একটি প্রথম শ্রেণির বাংলা দৈনিক সংবাদপত্রের ১২ আগস্ট সংখ্যায় প্রথম পাতার শীর্ষ খবরে বলা হয়েছে- সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং পরবর্তীকালের এক-দফার আন্দোলনে ১৬ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট অবধি মোট নিহতের সংখ্যা ৫৮০ জন। ৪ আগস্ট থেকে ৬ আগস্ট এই তিন দিনে নিহত হয়েছেন ৩২৬ জন- ৪ আগস্ট : ১১১ জন, ৫ আগস্ট : ১০৮ জন, ৬ আগস্ট : ১০৭ জন। ৪ থেকে ৬ আগস্ট নিহত ব্যক্তিদের পরিচয়- শিক্ষার্থী-২৩ জন, আওয়ামী লীগ-৮৭ জন, বিএনপি-১২ জন, পুলিশ-৩৬ জন বাকি অন্যসব শহীদ ব্যক্তি বিভিন্ন পেশার ও কর্মসংস্থানহীন লোকজন। ১৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ২১৭ জন। ৭ আগস্ট থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত নিহত ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যায় মোট ৩৭ জনের, তাদের কয়েকজনের মৃতদেহ দেরিতে হাসপাতাল মর্গে পৌঁছেছিল এবং বাকি অন্যসব ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটেছে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে নিহত হন বেশির ভাগ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও অন্য সব নাগরিক। পরে পাল্টা হামলায় আওয়ামী লীগ কর্মী ও পুলিশ সদস্যরা নিহত হন। আওয়ামী লীগ কর্মীদের যারা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালাতে নেমেছিলেন তাদের কিছুসংখ্যক পুলিশের গুলিতে নিহত হন এবং অন্য সবাই ও পুলিশ সদস্যদের সবাই নিহত হন গণপিটুনিতে।
১৪ আগস্ট একই বাংলা দৈনিকের খবর- ১৮ থেকে ২০ জুলাইয়ের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে বাসার ভিতরে, বারান্দা বা ছাদে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ৬ জন নারী ও কন্যাশিশু। যাদের একজন প্রৌঢ় নারী, এক মেয়ে-শিশু, এক কিশোরী ও তিন তরুণী। কর্তৃত্ববাদী সরকারের দস্যু-দানব বাহিনী কতটা নিষ্ঠুর হামলা চালিয়েছে যে, বাড়ির মধ্যেও কেউ নিরাপদ থাকতে পারেননি। গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন তার প্রকৃত হিসাব পাওয়াও মুশকিল, অনেক পরিবার ভয়েও সব ঘটনা প্রকাশ করেননি এত দিন। সাধারণ ও গুরুতর আহতের সংখ্যা কমপক্ষে ১০ হাজার হবে বলে অভিজ্ঞজনদের অনুমান।
নজিরবিহীন এই হত্যাযজ্ঞ। বিগত ৪০০ বছরেও এখনকার বাংলাদেশের ভূমিতে এমনকি অবিভক্ত বাংলায় শিক্ষার্থী বা জনতার বিক্ষোভ দমনে এত অল্প সময়ে এভাবে এত বিক্ষোভকারী বা সাধারণ মানুষ পুলিশের ও সরকারি দলের সন্ত্রাসীদের আক্রমণে নিহত হননি। এটা বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকেরই কল্পনার বাইরের ঘটনা। কীভাবে পারলেন আওয়ামী লীগ সরকার নেতারা- এতটা নির্মম হতে?ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা তো বটেই, তার বাইরের লোকজন যেমন- মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী শ্রেণির নাগরিকরা, এমনকি আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মী-সমর্থক, যারা সুস্থ-চিন্তার মানুষ, তারাও এরকম নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের এই চরম আহাম্মকির নিন্দা করেছেন। কারণ এটা শতভাগ সত্য যে, বিশে^র কোনো দেশেই একমাত্র উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার মতো কর্তৃত্ববাদী শাসকের দেশ ছাড়া কোনো শাসক-দল এত মানুষের লাশের ওপরে ক্ষমতায় বসে থাকতে পারবেন না। আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ- একটা সুস্থ-চিন্তার নিরপেক্ষ বক্তব্যও তারা কর্তৃত্ববাদী শাসক শেখ হাসিনাকে কখনো বোঝাতে পারেননি, তিনি নিজে যা ‘ভালো মনে করেছেন’ তা-ই করেছেন। তবে অনেকের মতোই, ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে- শেখ হাসিনার সবচেয়ে কাছের মানুষ তাঁর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বিশে^র অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার মাধ্যমে উচ্চ-ডিগ্রি অর্জন করে এবং দুনিয়াব্যাপী রাষ্ট্র-পরিচালনা ও রাজনীতির হাল-চাল দেখেও তাদের মা-কে তাঁর ‘নির্মম পুলিশি ও ছাত্রলীগ-সন্ত্রাসীদের হামলার’ পরিণতি সম্পর্কে সাবধান করে ঠেকাতে পারলেন না! তারা দুই ভাইবোন এতটা নির্বোধ হলেন কীভাবে!
বাংলাবাজারের এক বিখ্যাত প্রকাশক যিনি পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধ চেতনার পক্ষের ব্যক্তি, দুনিয়া-ঘোরা অভিজ্ঞ ব্যক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের অনেক বই প্রকাশ করেছেন; তিনি বলেছেন সম্প্রতি আমার এক নিকটজনের কাছে, ‘কীভাবে প্রধানমন্ত্রীর পদে এমন দীর্ঘ সময় থেকে, দশকের পর দশক আওয়ামী লীগের সভাপতি থেকে এবং সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর কন্যা হয়েও পারলেন- এই দেশের এত-সংখ্যক শিক্ষার্থী ও গণমানুষের বুকে তার বাহিনী দিয়ে, তার লোকজনকে দিয়ে এভাবে গুলি ছুড়ে হত্যা করতে? রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছোড়া একটা গুলিও ছাত্রছাত্রী কিংবা সাধারণ মানুষের বুকে লাগার আগেই তাঁর প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল। তিনি জীবনে যা পেয়েছেন, তাঁর আর কী পাওয়ার বাকি আছে! এমন নিষ্ঠুরতা তাঁর মধ্যে ভর করতে পারে আমি কল্পনাও করতে পারি না।’ আমি সামান্য রাজনৈতিক কর্মী, আমার মাথায়ও ঢুকছে না- দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে থেকে শেখ হাসিনা কেন এবং কীভাবে এরকম ‘মাতাল-আচরণ’ করলেন, চরম নিষ্ঠুরতা দেখালেন তার দেশবাসী শিক্ষার্থী (যারা ন্যায়সংগত কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেমেছিলেন) ও অন্য নাগরিকদের সঙ্গে, শিশু-কিশোর-তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে!
আসল বিষয়টা মনে হয় একটু ভিন্নতর। সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসন-শোষণ চালাতে চালাতে শেখ হাসিনা একটি ‘সাইকিয়াট্রিক পেশেন্ট’-এ পরিণত হয়েছিলেন। তিনি ভাবতেন, ‘আমার শাসনামলে দেশের যেসব মেগা-প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, সেসব তো নজিরবিহীন, এরপরে আমার কোনো ভুল হতেই পারে না, আমি হলাম সবচেয়ে বড় দেশপ্রেমিক শাসক, মুক্তিযুদ্ধ-চেতনার ধারক-বাহক-রক্ষক, দেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন করা সরকারপ্রধান, আমার তুলনা তো শুধুই আমি। আমাকে চ্যালেঞ্জ করে কার সাধ্য!’ আর ক্ষমতার বাইরে থাকা, এমনকি মন্ত্রীর পদমর্যাদায় রাষ্ট্রীয় সমস্ত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারতেন না। ক্ষমতার লোভ ও অহংকার তিনি পরিত্যাগ করার কথা কল্পনায়ও আনতেন না। এটাই প্রমাণ করে যে, তিনি ‘সাইকিয়াট্রিক পেশেন্ট’-এ পরিণত হয়েছিলেন।
কর্তৃত্ববাদী শাসনের চরম পর্যায়ে তিনি পুরোপুরি স্বৈরাচারের অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজেকে। তিনি একবারও শিক্ষা নেননি ইতিহাস থেকে। তাঁর পিতা এদেশের জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান অগণতান্ত্রিক একদলীয় বাকশাল শাসনব্যবস্থা কায়েম করেই নিজের ও তাঁর দলীয় সরকারের উচ্ছেদ হওয়ার সব ব্যবস্থা নিজেই পাকাপোক্ত করে রেখেছিলেন। তা না হলে ফারুক-রশীদ তথা ছয় মেজর ও আরও জুনিয়র ১১ অফিসারের এক ব্যাটালিয়ন/প্রায় ৭০০ সৈন্যের বাহিনী বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যা ও ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করতে সাহস পেত না!
এখন শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁকে ভারত বা আমেরিকা ও ইউরোপের কোনো রাষ্ট্রই গ্রহণ করতে- রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে রাজি নন। কতটা দুর্ভাগ্য তাঁর! তিনি শিক্ষার্থী ও গণমানুষ হত্যা করেছেন- যা গণহত্যার মতো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারযোগ্য অপরাধ। এর আগে তিনি তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারেক আহমদ সিদ্দিককে দিয়ে প্রতিরক্ষা দপ্তরের একটা গোপন বাড়িতে ‘আয়নাঘর’ বানিয়ে বিরোধী মতের রাজনৈতিক কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের গুম করেছেন, চরম শারীরিক-মানসিক নিপীড়ন করেছেন, অনেককে হত্যা করে লাশ গুম করে দিয়েছেন। পরিবারের সদস্যরা তাদের লাশটিও ফেরত পাননি। আরও কত প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য খুনের অভিযোগ আসবে তাঁর বিরুদ্ধে তার হিসাব কে বলতে পারে! আর অনাচার নৈরাজ্য তো করেছেন সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে- সব জাতীয় প্রতিষ্ঠান চরম নৈরাজ্যে ডুবুডুবু দশায়, তাদের সার্ভিস প্রদান এখন চূড়ান্ত ভঙ্গুর অবস্থায়। এসবের বিচার তো হতেই হবে- সঠিক ও সুবিচার। তা না হলে অচিরেই নতুন কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরতন্ত্রী কোনো শাসক বা শাসক গোষ্ঠীর সৃষ্টি হবে। কারণ, নতুন স্বৈরতন্ত্রীরা ভাববে, বিচার তো কারও আগে হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না, অতএব যা-খুশি তাই করাই তো ভালো।
তাই এসব বিচারের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সৎসাহস আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার থাকতে হবে, অবশ্যই থাকতে হবে। তা না হলে আর দেশের মানুষের কাছে, নিজের দলের মানুষের কাছে তাঁকে কেউ ফিরতে দেবে না। রাজপথের ওই আন্দোলনের কর্মীরাই তাঁকে প্রতিরোধ করবেন, তাঁর বিচার করে ছাড়বেন। তাঁর নিজেরই উচিত- বাংলাদেশ সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে যথাযথ বিচারের মুখোমুখি হওয়ার জন্য উপযুক্ত দেশি-বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ করা- যাতে শাস্তির মাত্রাটা একটু কম হয়। শহীদ পরিবারগুলোসহ ক্ষতিগ্রস্ত সব মানুষ এবং সামগ্রিকভাবে সমগ্র দেশবাসীর কাছে আন্তরিক ক্ষমা প্রার্থনা করা শেখ হাসিনার আশু-কর্তব্য। আর আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ইতিবাচক অর্জনের বিরুদ্ধে কোনোরকম ষড়যন্ত্র না করা হবে তাঁর বুদ্ধিমানের কাজ। এরপরও তিনি ‘নির্বোধ ও অশিক্ষিত-জনের মতো’ চক্রান্ত করে দেশবাসী শিক্ষার্থী ও গণমানুষের বিপক্ষে দাঁড়ালে তাঁকে আবারও ভয়াবহ পরিণতি বরণ করতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা- মহান আল্লাহপাক তাঁকে সুবুদ্ধি দেবেন।
♦ লেখক : বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক