৎসাসেবার প্রতি একশ্রেণির মানুষের আস্থার অভাব আছে। তবে এটা মানতেই হবে, দেশে অনেক ভালো চিকিৎসক আছেন এবং হৃদরোগসহ অন্যান্য কিছু ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা এখন দেশেই পাওয়া যাচ্ছে। হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রে কান পাতলে নানা কথা শোনা যায়। ‘চিকিৎসকরা অর্থ উপার্জনের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। এঁদের মধ্যে মানবিকতার বড়ই অভাব ইত্যাদি। ‘প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধারণা কি সর্বাংশে সত্য? মুষ্টিমেয় চিকিৎসকের ক্ষেত্রে এটা সত্য হতে পারে, সবার ক্ষেত্রে নয়। এক ঝুড়ি পাকা আমের মধ্যে চার-পাঁচটা পচা আমের কারণে ঝুড়ির সব আমের বদনাম হয়। বলা বাহুল্য, সৎভাবে উপার্জনে দোষের কিছু নেই। কিন্তু যেখানে নীতি-নৈতিকতার অভাব, সেখানেই ঘটে যত বিপত্তি। জেলা-উপজেলার অনেক সরকারি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব প্রকট, এটা আমাদের জানা। আবার বেসরকারি হাসপাতালগুলো সরকারি খাতের চিকিৎসকের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। ঘাটতি রয়েছে দক্ষ জনবলেরও। হাসপাতালে অনেক মূল্যবান যন্ত্রপাতি অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। বাক্সবন্দি অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে নতুন যন্ত্রপাতি। সমন্বয়ের অভাব। জেলা-উপজেলার হাসপাতালগুলোতে কাগজে-কলমে চিকিৎসক পোস্টিং থাকলেও তাদের একাংশ প্রায়শ সেখানে গরহাজির থাকেন বলে অভিযোগ আছে। এ রোগ দীর্ঘদিনের। রোগীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় কর্মরত চিকিৎসকদের। বাংলা প্রবাদ, এক মুখ সোনা দিয়ে ভরা যায়, পাঁচ মুখ ছাই দিয়েও ভরে না। জুনিয়র চিকিৎসকদের, বিশেষ করে ইন্টার্নিদের মধ্যে কিছু চাপা অসন্তোষ আছে। রোগীর স্বজনদের সঙ্গে ইন্টার্নি চিকিৎসকদের বচসা ও এর পরিণতিতে অপ্রীতিকর ঘটনার খবর হরহামেশাই সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে। জুনিয়র চিকিৎসকদের অসন্তোষের কারণ খুঁজে বের করে নিরসনের উদ্যোগ নিতে হবে। কিছু মানুষ কোনো কিছুতেই খুশি নন। ডাক্তারদের গালাগাল করার সুযোগ খোঁজেন। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে উসকানি দেওয়ার লোকের অভাব হয় না। হুজুগে পড়ে যুক্তিবুদ্ধি হারান এক শ্রেণির মানুষ। হাসপাতাল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জায়গা নয়। হাসপাতালের সামনে এমনকি গাড়ির হর্ন বাজানো পর্যন্ত নিষেধ। কর্তব্যরত চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর চড়াও হয়ে বা হাসপাতাল ভাঙচুর করে শেষমেশ যে কোনো সমাধান মেলে না- এই বোধ সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ। বিষয়টি নিয়ে এর আগেও অনেক আলোচনা হয়েছে। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের কাছ থেকে চিকিৎসকদের উপহার গ্রহণ এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। ব্যতিক্রম আছে কি না, জানা নেই। থাকলে ভালো। কথা হলো, এই উপহার গ্রহণ কি নিয়মনিষ্ঠ হচ্ছে? কোটি টাকার প্রশ্ন এটি। একটিবারও কি এই প্রশ্ন চিকিৎসকদের মনে উঁকি দেয় না? এটা অনৈতিক কি না, সে প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া দরকার সর্বাগ্রে। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের ব্যবসায়িক লক্ষ্যমাত্রা পূরণের দায়িত্ব ডাক্তার কেন নেবেন? পুরনো প্রবাদ, ‘নুন খেলে গুণ গাইতে হয়।’ এ নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। চোখের সামনেই উপহার গ্রহণ ভালো চোখে দেখেন না রোগী বা রোগীর স্বজনরা। উপহার বাবদ ওষুধ কোম্পানির যে খরচ হয়, ওষুধের মূল্য নির্ধারণে তার কন্ট্রিবিউশন বা অবদান কতটুকু, সে হিসাব অবশ্যই নেওয়া প্রয়োজন। আমরা যে যাই করি না কেন, যত সংগোপনেই করি না কেন, একজন তো সবকিছু দেখছেন। তাঁকে ফাঁকি দেওয়ার সাধ্য কার। ‘প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলতে না দেওয়ায় রোগীকে মারধরের অভিযোগ’ শিরোনামে একটি খবর সম্প্রতি ছাপা হয়েছে পত্রিকার পাতায়। জুন মাসের খবর এটি। ঘটনাস্থল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় [ইত্তেফাক, ৮ জুন ২০২৪]। এদের দৌরাত্ম্য কোন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, এ ঘটনা থেকে তা সহজেই অনুমান করা যায়। এখানেও দুর্বৃত্তপনা। এখনই লাগাম টেনে ধরা দরকার। ভুললে চলবে না, চিকিৎসকরাও মানুষ। তাদেরও পরিবার-পরিজন আছে। সুবিধা-অসুবিধা আছে। জব স্ট্রেস আছে। আছে ভালো লাগা-মন্দ লাগা। পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনের অনেক কিছু বিসর্জন দিয়ে নিরন্তর চিকিৎসাসেবা দেন তারা। উৎসবের দিনগুলোতে দেশের মানুষ যখন আনন্দে মাতোয়ারা, তখন চিকিৎসকরা হাসপাতাল-ক্লিনিকে মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যান। দেশের অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যখন মানুষকে নিরাপদে ঘরে থাকতে বলা হয়, তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কর্মস্থলের উদ্দেশে বের হন চিকিৎসকরা। আমরা এটা বিশ্বাস করতে চাই, অর্থ উপার্জনের নেশায় নয়, দায়িত্ব ও মানবিকতাবোধ থেকেই অনেক চিকিৎসক রাত জেগে চেম্বারে রোগী দেখেন। তারা রোগীদের পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রামের পরামর্শ দেন। কিন্তু নিজেদের জীবনে সে সুযোগ আর হয়ে ওঠে না। এক সময় নিজেরাই রোগী হয়ে যান।

লেখক : সাবেক পরিচালক, পরিচালনা পর্ষদ, বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর