বাংলাদেশ প্রতিদিনে লেখালেখি করি তা প্রায় দেড় দশক। পত্রিকাটির জন্মলগ্ন থেকেই লিখতে আরম্ভ করেছিলাম। মাঝেমধ্যে দুই-চার পর্ব বাদ পড়েছে। বয়স হয়েছে তাই যিনি বা যারা সম্পাদনা করেন তাদের কিছু কিছু কাটাকাটি ভালো লাগে না, বিরক্তি লাগে। সেজন্য এবং অন্যান্য কারণে দুই-চার বার লেখা হয়নি। এবারও দেখেছি জনাব ওবায়দুল কাদের চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলেন সাধারণ মানুষ সেটা পছন্দ করে না। সাধারণত বাংলার মানুষ চিবিয়ে চিবিয়ে খাবার খায়, কথা বলে না। সবই ছেপেছেন। কিন্তু ভদ্রলোক অসুস্থ হওয়ার পর এখন পুরোপুরি সুস্থ কি না একটা ডাক্তারি দল দিয়ে পরীক্ষার অনুরোধ করেছিলাম। লাইনটি বাদ দিয়ে দিয়েছেন। কেন এমন করেন তা যারা কাটাকাটি করেন তারাই জানেন। মঙ্গলবারের লেখার সব সময়ই কমবেশি প্রতিক্রিয়া পাই। কিন্তু গত পর্বের প্রতিক্রিয়া ছিল অস্বাভাবিক। দুটি প্রসঙ্গে সব থেকে বেশি মতামত এসেছে। একটি সর্বদলীয় সংলাপ, অন্যটি ওবায়দুল কাদের প্রসঙ্গে। অত মানুষ যে তার ওপর বিরক্ত বিষয়টা আমার জানা ছিল না। মানুষ বিরক্ত তা বুঝতাম, অশান্তির অনেকটাই তিনি এবং সাংগঠনিকভাবে সরকারি দল পিছিয়ে পড়ার জন্যও তিনি দায়ী। ওসব অনেকের কাছে শুনেছি, কিন্তু এতটা ভাবিনি। ছাত্রলীগের তিনি যখন নেতা ছিলেন তখন তার যে উদ্দীপনা ছিল এখন সেসবের লেশমাত্রও নাকি নেই। আর যেখানে ’৫৭ সালে কাগমারী মহাসম্মেলনে দল এবং সরকারের দুই পদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শুধু দলীয় সাধারণ সম্পাদকের পদ বেছে নিয়েছিলেন। সেই দলে তার প্রিয় কন্যার নেতৃত্বে একই ব্যক্তি দলের এবং সরকারের দুই পদে বহাল এটা নেতা ও পিতাকে কতটা অনুসরণ ভাবতে হবে। ওবায়দুল কাদের অনেক সমস্যারই কেন্দ্রবিন্দু এ কথার জন্য আওয়ামী লীগের শতকরা ৯০ জন নেতা-কর্মী যোগাযোগ করেছে, খুশি হয়েছে। আমি খুবই বিরক্ত ছিলাম যখন ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা পালাবে না। তিনি পালাবার মতো নেতা নন।’ আমার এত খারাপ লেগেছিল লিখতে গিয়েও গত পর্বে কথাটি লিখিনি। কারণ এখন আর ওবায়দুল কাদেরের কথায় দেশবাসী যেখানে তেমন গুরুত্ব দেয় না, সেখানে আমি গুরুত্ব দিয়ে কী করব? কিন্তু সে দিন কথাটি যখন বোন বললেন তখন সত্যিই খুব খারাপ লাগল। তাকে পালাতে হবে কেন? তার বাবা মৃত্যুর মুখেও পালাননি, তিনি পালাবেন কেন? কিন্তু ওবায়দুল কাদেরের কথায় মনে হচ্ছিল, ‘মাচার তলে কে রে? গুড় খাই না।’ কে বলেছেন নেত্রী পালাবেন? তিনি পালাতে যাবেন কেন? আমি তো চাই শুধু আমি কেন, মনে-প্রাণে যারা এ দেশের স্বাধীনতা লালন করে তারা সবাই চায় তিনি সবাইকে নিয়ে দেশ চালান, সম্মানে থাকুন, ভালো থাকুন। বিরোধীদের শত্রু না ভেবে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবার চেষ্টা করুন। কিন্তু কেন যেন তেমন হচ্ছে না।
কোটা সংস্কার দাবির মধ্য দিয়ে মূলত আন্দোলনের সূচনা। মেধা মেধা যারা করছে তারা ব্যাপারটা কতটা বুঝে করছে বলতে পারব না। স্বাধীনতার পর থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন কোনো মর্যাদা দেওয়া হয়নি। বরং তাদের সামাজিকভাবে নিচু দেখাবার চেষ্টা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যতদিন বেঁচেছিলেন তিনি পিতার অবস্থান থেকে ব্যক্তিগতভাবে আদর-যত্ন সম্মান করার চেষ্টা করলেও দলীয়, সামাজিক এবং সরকারিভাবে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের শুধু ছোট করার চেষ্টা হয়েছে, কোনো সম্মান করা হয়নি। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা ছিল সবচাইতে দুর্যোগে দুর্বিপাকে। একসময় মুক্তিযোদ্ধা হলেই জেল। এরপর জিয়াউর রহমানের সময় সব জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা।
আবার এখন বোনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মুক্তিযুদ্ধের সময় মায়ের পেটে থাকারাও কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা। অথচ এখনো![](/assets/archive/images/Print-Edition/2024/07.July/30-07-2024/BP-24'07'30-1A(2).jpg)
নিশ্চয়ই দুষ্কৃতকারীদের হাত আছে, প্রভাব আছে, বাইরের অর্থ আছে। কিন্তু সরকার এবং প্রশাসনের কোনো ভুলই নেই তেমন নয়। সময়ের কাজ সময়ে করতে হয় তা মোটেই করা হয়নি। সাধারণ মানুষকে যতটা গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছিল তার বিন্দুবিসর্গও দেওয়া হয়নি। যেখানে দেশের মানুষকে একেবারে নিঃস্ব রিক্ত করে রাখা হয়েছে সেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন শেখ হাসিনা এখন তাদের হাতে বিচারের ভার দিয়ে কী করবেন? গত অনেক বছরে দেশের জনগণকে তো কোনো ধর্তব্যের মধ্যেই রাখা হয়নি। জনশক্তি যে আণবিক বোমার চাইতে শক্তিশালী সে কথাটি তো অনেকেই ভুলে গেছেন। এখন তো বেনজীরের মতো কুলাঙ্গার দিয়েই চলে। মানুষ নানা ঘটনা থেকে শিখে। অথচ আমরা কোনো কিছুই শিখতে চাই না। কেন যেন আমরা সব সময় শুধু শেখাতে চাই।
মনে হয় প্রায় ৪০ বছর আগের কথা। এক দুপুরে হঠাৎই পাকিস্তানি এক ব্রিগেডিয়ারের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের লেখা একটি বই পড়ছিলাম। সে বইয়ের কদিন আগে পাকিস্তানি কর্মকান্ড নিয়ে জেনারেল আমির আবদুল্লাহ নিয়াজির বই পড়েছিলাম। শত্রুপক্ষকে স্বীকার করা বা সম্মান দেওয়ার মতো বুকের পাটা কখনো পাকিস্তানিদের ছিল না। তবে কেন যেন এক জায়গায় আমার নাম নিয়েছিলেন যেমনি মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম তাঁর ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ বইটিতে আমার বা আমাদের নাম নেওয়ার কথা ঘুণাক্ষরেও মনে করেননি। কত যুদ্ধ কত বিগ্রহ পাকিস্তানি জাহাজ দখল যা নিয়ে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে আলোচনা, জাতিসংঘে কথা উঠেছে। কিন্তু মেজর রফিকের ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ কাদের সিদ্দিকী বা কাদেরিয়া বাহিনী কোনো জায়গা পায়নি। শুধু তার বইয়ে খেতাবপ্রাপ্তদের নামের তালিকায় একবারই কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম লেখা হয়েছে। নিয়াজির বইয়েও তেমনি দয়া করে একবারই আমার নাম লিখেছেন। তবে আর কোনো বাঙালির নাম লিখেননি। যা হোক, ব্রিগেডিয়ার ভদ্রলোকের বইটির কেন যে নাম ভুলে গেছি জেনারেল আমির আবদুল্লাহ নিয়াজির বইয়ের চাইতে সুপাঠ্য মনে হয়েছে। সেখানে একটি কথা আমাকে বেশ আলোড়িত করেছিল। ভদ্রলোক লিখেছেন, ‘আমি ক্যান্টনমেন্টে থাকি। আমার তিন-চার বছরের ছেলে সারা বাড়িময় জয়বাংলা জয়বাংলা আর জয় বঙ্গবন্ধু বলে বাড়ি মাথায় তোলে। নানাভাবে বারণ করেও তাকে থামাতে পারিনি। অনেক সময় এ নিয়ে বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’ সেদিন প্রায় তেমনই একটি ঘটনা ঘটেছে আমার বাড়িতে। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল এসে ছাদে বসেছিলাম। আমার বাড়িতে তিন বছরের ছোট্ট একটা বাচ্চা আছে। তারা এক বোন এক ভাই মা-বাবার সঙ্গে থাকে। তিন বছরের হলেও কথাবার্তা বেশ সাবলীল। হঠাৎই কেন যেন বাচ্চাটিকে তুই বলেছিলাম। ওর আগে কখনো কোনো প্রসঙ্গে তাকে তুই বলেছি কি না বলতে পারব না। তবে সেদিন হঠাৎ তুই শুনে মনে হয় সে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো ফুঁসে ওঠে,
- দাদু, তুমি আমাকে তুই বললা কেন?
- তাহলে কি তোকে আপনি বলব?
- না, তুই বলবা না, আপনিও বলবা না। তুমি বলবা। বলেই, ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার’ বলে স্লোগান দিতে লাগল।
তিন বছর হতে যার তখনো এক মাস বাকি। তার মুখে ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার’ শুনে আসমান থেকে পড়েছিলাম। কী হলো দেশে? ওভাবে রাজাকার রাজাকার শোনা আমার জীবনে প্রথম। আমরা বলেছি, ‘তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি’। কোনো দিন স্বাধীন বাংলাদেশে ওরকম একটি নিষ্পাপ শিশুর মুখে রাজাকার রাজাকার শোনার আগে আমার মৃত্যু হলেও সেটা অনেক ভালো হতো। জানি না এর শেষ কোথায়? জানি না এর প্রতিকার কী এবং কীভাবে?
আমি খুবই বিস্মিত ও হতাশ আন্দালিব রহমান পার্থকে গ্রেপ্তার করা নিয়ে। সেতু ভবনের ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে তাকে জড়ানো হয়েছে। আন্দালিবকে আমি যতটুকু জানি বুঝি কুকাজ করার কোনো স্বভাব তার নেই। সত্যিকার একটি সাহসী যুবক। বিদ্যাবুদ্ধিতে অনেকের চেয়ে বহু এগিয়ে। মতের অমিল হলেই তাকে হয়রানি করতে হবে, এটা কোনো রাষ্ট্রনীতি হতে পারে না। আন্দালিবকে নিয়ে টানাটানি ভালোর চেয়ে অনেক বেশি খারাপ হবে। তাই পুলিশ ভাইয়েরা আন্দালিবকে ছেড়ে দিন, ভালো হবে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ সবাই মিলে চিন্তা করা, সবাই মিলে চেষ্টা করা। তাই জাতীয় সংলাপের আহ্বান জানাতে নেত্রীকে বলেছি, বোনকে বলেছি, সরকারপ্রধানকে বলেছি। সত্যিই দেশটা শুধু আওয়ামী লীগের না, বিএনপির না, ১৪ দলেরও না। দেশটা ১৮ কোটি মানুষের। তাদের হাসি-কান্না, দুঃখ-বেদনা নিয়েই দেশ। একে উপলব্ধি করতে আবারও সবাইকে অনুরোধ জানাচ্ছি। প্রতিটি দেশের সইবার মতো একটি ক্ষমতা থাকে।
তাই আশা করব, এত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা এত ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে অর্জন করা একটি দেশ আমরা কেউ যেন খামখেয়ালি করে ক্ষতি করার চেষ্টা না করি। আমরা যেন জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতি সম্মান দেখাতে পারি। তা না হলে আমাদের আরও কষ্ট করতে হবে। আরও ভয়াবহ পরিণতির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। অল্প সময়েই সেসব দুর্ভাগ্য আমরা দেখতে পাব। আমরা কেউ দুর্ভাগ্যকে আলিঙ্গন করতে চাই না, আমরা সৌভাগ্যের প্রত্যাশা করি।
লেখক : রাজনীতিক
www.ksjleague.com