রবিবার, ৪ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা

সৌভাগ্যের বার্তা বয়ে আনে কন্যাসন্তান

আবদুল্লাহ আল মামুন আশরাফী

সৌভাগ্যের বার্তা বয়ে আনে কন্যাসন্তান

সন্তান। সুন্দর এই পৃথিবীর নয়নপ্রীতিকর জিনিসগুলোর অন্যতম। সন্তানের মায়াবী চেহারায় তাকিয়ে মা তার গর্ভকালীন ও প্রসব-পরবর্তী অবর্ণনীয় কষ্টগুলো নিমেষেই ভুলে যান। জীবন জীবিকাযুদ্ধে নিরন্তর ছুটে চলা একজন বাবা ঘরে ফিরে সন্তানের উষ্ণ সান্নিধ্যে হৃদয়ের প্রশান্তি খুঁজে পান। সন্তানের মাঝে প্রত্যেক বাবা-মা নিজের জীবনের স্বপ্ন জড়িয়ে আগামীর পথে চলতে থাকেন। সন্তান মহান আল্লাহতায়ালার শ্রেষ্ঠ নেয়ামতগুলোর অন্যতম। সন্তান পৃথিবীতে আসার ক্ষেত্রে মা-বাবা হচ্ছেন একটি বাহ্যিক মাধ্যম। কিন্তু সন্তান তৈরিতে মা-বাবার কোনো ক্ষমতা নেই। সন্তান একমাত্র প্রজ্ঞাময়, মহাজ্ঞানী আল্লাহতায়ালার দান। তাঁর কুদরতের এক অপূর্ব নিদর্শন। তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে সন্তান দান করেন। কাউকে পুত্র দেন। কাউকে দেন কন্যা। আবার কেউ সন্তানহীনতার দুঃসহ জ্বালা নিয়ে জীবননদী পাড়ি দিতে বাধ্য হন। এটি আল্লাহতায়ালার সৃষ্টির এক নিগূঢ় রহস্যাবৃত বিষয়। পবিত্র কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে- ‘নভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডলের রাজত্ব আল্লাহতায়ালারই। তিনি যা ইচ্ছা, সৃষ্টি করেন, যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদের দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাশীল’। (সুরা শুরা ৪৯: ৪৯-৫০)। আয়াতে কারিমার বার্তা সুস্পষ্ট। সন্তান একমাত্র আল্লাহতায়ালার দান। এখানে সৃষ্টির কোনো হাত নেই। যাকে চান তাকেই তিন পুত্র কিংবা কন্যাসন্তানের নেয়ামত দান করেন। পুত্র কন্যা দুটোই মূল্যবান নেয়ামত। তবে বিভিন্ন আয়াত, হাদিস ও সালাফের উক্তির আলোকে বোঝা যায় যে, কন্যাসন্তান সৌভাগ্যের প্রতীক। মেয়েরা মা- বাবার জীবনে কল্যাণের বার্তা নিয়ে আসে। দেখুন, আয়াতে আল্লাহতায়ালা প্রথমে কন্যাসন্তানের কথা উল্লেখ করেছেন। তাই কোনো কোনো আলেমের ভাষ্য হচ্ছে, কন্যাসন্তানের বিশেষ মর্যাদার দিকে ইঙ্গিত রয়েছে আয়াতটিতে। বিখ্যাত মুফাসসির লেখক ও গবেষক আল্লামা আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ আল কুরতুবি (রহ.) (মৃত্যু-৬৭১হি.) তার তাফসির গ্রন্থে উল্লেখ করেন- হজরত ওয়াসিলা ইবনে আসকা (রহ.) বলেন-

‘যে নারীর গর্ভে প্রথম কন্যাসন্তান জন্ম নেবে সে নারী পুণ্যময়ী’।

কন্যাসন্তানের জন্ম গ্রহণে আনন্দিত হওয়া পবিত্র কোরআনুল কারিমের শিক্ষা। কন্যাসন্তান জন্ম নিলে যারা খুশি হয় না, লজ্জাবোধ করে কোরআনে তাদের নিন্দা করা হয়েছে। প্রাক ইসলামিক যুগে আরবের লোকরা কন্যাসন্তানকে অশুভ মনে করত। কারও কন্যাসন্তান জন্ম নিলে লজ্জায় তার চেহারা মলিন হয়ে যেত। অনেকে বর্বরতার সীমা অতিক্রম করে কন্যাসন্তানকে জীবন্ত দাফন করার মতো রোমহর্ষক হিংস্রতায় মেতে উঠত। পবিত্র কোরআন মাজিদে এহেন নিচু বর্বর আচরণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে ইরশাদ হয়েছে- ‘যখন তাদের কাউকে কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তাদের মুখ কাল হয়ে যায় এবং অসহ্য মনস্তাপে ক্লিষ্ট হতে থাকে। তাকে শোনানো সুসংবাদের দুঃখে সে লোকদের কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে থাকে। সে ভাবে, অপমান সহ্য করে তাকে থাকতে দেবে, না তাকে মাটির নিচে পুঁতে ফেলবে। শুনে রাখ, তাদের ফয়সালা খুবই নিকৃষ্ট’। (সুরা নাহল ১৬ : ৫৮-৫৯)। বর্তমান যুগে সরাসরি কন্যাসন্তানকে জীবন্ত দাফন করার বিষয়টি শোনা না গেলেও তথাকথিত সভ্যতার ধ্বজাধারী পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুসারীরা জাহেলি যুগের বর্বরতাকেও হার মানাচ্ছে। মায়ের গর্ভে কন্যাসন্তানের ভ্রণকে অঙ্কুরেই শেষ করে দিচ্ছে। গা শিউরে ওঠা ভয়াবহ এই চিত্র সংবাদমাধ্যমে অল্প বিস্তর ফুটে উঠলেও বড় একটা অংশ পর্দার আড়ালেই থেকে যায়। অথচ তারাই নারীর অধিকার নিয়ে চেঁচামেচি করতে থাকে। কন্যাসন্তান সৃষ্টিগতভাবে একটু দুর্বল হয়ে থাকে। ছেলেদের মতো জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে কর্মক্ষম হয় না। ফলে অনেকেই এই ভয়াবহতার দিকে পা বাড়ায়। পবিত্র কোরআন মাজিদে এই ভয়াবহ হিংস্রতার পথ রুদ্ধ করতে ইরশাদ হয়েছে- ‘দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা কর না। তাদের এবং তোমাদের আমিই জীবনোপকরণ (রিজিক) দিয়ে থাকি। নিশ্চয় তাদের হত্যা করা মারাত্মক অপরাধ’। (সুরা বনি ইসরাইল : ৩১)। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, অসহায় ও দুর্বলদের উসিলায় তোমাদের রিজিক দেওয়া হয়। সুতরাং কন্যাসন্তান বোঝা নয়, সৌভাগ্যের প্রতীক। কন্যাসন্তান বরকত বয়ে আনে। মেয়েরা সৌভাগ্যের পরশমণি। তাই কন্যাসন্তানের জন্মগ্রহণে আনন্দিত হওয়া উচিত। মানবতার অহংকার রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কন্যাসন্তানের জন্মগ্রহণে ভীষণ আনন্দিত হতেন। মেয়েদের প্রতিপালনে তিনি যে সওয়াবের ঘোষণা দিয়েছেন সেটা ছেলেদের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যার দুটি কন্যা বা বোন আছে আর সে উত্তমভাবে তাদের ভরণ-পোষণ করল এবং উপযুক্ত হওয়ার পর ভালো পাত্রের কাছে বিবাহের ব্যবস্থা করল, আমি ও সে জান্নাতে এভাবে প্রবেশ করব, যেভাবে এ দুটি আঙুল মিলে আছে। এ কথা বলে তিনি ডানহাতের শাহাদাত ও মধ্যমা আঙুলদ্বয় মিলিয়ে দেখালেন।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান : ২০৪৩)। অন্য একটি হাদিসে এসেছে, ‘যার তিনটি কন্যা বা তিনটি বোন আছে, অথবা দুটি কন্যা বা দুটি বোন আছে এবং সে তাদের সঙ্গে উত্তমভাবে জীবন অতিবাহিত করে। তাদের হকসমূহ আদায়ের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহতায়ালা তাকে বিনিময় স্বরূপ জান্নাত দান করবেন।’ (জামে তিরমিজি : ১৯৮৮) ।

লেখক : খতিব, আউচপাড়া জামে মসজিদ, টঙ্গী, গাজীপুর

সর্বশেষ খবর