বৃহস্পতিবার, ২২ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা

গণতন্ত্রের নতুন যাত্রা

এ এইচ খান রতন

গণতন্ত্রের নতুন যাত্রা

মানুষ জন্মগতভাবেই আশাবাদী। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে শুরু করে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আশাবাদী মানুষের লক্ষ্যে পৌঁছানোর ত্যাগ ও সংগ্রামের ধারাবাহিক ঘটনা প্রবাহই কালের সাক্ষী হয়ে পরবর্তী প্রজন্মের ইতিহাস বা অনুপ্রেরণা। ইতিহাস থেকে গ্রহণ করা শিক্ষা মানুষকে বাস্তব জীবন ও কর্ম সম্পর্কে যতটা জ্ঞান সমৃদ্ধ করে, একাডেমিক আর কোনো শিক্ষা তার সমতুল্য নয়। পেশাগত কর্মজীবনে একাডেমিক সনদ, শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারণ করে। কিন্তু, জ্ঞান ও বিচক্ষণতার সীমা নির্ধারণে শিক্ষাগত সনদের সঙ্গে ব্যক্তিগত বিচক্ষণতার ভূমিকা অপরিসীম। যে কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বময় কিংবদন্তিতুল্য প্রবাদ পুরুষরা যুগে যুগে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে, নিজ জ্ঞান, গুণ ও প্রতিভার সমন্বয়ে সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন;- একাডেমিক সনদে নয়। তথাপি, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে একাডেমিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। রাজনীতি, সমাজনীতি, কী অর্থনীতি, সব ক্ষেত্রে ইতিহাস সব্যসাচীর মতো অগ্রসরমান। তাকে সাময়িক বিভ্রান্ত করা গেলেও, কালের গর্বে হারিয়ে যাওয়া সত্য, পুনঃপ্রতিষ্ঠায় হাজার বছরের বন্ধুর পথ অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌঁছতে ইতিহাসই একমাত্র ভরসার স্থান। কিন্তু ইতিহাসের মহাফেজখানায় রক্ষিত অফুরণ জ্ঞান ভান্ডার থেকে মানুষ জ্ঞান আহরণে বিমুখ; কারণ মানুষ নগদে বিশ্বাসী। তথাপি, ইতিহাসের মহাফেজখানাই একমাত্র অক্ষয় দর্পণ, যেখান থেকে প্রয়োজনীয় খাতগুলো চিহ্নিত করে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সম্ভাব্য চিত্র আঁকা যায়। যাদের উদ্দেশে ওপরের কথাগুলো বলা, তারা আমাদের দেশের রাজনীতির মাঠে উচ্চাভিলাষী রথী-মহারথী। একটা জাতিকে অর্ধশতাব্দী ধরে, আরব্য রজনীর আলিফ-লায়লার গল্প আর আলো তুমি আলেয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে যারা ভুল পথে পরিচালিত করছে। অথচ, কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রের স্বর্গরাজ্যের ঠিকানা জনগণের কাছে আজও অধরা। বাংলাদেশের প্রায় সমসাময়িককালে স্বাধীনতা লাভ করে, বিশ্বদরবারে মজবুত গণতন্ত্র ও শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিতের ওপর সম্মানের সঙ্গে দাঁড়িয়ে যাওয়া দেশ দুটি, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর। অপরদিকে বন্দুকের নলের মুখে জনগণকে বলির পাঁঠা বানিয়ে, ক্ষমতার দণ্ড মুণ্ডে জগদ্দল পাথর হয়ে বসে আছে পাকিস্তান ও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। তুলনামূলক দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে গেলে, স্বৈরতন্ত্রে সর্বনাশ ও গণতন্ত্রের ভাদ্রমাস যে, একটা জাতিকে মর্যাদার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফরমে কোন পর্যায়ে নিয়ে দাঁড় করাতে পারে, এ দেশ দুটি তার বাস্তব উদাহরণ।

তেপ্পান্ন বছর আগে পাকিস্তনি সামরিক শাসনের শৃঙ্খল ভেঙে ভূমিষ্ঠ বাংলাদেশ, টিনএজ পেরিয়ে বহু আগেই পরিণত। অথচ, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে, অনেক ক্ষেত্রেই আমরা; কিন্তু ও কেন’র মাঝেই ঘুরপাক খাচ্ছি। শৈশব, কৈশোর ও যৌবন পেরিয়ে উপরোল্লিখিত চারটি দেশের অন্তত দুটির সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের কোনো সূচকেই আমাদের অবস্থান তাদের ধারেকাছেও নেই। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার উদাহরণ না হয়ে আমরা পাকিস্তান ও মিয়ানমারের নেতিবাচক উদাহরণ হয়ে আছি। সোশ্যাল মিডিয়া, চায়ের আড্ডা, পত্রিকার পাতা, গোলটেবিল বৈঠক, সভা-সমাবেশ, সর্বত্র আমাদের আলোচনার উপাদান আজ, ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের বিধ্বস্ত চিত্র! সুতরাং স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীতে আমাদের জাতীয় অর্জন কী, বারবার এ প্রশ্ন সামনে আশা স্বাভাবিক। প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিজ্ঞানীদের চন্দ্র জয়ের সফলতায়, জনগণের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস যখন, বিশ্ব মিডিয়ায় আছড়ে পড়ছে আমদের মিডিয়া তখন, দ্রব্যমূল্যের সিন্ডিকেটের কারণে জনজীবনে নাভিশ্বাসের খবর ছাপে। তুরস্ক পঁচিশ হাজার প্রকৌশলীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পঞ্চম প্রজন্মের ফাইটার জেট আকাশে উড়িয়ে যখন বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়; আমরা তখন নরম বিছানায় গা এলিয়ে রিমোট হাতে আয়েশি ভঙ্গিতে কফির পেয়ালায় চুমুক দিই আর রাজনৈতিক সহিংসতায় জনগণের করের টাকায় জাতীয় সম্পদ ধ্বংসের বীভৎসতার ফুটেজ দেখি। জীবনভিত্তিক বহুবিধ সূচকে দিন শেষে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির চাপ, আজ ভূমিষ্ঠ শিশুটির ন্যাপকিন থেকে শুরু করে অশীতিপর বৃদ্ধের হাতের লাঠিসহ আঠারো কোটি মানুষের মাথার ওপর। কাজেই ঋণ করে ঘি খাওয়ার প্রবাদ এ ক্ষেত্রে অচল। আমাদের জাতীয় রাজস্বে আনুপাতিক হারে অতিমাত্রায় বৈদেশিক ঋণের চাপ ও বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানি মূল্য পরিশোধ জাতীয় জীবনে মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায়, সম্ভাব্য উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর প্রতি সর্বাত্মক মনোযোগী হওয়া। পর্যায়ক্রমে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন গড়ে উঠেছে প্রতিটি সেক্টরে। মানুষ নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে পেশাগত আয়কে গৌণ ভেবে অবৈধ উপার্জনে গাড়ি বাড়ি করাকে অধিকার মনে করছে। জনসেবার রাজনীতি হয়ে উঠে গাড়ি বাড়ি আর স্বপ্ন পূরণের আলাউদ্দিনের চেরাগ। শক্ত হাতে তাদের বিচার না করে রাজনীতির সুযোগ দেওয়ায়, দেশি-বিদেশি চক্রান্ত্রে সমন্বয়ে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। উন্নয়নের পাশাপাশি মজবুত গণতন্ত্রের প্রত্যাশী জনগণ। দেশে একাদিক রাজনৈতিক দলের দলীয় আদর্শগত মতবিরোধ থাকতে পারে; এটাই গণতন্ত্র। বর্তমান সরকারের কাছে একটা মজবুত গণতন্ত্রের প্রত্যাশা সমগ্র জাতির। দ্রুততম সময়ে বৈষম্যহীন সাম্যবাদী রূপকল্প বাস্তবায়নের রোডম্যাপ অচিরেই জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে এমনটা প্রত্যাশা।

লেখক : কলামিস্ট

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর