রবিবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা

বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়ানো ধর্মের শিক্ষা

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়ানো ধর্মের শিক্ষা

আল্লাহতায়ালা বান্দাকে নানাভাবে পরীক্ষা করেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে পরীক্ষা করবেন। তুমি ধৈর্যশীলদের শুভ সংবাদ দাও, যারা তাদের ওপর বিপদ আপতিত হলে বলে, আমরা তো আল্লাহরই জন্য এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী’ (সুরা বাকারা ১৫৫-১৫৬)। বর্তমান সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির কারণে পানিবন্দি জীবনযাপন করছে অসহায় মানুষ। কোরআনের ঘোষণা অনুযায়ী মহান আল্লাহ মানুষকে বন্যা ও বিপদ দিয়ে পরীক্ষা করছেন। একইভাবে আমরা নিরাপদ আছি আল্লাহ আমাদেরও পরীক্ষা করছেন। আমরা অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াই, নাকি তাদের ভুলে নিজের সুখ ভোগে ব্যস্ত থাকি তা প্রমাণের সময় এসেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সমাজের বিত্তবানদের বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়ানো ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া বিবেকের দাবি এবং ধর্মের শিক্ষা। টাকা-পয়সা, খাদ্য, বস্ত্র, পানি, ওষুধসহ যার যা কিছু আছে, তা নিয়েই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্যাদুর্গতদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যের বিপদে সাহায্যের হাত বাড়ানোর প্রতিদান সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘যারা নিজেদের ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের দানের দৃষ্টান্ত হলো- যেমন একটি শস্যবীজ বপন করা হলো এবং তা থেকে সাতটি শীষ উৎপন্ন হয়েছে আর প্রত্যেক শীষে রয়েছে ১০০টি শস্যকণা। এমনিভাবে আল্লাহ যাকে চান তাকে প্রাচুর্য দান করেন। তিনি মুক্তহস্ত ও সর্বজ্ঞ’ (সুরা বাকারা-২৬১)। দানের ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আত্মীয়স্বজনকে তাদের প্রাপ্য দিন এবং মিসকিন ও মুসাফিরদেরও। এটা তাদের জন্য উত্তম, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে; তারাই সফলকাম। তোমাদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পাবে এ আশায় তোমরা সুদে যা কিছু দাও, আল্লাহর কাছে তা বৃদ্ধি পায় না। পক্ষান্তরে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় পবিত্র অন্তরে যারা দিয়ে থাকে তারাই দ্বিগুণ লাভ করে’ (সুরা রুম ৩৮-৩৯)। সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘বান্দা যতক্ষণ তার ভাইকে সাহায্য করবে, আল্লাহ ততক্ষণ তাকে সাহায্য করতে থাকবেন’ (মুসলিম)। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বিশেষজ্ঞরা বলেন, বান্দা যেভাবে ভাইয়ের বিপদে সাহায্যকারী হয়েছে, মহান আল্লাহও তার বিপদে উত্তম সাহায্যকারী হবেন। সাধ্যমতো মানবসেবায় নিজেকে উৎসর্গ করা ধর্ম ও মানবিকতার দৃষ্টিতে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ কাজ। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানবসেবায় তার ভাইয়ের সঙ্গে চলে, ওই কাজ না করা পর্যন্ত আল্লাহ ৭৫ হাজার ফেরেশতা দিয়ে তাকে ছায়া দান করেন। তারা তার জন্য রহমত ও মাগফিরাতের দোয়া করতে থাকে। তার প্রত্যেক কদমে একটি গুনাহ মাফ হয় এবং একটি মর্যাদা বৃদ্ধি পায়’ (আত তারগিব)। বন্যাদুর্গত বিভিন্ন এলাকায় পানিবাহিত নানা ধরনের রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের অভাবে তারা ভালো চিকিৎসা পাচ্ছে না। তাই জরুরি ভিত্তিতে বন্যা আক্রান্ত এলাকায় মানবেতর জীবনযাপনরত বানভাসি মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় ত্রাণ তৎপরতা, শুকনা খাদ্যসামগ্রী প্রদান, আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। হজরত আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পৃথিবীবাসীর প্রতি দয়া কর। আকাশের মালিক আল্লাহ, তোমাদের প্রতি দয়া করবেন (মুসতাদরাক)। হজরত ওসামা ইবনে জায়েদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই! আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন, যে তাঁর বান্দাদের প্রতি দয়া করে’ (বুখারি ও মুসলিম)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘মানুষের সেবা ও উপকারের জন্য আল্লাহ কিছু নিবেদিতপ্রাণ সৃষ্টি করেছেন। মানুষ বিপদে পড়লে তাদের শরণাপন্ন হয়। এসব রহম দিল ব্যক্তিরা আল্লাহর শাস্তি থেকে নিরাপদ থাকবে’ (আত-তারগিব)।

যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় বিপদগ্রস্ত ও দুস্থ মানবতার কল্যাণের জন্য দান-খয়রাত, জাকাত-সদকা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন না; সমাজের অসহায় বিপন্ন, বন্যাদুর্গত ও ক্ষতিগ্রস্ত নিঃস্ব অর্ধাহারি-অনাহারি গরিব মানুষের অভাব দূর, ক্ষুধা নিবারণ ও দারিদ্র্য বিমোচনের চেষ্টা করেন না; ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে অংশ নেন না; তিনি কখনো আল্লাহ ও রসুলের প্রিয়ভাজন হতে পারেন না। এ সম্পর্কে প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহও তার প্রতি দয়া করেন না (বুখারি ও মুসলিম)। তিনি (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দয়া করে না, সে আল্লাহর দয়া পায় না’ (বুখারি)। তাই আসুন! আমরা মানুষকে অসহায় বিপদগ্রস্ত দেখে পাশ কেটে চলে যাব না। তার দিকে এগিয়ে যাব। মানুষকে বিপন্ন রেখে তাদের দিক মুখ ফেরানোর পরিণাম খুবই ভয়াবহ। হজরত লোকমান তার ছেলেকে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রিয় সন্তান! তুমি মানুষকে দেখে অহংকার কিংবা তাচ্ছিল্যভরে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না।’ হায়!  আজ মানুষের পাশে থাকার শিক্ষা আমরা ভুলে যাচ্ছি। তাই তরুণরা দুস্থদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে না। আগে বন্যার আভাস পাওয়া মাত্রই ত্রাণ পৌঁছে যেত আর এবার বন্যা চরমে পৌঁছার পরও ত্রাণ নিয়ে এগিয়ে আসা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে না।

♦ লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর

সর্বশেষ খবর