আমাদের সন্তানেরা- নতুন প্রজন্ম সমস্বরে বলছে তারা ৩৬ দিনের কঠিন লড়াই শেষে স্বাধীনতা এনেছে। প্রায় ৭০০ ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এ স্বাধীনতা। আমরা যারা প্রবীণ আমাদের স্মৃতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম এখনও অটুট। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিও সমুজ্জ্বল। অনেকেই সন্তানদের এই দাবিকে ভিন্ন চোখে দেখছেন। কেউ কেউ ভাবছেন নতুন প্রজন্ম কি বাঙালির হাজার বছরের সেরা অর্জন একাত্তরের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করছে। মুক্তিযুদ্ধকে তারা কি দেখছেন খাটো করে?
আমরা যারা বাঙালির ২৩ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রাম দেখেছি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি, তাদের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের চিন্তা-ভাবনার দূরত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে একাত্তর আর সদ্য অর্জিত স্বাধীনতা বিতর্কে। যারা ভাবেন আমাদের নতুন প্রজন্ম একাত্তরের মহান স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করছে- তাদের ভাবনায় আছে মস্তবড় এক ভুল। নতুন প্রজন্ম তাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার পর অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। সে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শপথ নেওয়ার পর প্রথমেই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে ছুটে গেছেন সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে। যে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য। শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে পড়েছিলেন বৃষ্টির কবলে। ৮৪ বছর বয়সি সরকারপ্রধান স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও সেই বৃষ্টিকে তোয়াক্কা করেননি। শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে পিছু হটেননি। আশ্রয় নেননি নিরাপদ স্থানে কিংবা কারও ছাতার তলে।
নতুন প্রজন্ম জেনারেশন জেডের বসানো অন্তর্বর্তী সরকার অতি অবশ্যই এক সাংবিধানিক সরকার। আমাদের সংবিধানের শুরুতেই রয়েছে মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের কথা। সহজেই বোধগম্য সাংবিধানিক কোনো সরকারের পক্ষে একাত্তরের মহান স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার দূরের কথা পাশ কাটিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। এ নিয়ে কথা হচ্ছিল বন্ধুদের সঙ্গে। এক বন্ধু ক্ষমতাচ্যুত দলের একনিষ্ঠ সমর্থক। তিনি কথা প্রসঙ্গে প্রশ্নটি উঠতেই বললেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো বৈধতা নেই। কারণ সংবিধানে অনির্বাচিত কোনো সরকার গঠনের সুযোগ নেই। বন্ধুকে বললাম, কথাটি সত্যি। সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো বিধান নেই।ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগে বাধ্য হন। দেশ থেকে পালিয়ে যান তিনি। মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরাও গণরোষের মুখে ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ বলে আত্মগোপন করেন। দেখা দেয় এক সাংবিধানিক শূন্যতা। এ অবস্থায় রাষ্ট্রপতি করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ চান। মহামান্য আদালত অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরামর্শ দেন রাষ্ট্রপতিকে। এ পরামর্শ মেনেই গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকারের উপদেষ্টারা শপথ নিয়েছেন সংবিধান মেনে। সংবিধানের মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারেও তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ফলে একাত্তরের মহান স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের আনুগত্য নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। আর যারা দেশ পরিচালনার জন্য এ সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে- সেই নতুন প্রজন্ম তাদের আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়েছে লাল-সবুজ পতাকা হাতে নিয়ে। মাথায় বেঁধেছে লাল-সবুজ পতাকার শিরস্ত্রাণ। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, একাত্তরের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি যারা অঙ্গীকারবদ্ধ, তারা ৫ আগস্ট বা তাদের ভাষায় ৩৬ জুলাইয়ের বিজয়কে স্বাধীনতা অর্জন বলে অভিহিত করছেন কেন? এটি কি একাত্তরের স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করার শামিল? এ প্রশ্নের একটাই জবাব- না। একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষ যে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সে স্বাধীনতার কোনো তুলনা নেই। ৩০ লাখ মানুষের রক্ত আর দুই থেকে আড়াই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন আর ২৩ বছরের পাকিস্তানি দুঃশাসন শেষে বাংলাদেশের মানুষ অর্জন করেছিল ভৌগোলিক স্বাধীনতা। গোলামির শিকল ছিন্ন করে বিশ্বপরিসরে স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ দিয়েছে যে স্বাধীনতা তার সঙ্গে কোনো কিছুরই তুলনা নেই।
একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষ অর্জন করেছিল রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা। পাশাপাশি অর্জিত হয়েছিল জনগণের স্বাধীনতাও। গত ৫৩ বছরে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা দৃশ্যত সমুন্নত থাকলেও জনগণের স্বাধীনতা বারবার বিঘ্নিত হয়েছে। যার অভাবে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতাও অর্থহীন হয়ে পড়েছে বারবার জনগণের কাছে। নব্বইয়ের গণ অভ্যুত্থানে সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর দেশে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বের লোভ-লালসা ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মনোভাবের কাছে বারবার জিম্মি হয়ে পড়েছে সে স্বাধীনতা। ২০০৯ সালে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে মহাজোট সরকার। কিন্তু এ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনকে প্রহসন বললেও কম বলা হবে। ভোটারদের বদলে পুলিশ ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা ভোটের ভাগ্য নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। সাধারণ মানুষ কিংবা বিরোধী দল সমর্থকরা দূরের কথা আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও ভোটদানের অধিকার হারায়। দিনের ভোট আগের রাতে ব্যালট বাক্সে ভরে গণতন্ত্রের কফিনে পেরেক মারার ধৃষ্টতাও দেখায় পতিত কর্তৃত্ববাদী সরকারের চেলা চামুন্ডারা। হত্যা, গুম, জেল-জুলুম নিত্যকার ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। আয়নাঘরে বন্দি হয়ে পড়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। কর্তৃত্ববাদীদের মুখে ‘চেতনাবিষয়ক বাতচিত’ মুক্তিযুদ্ধের মহিমান্বিত মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করে। নজরকাড়া উন্নয়নের পাশাপাশি দেশজুড়ে চলে নজিরবিহীন লুণ্ঠন।
বাংলাদেশের ইতিহাস হলো ছাত্রসমাজের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস। জাতির সব মহৎ অর্জনে ছাত্রসমাজ ছিল সামনের কাতারে। ১৯৫২ সালে বুকের রক্ত ঢেলে তারা মায়ের ভাষা বাংলায় কথা বলার অধিকার অর্জন করেছিল। এর আগে কোনো জাতি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বুকের রক্ত ঝরায়নি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাড়ে চার বছরের মাথায় ছাত্রসমাজ উপলব্ধি করে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার নামে তারা প্রতারিত হয়েছে। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানি সেনাশাসক স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পতন ঘটে গণ অভ্যুত্থানে। যার নেতৃত্বে ছিল ছাত্রসমাজ। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও ছাত্রসমাজের ভূমিকা ছিল মুখ্য।
স্বাধীনতার পর গণতন্ত্রের বদলে যখনই ফ্যাসিবাদ ও সেনাশাসনের অপচর্চা চলেছে রুখে দাঁড়িয়েছে ছাত্রসমাজ। নব্বইয়ের গণ অভ্যুত্থানে তারাই ছিল পরিচালিকা শক্তি। ২০০৯ থেকে ২০২৪ পৌনে ১৬ বছর ধরে দেশে কর্তৃত্ববাদের যে নগ্ন চর্চা চলেছে তার সামনে বিরোধী দলগুলো ছিল অসহায়। কোথাও প্রতিবাদের কথা উচ্চারিত হলেই দমন করা হতো শক্তভাবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতাসীনদের হিজ মাস্টার্স ভয়েসে পরিণত হয়েছিল। দেশে চালু হয়েছিল জঘন্য এক পরিবারতন্ত্র। রাষ্ট্রীয় সম্পদ পরিণত হয়েছিল ক্ষমতাসীনদের ব্যক্তিগত সম্পদে। সংবিধানে উল্লিখিত গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রহসনে পরিণত হয়েছে নিষ্ঠুরভাবে।
এ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসে ছাত্রসমাজ। যার শুরু কোটা বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে। শান্তিপূর্ণ এ আন্দোলনকে পাত্তা দেয়নি অপরিণামদর্শী শাসকগোষ্ঠী। আন্দোলন নিয়ে শুরু হয় তাচ্ছিল্য। ছাত্রদের রাজাকার বলার ধৃষ্টতাও দেখান পতিত প্রধানমন্ত্রী। নেত্রীর কথায় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তার সহযোগীরা। কাকের সঙ্গে তুলনা করা হয় এমন এক নেতা হুমকি দেন ছাত্রদের আন্দোলন দমন করতে তাদের ছাত্রলীগই যথেষ্ট।
ছাত্রসমাজ ফুঁসে উঠেছিল রাজাকার অভিধায়। কাউয়া কাদেরের হুমকি-ধমকি বারুদে আগুন লাগায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেওয়া ব্রিফিংয়ে এক পুলিশ কর্মকর্তার হতাশাজনিত বক্তব্যে বাস্তব অবস্থার চিত্র ফুটে ওঠে। তার ভাষ্য- গুলি করলে একজন মরে কিন্তু অন্য কেউ সরে না। ছাত্রলীগ ও পুলিশ গুলি, টিয়ারগ্যাস সাউন্ড গ্রেনেড চালিয়েও আন্দোলন দমনে ব্যর্থ হয়। হেলিকপ্টার থেকেও চালানো হয় গুলিবর্ষণ। ছোড়া হয় টিয়ারগ্যাস। পুলিশ বিজিবি ব্যর্থ হলে নামানো হয় সেনাবাহিনী। জারি করা হয় কারফিউ। সেনাবাহিনী ছাত্র-জনতার রক্ত ঝরাতে অস্বীকৃতি জানালে কর্তৃত্ববাদের আয়ু প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ছাত্র-জনতার পাশে দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ রাজপথে নামে। ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের পর এ বছরের জুলাইয়ে গড়ে ওঠে সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্য। পার্থক্য হলো কোনো দল নয়, নেতা নয়, ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে সংঘটিত হয় মহাজাগরণ। দেশের মানুষ দীর্ঘ পৌনে ১৬ বছর ধরে কথা বলার, মতপ্রকাশের, নিজেদের ইচ্ছামতো চলার যে স্বাধীনতা হারিয়েছিল তা অর্জিত হয় ৩৬ জুলাই বা ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানের সুমহান জয়ে।
মানুষ জন্ম নেয় স্বাধীনভাবে। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার মতো জনগণের স্বাধীনতাও সবচেয়ে বড় মানবাধিকার। জনগণের স্বাধীনতা রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার প্রতিপক্ষ নয়। বরং এ স্বাধীনতা ছাড়া রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা অর্থহীন। রাষ্ট্রের প্রধান উপাদান নির্দিষ্ট ভূখন্ড নয়, মানুষ। মানুষ ছাড়া কোনো রাষ্ট্র কল্পনা করাও কঠিন। ছাত্র-জনতার আন্দোলন মানুষের কথা বলার, স্বাধীনভাবে চলার, যে অধিকার এনে দিয়েছে তাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। লাল-সবুজের পতাকাবাহী ছাত্রসমাজ তথা নতুন প্রজন্মের কাছেই জনগণের স্বাধীনতার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতাও নিরাপদ থাকবে- তার প্রমাণ ইতোমধ্যে মিলেছে। বাংলাদেশ এখন সব প্রতিবেশীর সঙ্গে মর্যাদা নিয়ে কথা বলছে। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম ভারত ও পাকিস্তানের ছাত্রদের আইকন হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানে বাংলাদেশি পতাকা নিয়ে মিছিল করছে সে দেশের ছাত্রসমাজ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও কর্তৃত্ববাদের বুকে কাঁপন ধরিয়ে আন্দোলন করছে ছাত্ররা। ঘুষ, দুর্নীতি ও বৈষম্যহীন দেশ গড়ার যে প্রেরণা ছাত্ররা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা পাড়ের সাহসী জাতির মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে তা অপরাজেয়। এটি বাস্তবায়িত হলে চব্বিশের পাশাপাশি একাত্তরের ৩০ লাখ শহীদের আত্মাও শান্তি পাবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
ইমেইল : [email protected]