বুধবার, ২৮ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা

ম্যান্ডেলা পেরেছিলেন, ড. ইউনূস কি পারবেন?

সৈয়দ বোরহান কবীর

ম্যান্ডেলা পেরেছিলেন, ড. ইউনূস কি পারবেন?

গত রবিবার (২৫ আগস্ট) জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দায়িত্ব গ্রহণের পর এটিই ছিল তার প্রথম নীতিনির্ধারণী ভাষণ। প্রায় ২৬ মিনিটের এই ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা দায়িত্ব গ্রহণের প্রেক্ষাপট, অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মপরিকল্পনা, আগামী নির্বাচন নিয়ে তার সরকারের সুস্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরেন। তবে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে নতুন কিছু ছিল না। গত দুই সপ্তাহ ধরে তিনি এবং তার সরকারের উপদেষ্টারা যেসব কথা বলছিলেন, তারই একটি সুবিন্যস্ত সামষ্টিক রূপ হলো এই ভাষণ। এই ভাষণেও ড. ইউনূস বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব দেশের সব মানুষকে একটি পরিবারের বন্ধনে আবদ্ধ করা। পরিবারে মতভেদ থাকবে। বাগবিতন্ডা হবে। কিন্তু আমরা ভাইবোন, আমরা বাবা-মা। আমরা কেউ কারও শত্রু না।’ এটি নিয়ে তৃতীয়বারের মতো ‘পরিবার ভাবনা’র কথা বললেন শান্তিতে নোবেল জয়ী এই অর্থনীতিবিদ। ৮ আগস্ট দেশে ফিরে বিমানবন্দরে তিনি গোটা বাংলাদেশকে একটি পরিবার বলেছিলেন। শপথ নেওয়ার পরপরই জাতির উদ্দেশে ভাষণেও তিনি বাংলাদেশকে একটি পরিবারের সঙ্গে তুলনা করেন।

তার এই ‘পরিবার ভাবনা’ ১৯৯০ সালে কারামুক্তির পর নেলসন ম্যান্ডেলার বক্তব্যের সঙ্গে তুলনীয়। কারামুক্তির পর প্রথম ভাষণে নেলসন ম্যান্ডেলা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন। বিভেদ এবং বিদ্বেষকে প্রশ্রয় না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন আফ্রিকানদের প্রতি। মুক্তি পেয়ে ম্যান্ডেলা প্রতিশোধ নেননি। ডি ক্লার্কের সঙ্গে সমঝোতা করেন। এই সমঝোতার ভিত্তিতেই ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে এএনসি বিপুল ভোটে জয়ী হলেও একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন নেলসন ম্যান্ডেলা। নতুন সংবিধান প্রণয়ন করেন। একটি ট্রুথ কমিশনের মাধ্যমে বর্ণবাদ সংক্রান্ত মানবাধিকার হরণের তথ্যানুসন্ধান করেন। বর্ণবাদে বিভক্ত একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য নেলসন ম্যান্ডেলার এই উদ্যোগ তাকে দিয়েছে অমরত্ব। জীবনের বেশির ভাগ সময়ে কারান্তরিন, পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরও এই মহান নেতা প্রতিশোধে উন্মত্ত হননি। ঐক্যের গান গেয়েছেন আজীবন। ‘সারা বাংলাদেশ একটি পরিবার’ কথাটির মধ্যে আমি ম্যান্ডেলার কণ্ঠের প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। নেলসন ম্যান্ডেলা পেরেছিলেন, ড. ইউনূস কি পারবেন?

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপি একটি জনসভা করে নয়াপল্টনে। সেই জনসভায় দীর্ঘদিন পর বক্তব্য রাখেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা ভাষণে বেগম জিয়া ‘ভালোবাসার বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। বেগম জিয়ার মতোই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে প্রতিহিংসার বিরুদ্ধে সহমর্মিতার বাংলাদেশের ডাক দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো আওয়ামী লীগের পতনের তিন সপ্তাহ পর ঐক্যের আহ্বান শুধু কথায়, কাজে তার ন্যূনতম প্রতিফলন নেই। বিভক্তি আর প্রতিহিংসা বেড়েই চলেছে সর্বত্র। শঙ্কার কালো মেঘ জমা হচ্ছে প্রত্যাশার আকাশে। রবিবার প্রধান উপদেষ্টা যখন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন সচিবালয় ছিল অবরুদ্ধ। আনসাররা তাদের দাবি আদায়ের জন্য সচিবালয় ঘেরাও করে রেখেছিল দুপুর থেকে। রাত ১০টায় শিক্ষার্থীরা সেনাবাহিনীর সহায়তায় আনসারদের হটিয়ে দেয়। দুই পক্ষের সহিংসতার ঘটনা ঘটে। সারা দিন কোথায় ছিল সরকার? কোথায় ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী? অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দাবির স্তূপে যেন পিষ্ট হওয়ার উপক্রম। প্রতিদিন ঘেরাও আর কর্মবিরতির এক নতুন সংস্কৃতিতে বিপন্ন আমরা। ১৪ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী সচিবালয় ঘেরাও করে এইচএসসি পরীক্ষা বন্ধ করিয়েছে। চাপের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে সরকার। এই লক্ষণগুলো ভালো না। আমরা কি মাৎস্যন্যায় সমাজে বাস করছি? নানা দাবি-দাওয়া তুলে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে, এ জন্য দায়ী কে? প্রশ্ন উঠেছে, সরকার কি যথেষ্ট ক্ষমতাবান? এই দুই সপ্তাহে এমন কিছু ঘটনা ঘটছে যা অতীত সরকারের মতোই। প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছে দেশ। জবরদস্তি এবং বল-প্রয়োগ প্রবণতা বাড়ছে উদ্বেগজনকভাবে।

এসব দেখে অতীতের কিছু ঘটনা মনে পড়ছে। ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি এটিএন নিউজের একটি টকশোতে উপস্থিত হন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম। সেখানে তার একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে শুরু হয় মামলার বন্যা। সারা দেশে শতাধিক মানহানি মামলার নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে। সবাই বুঝতে পারে স্রেফ হয়রানি করার জন্যই এসব মামলা। বিরুদ্ধ মত দমনের এই স্থূল চেষ্টা সফল হয়নি। সাধারণ মানুষ বিরক্ত হয়েছে। এসব মামলা ছিল হাস্যকর। এখনো সেই একই নাটক। মামলার উৎসব চলছে যেন দেশজুড়ে। বাছ-বিচার ছাড়া এসব মামলা এই সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

২০২১ সালের ১৭ মে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে হেনস্তা হন প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়, জব্দ করা হয় পাসপোর্ট। দুই বছর ধরে চলে লাগাতার হয়রানি। এ সময় তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন দলমত নির্বিশেষে সব গণমাধ্যমকর্মী। বিশেষ করে প্রেস ক্লাবের তখনকার সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন নিজে ছুটে গিয়েছিলেন। তথ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, এ কাজটি ঠিক হচ্ছে না। ক্ষমতাসীনরা কেউ বোঝেনি। ওই ঘটনায় রোজিনাই বড় হয়েছেন। সমালোচিত হয়েছে সরকার।

এখন গণমাধ্যম কর্মীরাই যেন একে অন্যের প্রতিপক্ষ। একজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলার পর অন্যপক্ষ বলছে বাহ্ বেশ! দেশে সাংবাদিকতা নেই। আছে পক্ষ-প্রতিপক্ষ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে যাকে তাকে যখন খুশি গ্রেপ্তার করার এক ভয়ানক প্রবণতা চালু হয়েছিল বাংলাদেশে। শুধু সাংবাদিক নয়, মুক্ত চিন্তা এবং ভিন্নমতের লোকজনকে এই আইন দিয়ে সীমাহীন হয়রানি করা হয়। একুশে টেলিভিশন দখল করে নেয় সরকারের অনুগত ব্যবসায়ী গ্রুপ। ভিন্নমতের গণমাধ্যম আক্রান্ত হয়। বন্ধ হয়ে যায় দিগন্ত টিভি, চ্যানেল ওয়ান। আমার দেশ, দিনকালকে বন্ধ করা হয় আইনের মারপ্যাঁচ দিয়ে। শুধু গণমাধ্যম নয়, সবক্ষেত্রেই এই আগ্রাসী তৎপরতা দৃশ্যমান ছিল। রাষ্ট্র সংস্কারের অঙ্গীকারে দায়িত্ব নেওয়া সরকার দুই সপ্তাহে কি এই সংস্কৃতি থেকে বেরোনোর বার্তা দিতে পেরেছে?

প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সবচেয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে গণমাধ্যমে। সম্প্রতি ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া সেন্টারে যেভাবে সন্ত্রাসী দুর্বৃত্তরা নির্বিচারে হামলা করেছে, তা নজিরবিহীন। এটা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ। একযোগে সাতটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে হামলার পর বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেছে। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে হামলাকারীদের শনাক্ত করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি এখনো। এ ধরনের নির্লিপ্ততা নতুন সরকারকে কেবল প্রশ্নবিদ্ধই করবে। ঢালাওভাবে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হচ্ছে হত্যা মামলা। নিশ্চয়ই যারা অপরাধ করেছেন, অন্যায় করেছেন তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু সেটা করতে হবে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে। হত্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করার সংস্কৃতি আসল অপরাধকে আড়াল করবে। প্রতিদিন গণমাধ্যমে কর্মরত সংবাদকর্মীদের নামে নানা তালিকা বেরোচ্ছে। কারা কীভাবে এই তালিকা করছে কেউ জানে না। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এসব ভুয়া। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে গণমাধ্যমে এক অস্বস্তি এবং আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। ভিন্নমত রোধ করলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আন্দোলনের ফসল এই সরকার। আওয়ামী লীগ তার প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপারে ছিল নির্মম। বিএনপি-জামায়াতকে পুরোপুরি নিঃশেষ করতে চেয়েছিল। বেগম জিয়ার প্রতি অমানবিক আচরণ করা হয়। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে মামলা করা হতে থাকে। বিএনপি-জামায়াতের এরকম নেতা কম যাদের বিরুদ্ধে মামলার সেঞ্চুরি নেই। যে কোনো সহিংসতা ঘটলেই মামলার আসামি করা হতো বিএনপির শীর্ষ নেতাদের। সঙ্গে আসামি করা হতো ‘অজ্ঞাতনামা’ বহু ব্যক্তিকে। এটাই ছিল পতিত সরকারের অস্ত্র। বিরোধী দলের কেউ একটু বেশি নড়াচড়া করলেই ‘অজ্ঞাতনামা’র শূন্যস্থানে তাদের নাম বসিয়ে দেওয়া হতো। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে আনা হতো। রিমান্ডে হাই কোর্টের ১৫ দফা নির্দেশনার একটিও মানা হতো না। রিমান্ডে আটক ব্যক্তি কী বলছেন, তা ‘ফাঁস’ করে দেওয়া হতো গণমাধ্যমে। এসব বক্তব্য আদৌ আটক ব্যক্তি বলেছেন কি না তা যাচাই-বাছাই করার কোনো সুযোগ দেওয়া হতো না। আদালতে ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। নিম্ন আদালত তো বটেই, উচ্চ আদালতও নিয়ন্ত্রিত হতো সরকারের ইশারায়। বিরোধী নেতাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পর্যন্ত দেওয়া হতো না।

কিন্তু শেখ হাসিনার পতনের পর ‘নতুন’ কি পরিস্থিতি আদৌ পরিবর্তন হয়েছে? কিংবা আমরা কি সেই সব ভ্রান্ত এবং অগ্রহণযোগ্য পথের দরজা বন্ধ করে দিয়েছি? সম্প্রতি কিছু ঘটনা উদ্বেগ বাড়িয়েছে। এই ঘটনাগুলো আবার মনে করিয়ে দিচ্ছে পুরনো সেই দমবদ্ধ ব্যবস্থার কথা। প্রধান উপদেষ্টার ঐক্যের ডাকের বিপরীতে আমরা দেখছি প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধের নেশায় উন্মুক্ত কিছু অর্থহীন পাগলামি। একই কায়দায় ঢালাও মামলা হচ্ছে। অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির মাধ্যমে ফাঁসানো হচ্ছে যাকে তাকে। রিমান্ডের তথ্য ফাঁস করা হচ্ছে। শুরু হয়েছে আবার প্রতিপক্ষকে নির্মূলের সেই পুরনো খেলা। প্রতিটি মামলায় মূল অস্ত্র ‘অজ্ঞাতনামা’।

আশার কথা ‘ঢালাও মামলা’ করে প্রতিপক্ষের ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করায় সমালোচনা করতে শুরু করেছেন সচেতন নাগরিকবৃন্দ। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেসের (ব্লাস্ট) অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন গত শনিবার (২৪ আগস্ট) এক অনুষ্ঠানে ঢালাও মামলার তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘এগুলো টিকবে না এবং প্রথম ধাপ পার হতে পারবে না।’ সারা হোসেন বলেন, ‘ছাত্র আন্দোলনের ফসলকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে মামলাগুলো।’

গত শুক্রবার ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম তার সম্পাদিত পত্রিকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ কলাম লিখেছেন। ‘প্রধান উপদেষ্টার হাতকে শক্তিশালী করুন’ শিরোনামে এই কলামে মাহফুজ আনাম লিখেছেন- যেভাবে গণহারে প্রমাণ ছাড়াই সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ নেতা ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে, তাতে আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। অবস্থাদৃষ্টে ‘আগে মামলা পরে প্রমাণ’ পন্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এত বেশি হত্যা মামলা হচ্ছে যে বিষয়টি জনমনে অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করছে। এমন মামলা যত বেশি হবে, ততই গ্রহণযোগ্যতা কমতে থাকবে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহিতা নিশ্চিতের জন্য কয়েকটি যথোপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ সমর্থিত, বস্তুনিষ্ঠ ও বলিষ্ঠ মামলাই যথেষ্ট। কিন্তু যেভাবে বিষয়টি এগোচ্ছে, তাতে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, মুনতাসির মামুন, শাহরিয়ার কবিরদের মতো বুদ্ধিজীবী; সাবেক বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম; হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেননের মতো রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হচ্ছে।

আগের মতোই এখনো আইনের অপব্যবহার দেখতে পাচ্ছি। গ্রেপ্তার মন্ত্রীরা যেসব অপরাধ করেছেন-‘ক্ষমতার অপব্যবহার, আর্থিক খাত সংশ্লিষ্ট অপরাধ, ঘুষ, দুর্নীতি ও ব্যাংকিং খাতে কারসাজি-সেগুলোর বদলে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। প্রতিবার এমন হত্যা মামলা দায়েরের সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে আইনি প্রক্রিয়া।’

