বৃহস্পতিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা

গণঅভ্যুত্থানে গদিহারা প্রধানমন্ত্রী দিকহারা!

মেজর জিল্লুর রহমান (অব.)

গণঅভ্যুত্থানে গদিহারা প্রধানমন্ত্রী দিকহারা!

গদি হারানোর পর কোনো কার্ড কাজে লাগে না। প্রতি অভ্যুত্থানের নীলনকশা হোক সে ধর্মীয় দাঙ্গা, জাতিগত দাঙ্গা, বহিরাগত গোয়েন্দার শলা-পরামর্শ। জনগণ না চাইলে দলীয় স্বল্প কিছু সুবিধাভোগীর উচ্চবাচ্য দলকে প্রতিকূল অবস্থায় ফেলে। দগদগে ঘা শুকানোর আগে শান্ত থাকাই শ্রেয়। আবু সাঈদের বিশ্বাস ছিল তার দেশের পুলিশ তাকে নির্মমভাবে নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যা করবে না। নিরস্ত্র এক মেধাবী তরুণকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে পুলিশ তার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। এ দৃশ্য দেশে-বিদেশে ছড়ালে বাঙালির বুকের পাঁজরে বুলেট ভেদ করে। সবাই গুলিবিদ্ধ আহত পাখির মতো ছটফট করতে লাগল। শোকে জাতির ভাগ্যাকাশে ঈশান কোণে কালো মেঘ, নেমে আসে প্রলয়ের পূর্বাভাস। মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। এরই মধ্যে মুগ্ধর হত্যা আন্দোলনে তীব্রতা জোগানো। মরণপণ লড়াই শুরু হলো। জীবনের মায়া ছেড়ে বীর বাঙালি প্রতিশোধের নেশায় অকাতরে শহীদ হলো।

ছাত্র-জনতা, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, সাংবাদিক আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করল। আমার এক মুরব্বি বললেন, নির্মমতা ’৭১ ছেড়ে যাচ্ছে, আর ঘরে বসে থাকতে পারছি না, গত দুই রাত ঘুমাতে পারিনি। বয়স হয়েছে, মেজর তুমি আমার সঙ্গে গেলে খুশি হব। গুলির সামনে বুক পাতার অসীম সাহস আমাদের নতুনেরা দিয়েছে। পুলিশ কাকে মারছে আমাদের সন্তান, আমাদের নাগরিক; এটা গাজা উপত্যকা? নাকি দুঃস্বপ্ন দেখছি। ওই দিন সকালে এক পরিচিত যুবলীগ নেতা কুশল বিনিময়ের পর বলল, মারের ওপর ওষুধ নাই; কাল পাহারায় বসব, সব ফাঁকা করে ফেলব দেখবেন। আমি ব্যথিত মনে ভাবতে লাগলাম কীভাবে মগজধোলাই দিয়েছে আমাদের দল। কী লাঠিয়াল দর্শনের সালসা খাইয়েছে, মার গুলি ছাড়া আর কোনো বিবাদ-মীমাংসার রাস্তা তাদের চিন্তার জগতে নেই। রাতে এক প্রবীণ আন্দোলনে যাবেন জালিম সরকার মোকাবিলা করতে; আর সরকারের ক্যাডাররা কী বলছে- তারা জাতির পালস বুঝতে-ই পারে না। নতুন প্রজন্মের আত্মত্যাগ, বীরত্ব সাহস, রক্ত দেওয়া, শহীদ হওয়া দেখে বাঙালি কেঁদেছে প্রতিশোধের নেশায় মাঠে নেমেছে তাদের পাশে। চির-দুঃখিনী মা সন্তানের খুশিতে রাজপথে গুলির সামনে বিদায় দিচ্ছে। বাবারা শিক্ষকরা সন্তানের সঙ্গে সঙ্গে মাঠে সংগ্রামের ব্যূহ গড়ে তুললেন। শাহবাগে ফেরিওয়ালা আমেনা খালা আমড়া খাওয়াচ্ছেন, ‘বাবারা খাও পয়সা লাগবে না।’ পথিক বিস্কুট পানি বিলাচ্ছে। এক যুবক ফেরিওয়ালা টিএসসির দিকে খাদ্যের থালা নিয়ে যাচ্ছিলেন পুলিশ বাধা দেয় তিনি সে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠলেন। পুলিশ বোঝাল গোলাগুলি হচ্ছে, তিনি উত্তরে বলেন তাতে কী, তারা আমাদের ভাই। আমি তো একজনকে টেনে আনতে পারব বিপদ থেকে বাঁচাতে পারব। কী ইস্পাত কঠিন একতা! জীবনের মায়া, জেল-জুলুম সব তুচ্ছ হয়ে গেল। সাঈদের হত্যা দেখে মানুষের ভীতি আকাশে উড়ে গেল। পুলিশকে বানাল জনমের শত্রু। সব দেখে গায়ে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে, রক্তে আগুন ধরে। দেহঘড়ি আর দেহে থাকে না, ভেসে চলল আন্দোলনের স্রোতে। যেদিকে তাকাই তারুণ্যের অদমনীয় শক্তি আর শক্তি। মুহুর্মুহু গুলির শব্দ সাউন্ড গ্রেনেডের বিকট শব্দে কানে তালা লাগে। কে কার কেয়ার করে। অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো তেতে ওঠে শাহবাগ। চতুর্দিক থেকে আকাশ প্রকম্পিত স্লোগানে সর্বস্তরের মানুষ মিছিল নিয়ে জামায়েত হচ্ছে। ঢাকা শহর জনসমুদ্র হয়ে গেল। আমি আমাকে অরুণ-তরুণসত্তা পুনঃআবিষ্কার করলাম। এত সাহস এ বয়সে থাকে না। অনেক বৃদ্ধ পতাকা নিয়ে নেচে নেচে সরব উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন। তরুণরাই জাতিকে ঘা মেরে জাগিয়ে ডাক দিয়ে কয়, ‘ও আমার জাত আমরা তোমাদের অতন্দ্র প্রহরী, তোমাদের অধিকার আদায় করে ছাড়ব।’ মেয়েরা পর্যন্ত বলেছে, ‘জীবন দিতে রাজপথে এসেছি, ফেরার সব পথ বন্ধ। হয় মরব, না হয় দাবি আদায় করব।’

আমি যোদ্ধা. কনভেনশনাল যোদ্ধা। এবার বুঝলাম, আমার জাতিকে পৃথিবীর কেউ জয় করতে পারবে না। অভাবনীয় দৃশ্য নয়ন জুড়ানো লড়াই উথাল-পাতাল প্রাণে শুধু তৃপ্তি। জাতিকে অটুট এক বন্ধনে বেঁধে গেছে আবু সাইদের জীবন। যতই লাশ পড়ছে ততই ক্ষিপ্রতা বাড়ছে। আন্দোলনের কোনো কিছুতেই দমাতে পারছিল না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ক্লান্ত; আর কত অস্ত্র চালাবে আর কত নির্মম হবে। রণে ভঙ্গ দিল।

রক্ত গরম স্লোগান চলছে, রণসংগীত গাইছে। আহত ছাত্রছাত্রী দুই রাত আগেও ওবায়দুল কাদেরের ছাত্রলীগ, হেলমেট লীগ তাদের মেরে আধমরা করেছে। ওই আহত অবস্থায় রণাঙ্গনে শামিল হয়েছে। মায়েরা পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করেছে। শাহবাগ হয়ে উঠেছিল সাহস আর শক্তির খনি। স্লোগান শুনছি, ‘রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়’।

বাঙালি এক মহাযুদ্ধে লিপ্ত। মনে হচ্ছে কেউ কাউকে ময়দানে ফেলে যাবে না। রিকশাওয়ালারা মাইলের পর মাইল রিকশা নিয়ে মিছিল করে বুক ফুলিয়ে শামিল হয়েছে ছাত্র-জনতার জনসমুদ্রে। সে কী শিহরণ, জাগরণ।

আবু সাঈদের হত্যা জাতিকে এক কাতারে টেনে আনল। প্রবাসীরা রেমিট্যান্স বন্ধ করল। সারা বিশ্বে বাঙালি যে যেখানে ছিল রক্তের টানে মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে জীবন-জীবিকার ঝুঁকি নিয়ে বিক্ষোভ করেছে, মিছিল করেছে। এত কিছু দেখে প্রধানমন্ত্রী কোন আক্কেলে গুলি চালিয়ে দমন করতে বলেন। পাশে কি পরামর্শ দেওয়ার কেউ ছিল না? ক্ষমতা অন্ধ-বধির করে রেখেছিল। তাই প্রলয় হয়ে গেলে ‘জামায়াত-বিএনপি করেছে’ পুরনো গীত বাজিয়ে তিনি ঘুমিয়ে রইলেন। দুর্ভাগা জাতির কপালে জুটেছিল নমরুদের আত্মার প্রধানমন্ত্রী।

অভিনন্দন নতুন প্রজন্ম যারা ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে নতুন করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনলে। গত লেখায় তোমাদের ওপর অনেক দিনের জমা ক্ষোভে আমি অনেক দোষের অভিযোগ এনে লিখেছিলাম। ক্ষমা চাই। আগে এক লেখায়, তোমাদের রাজনীতিবিমুখ, মোবাইল আসক্ত, বিদেশ পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষায় থাক। দেশ-কাল-সমাজ, অর্থনীতি-রাজনীতি দেশের মানুষের দুঃখ-কষ্ট তোমাদের পাষাণ হৃদয় স্পর্শ করে না; শুধু স্বার্থপরের মতো নিজের বিলাসী জীবন অন্বেষণে ডুবে থাক। এসব লিখেছিলাম। আমাকে তোমরা নতুন জীবন দিলে; তোমরাই পারবে জাতিকে রক্ষা করতে। ২০২৪ সালের এ যুদ্ধে রাজাকার কারা তাদের বিচারের আইন কী হবে। জালেমদের বাসা-বাড়ি থেকে ধীরে ধীরে বের হচ্ছে গুপ্তধন। এত লাশ এত রক্ত এত নিপীড়ন, পুলিশ বাহিনী বিলুপ্ত করে নতুন করে পুনর্গঠন করতে হচ্ছে। এমন অবস্থায় এখনো শেখ হাসিনার পরিবার উপলব্ধি করতে পারেনি দেশের মানুষ তাদের ওপর ক্ষিপ্ত। তিনি দেশে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বুঝতে পারবেন মানুষের রোষ-ক্রোধ।

বঙ্গ ভাগিনা পনেরো বছর ধরে মাসিক দেড় কোটি টাকা ভক্ষণ করেছেন। তিনি ৫ আগস্ট থেকে শোকে মুহ্যমান ছিলেন। তিনি প্রথম বললেন তার মা, সে তার পরিবারের কেউ রাজনীতি করবেন না। তার মার সঙ্গে সবাই বেইমানি করেছে। দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। এখন বলছেন, দেশত্যাগের আগে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেননি। জনগণ যাকে চায় না, তার আর পদতাগ কি ভাগিনা? রাষ্ট্রবিজ্ঞান লেখাপড়া করা দরকার। তার মাতা কি বন্ধুরাষ্ট্রে সৌহার্দের সফরে গেছেন। না কি কন্যা সফরে গেছেন। আগে যেমন আমেরিকায় নাতনি সফরে যেতেন, বিমান বহর নিয়ে তেমন সফর কিনা।

তিনি বেগম খালেদা জিয়ার বক্তৃতা স্বাগত জানান। এবার শুনলাম রাজনীতির হাল ধরবেন। এবার বললেন, তারেক রহমান তার আপন বন্ধু। ভাবনা-চিন্তা পরিষ্কার করে সময় নিয়ে পরিকল্পনা করলে ফল আসবে। এখন দাঙ্গা-ফ্যাসাদ বাধিয়ে লোকসান হবে।

প্রতিবেশী দেশের চ্যানেলগুলো তাকে মিথ্যা সাহস দিচ্ছে। তাদের সাংবাদিকদের উপস্থাপনা দেখলে মনে হয় মিডিয়া মানে ফুটপাতে গ্রাম্য হাটেবাজারে মলম বিক্রেতা গলা ছেড়ে খদ্দের টানছে। হিন্দুদের নিয়ে মিথ্যা-বানোয়াট সংবাদ দেখাচ্ছে। তাদের অনুগ্রহ আশা করার আগে লেন্দুপ দর্জির পরিণতির কথা মাথায় রাখলে মঙ্গল। হিন্দুদের ঘর দখল, মন্দির ভাঙা এসব ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো। উদ্দেশ্য ভারতের কৃপা ভিক্ষা। সিকিমের রাজা সাওগালের বিরুদ্ধে হিন্দু নিপীড়নের ভুয়া অভিযোগ দিয়ে মার্কেটিং করে সিকিম দখলের পক্ষে ভারতের জনগণের মত নেয়। সঙ্গে সঙ্গে লেন্দুপ দর্জিকে তৈরি করে ক্ষমতা নেওয়ার জন্য। এভাবেই ভারতের গর্ভে সিকিম চলে গেল।

শেখ হাসিনা আপনি ক্ষমতা বিত্ত-বৈভবের পর্বতসম উচ্চতার শীর্ষস্থানে বসে পাদদেশের সবকিছু তুচ্ছ মনে করেছেন। দেখেন কুয়াচ্ছন্ন। আশঙ্কা করি, দীর্ঘদিনের অভুক্ত দল যেন মাঠে নেমে বর্গিদের মতো ফসল খেয়ে যেতে না পারে।

আপনাকে অজনপ্রিয় করতে ২০০০ সালে গণভবন ১ টাকায় চাটুকাররা আপনার কাছে বিক্রি করে। আমি তখন আপনাকে ধন্যবাদ দিয়েছিলাম, ইচ্ছা করলে দুই বোন একজন গণভবন, অন্যজন বঙ্গভবন নিতে পারতেন, তা করেননি। সমালোচনা দেখে আপনি বুঝলেন জনগণ ক্ষেপেছে। সরে এলেন। পুলিশকে আপনি দানবে পরিণত করে এই বাহিনীর, এই জাতির অপূরণীয় ক্ষতি করেছেন। এক বীরপ্রতীক জেনারেল আপনাকে অনুরোধ করেছিলেন, আপনার পুলিশ দাদাদের দিতে, তারা উত্তর-পূর্ব ভারতের কাশ্মীরে কাজে লাগাতে পারবে। তিনি আফসোস করে জানান, এই পুলিশ ’৭১ সালে আমি যখন যুদ্ধ করেছিলাম সঙ্গে থাকলে যুদ্ধ সহজ হতো। উপলব্ধি করেন সভ্য একটা বাহিনীকে আপনি শুধু ক্ষমতায় থাকার জন্য ঘাতকে রূপান্তর করে জনতার প্রতিপক্ষ বানিয়েছেন। সময়টা অনুকূলে না, অপেক্ষা করে, মাঠে নামলে ভালো হয় কি না ভেবে দেখুন। এক-এগারো আর এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন মাত্রায় মূল্যায়ন করলে সিদ্ধান্ত সঠিক হবে। বিচার হয় আপনি যা চান তাই। বিচারের সঙ্গে প্রহসন করে জাতি আস্থা হারিয়েছে বিচার বিভাগের ওপর। শাহবাগে হিন্দু জাগরণ মঞ্চ কার ইঙ্গিতে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে আসল মুক্তিযোদ্ধারা আপনার বিপক্ষে। আপনার সত্য বলার সমস্যা আছে। আপনি হেলিকপ্টারে থেকে ঘরে পানি দিয়েছে বলছেন আর মানুষ মরেছে। এসব প্যাথলজিক্যাল লাইয়ারের লক্ষণ। ঠান্ডা মাথায় ভাবুন কত লোক হয়েছে, কত কান্না, কত কষ্ট- ভাবলে পথ খুঁজে পাবেন।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক

[email protected]

সর্বশেষ খবর