‘হত্যা মামলা’ এখন রীতিমতো কৌতুকে পরিণত হয়েছে। রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সাংবাদিক, ব্যবসায়ী এমনকি বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন সাকিব আল হাসানকে পর্যন্ত হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। এভাবে ঢালাও মামলা নিরুৎসাহিত করার কোনো উদ্যোগ নেই অন্তর্বর্তী সরকারের। প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণে এ ধরনের মামলার জন্য চাপ সৃষ্টি না করার অনুরোধ জানিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, সরকারের কাজ কি কেবল অনুরোধ জানান? যাদের বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। ব্রিটিশ সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মী ডেভিড বার্গম্যান সালমান এফ রহমান এবং আনিসুল হককে আদালতে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় কঠোর সমালোচনা করেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তাদের আইনজীবীদের কথা বলতে দেওয়া হয়নি। ডা. দীপু মনিকে আদালতে অপদস্থ করা এবং শারীরিকভাবে আঘাত করার ঘটনাকেও ‘বাজে দৃষ্টান্ত’ বলেছেন বার্গম্যান। এসবই পুরনো এবং বাজে সংস্কৃতি। যেখান থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্যই এত আত্মত্যাগ। এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি জনগণের মধ্যে শুধু হতাশাই আনবে। প্রকৃত অপরাধীদের প্রতি সৃষ্টি করবে সহানুভূতি। রিমান্ডে নিয়ে আটক ব্যক্তির বক্তব্য ফাঁস করে মিডিয়া ট্রায়ালের সেই ভ্রান্ত পুরনো কৌশল আবার শুরু হয়েছে। প্রতিপক্ষকে জনসম্মুখে হেয় করার চটুল, কুৎসিত এই কসরত ইতোমধ্যে প্রত্যাখ্যাত। মনে রাখতে হবে, এসব করেই আওয়ামী লীগের নৌকা ডুবেছে। মানুষ এসব পছন্দ করে না।

আইন আদালতের প্রাঙ্গণের বাইরে চর দখল এবং বল প্রয়োগের মাধ্যমে চেয়ার দখলের ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন স্থানে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যে কায়দায় শিক্ষকদের অপমানিত করা হচ্ছে তা দুর্ভাগ্যজনক। জোর করে পদত্যাগপত্র আদায় করার খবর আসছে প্রতিদিন। একজন শিক্ষিকাকে দেখলাম গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। এটা কীভাবে সম্ভব? এসব কীসের আলামত? দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে রীতিমতো নৈরাজ্য। ৪৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নেই। সরকারকে দ্রুত শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। শিক্ষা উপদেষ্টা এসবের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন বটে। কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছে না। বন্ধ হচ্ছে না নৈরাজ্য।

ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধেও দায়ের করা হচ্ছে কাল্পনিক হত্যা মামলা। অর্থনৈতিক এই সংকটে যখন উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীদের আস্থায় আনা দরকার, অর্থনৈতিক ক্ষত সারতে সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করা দরকার। সেখানে চলছে প্রতিশোধ গ্রহণের সর্বনাশা প্রবণতা। ব্যবসায়ীদের নতুন করে হয়রানি করার পাঁয়তারা চলছে সেই পুরনো কায়দায়। কে আমার, কে তোমার খুঁজতে গিয়ে আবার বিভক্তির আগুন ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সর্বত্র। এই বিভাজন, প্রতিহিংসা চায়নি বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার প্রবণতা কখনো ভালো ফল দেয় না। গত ১৫ বছর যারা বিএনপি-জামায়াতকে নির্মূল করতে চেয়েছিল, তারা ছিল ভুল। সেই ভুল আবার করলে আমরা আবার পথহারা হব। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে বিগত সরকার নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দমন-পীড়ন কোনো সমাধান নয়। ভয়ের সংস্কৃতি আবার নতুন করে সৃষ্টি হলে আন্দোলনের আকাক্সক্ষার মৃত্যু হবে। গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন পথ হারাবে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের মধু চন্দ্রিমার সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। শক্ত হাতে দেশে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। এখন আহ্বান, অনুরোধ করে সরকার দায় এড়াতে পারবে না। কাজ করে দেখাতে হবে। দূর করতে হবে আতঙ্ক। আইনের শাসন, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। বিচারহীনতা আর দখলদারির সংস্কৃতি থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে দ্রুত। সব মত ও পথের মানুষকে নিয়ে গড়তে হবে বাংলাদেশ পরিবার। না হলে এই সরকারও পথ হারাবে।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর