বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা

দায়-দণ্ড নিতে হবে অপঘাত মৃত্যুর

কামাল মাহমুদ

দায়-দণ্ড নিতে হবে অপঘাত মৃত্যুর

সব অপঘাত মৃত্যুকেই দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিয়ে গা বাঁচানো যাবে না। নির্মাণাধীন ভবনে কাজ করার সময় ওপর থেকে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যু প্রায়ই ঘটে। এগুলোকে নিছক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। নিহতের পরিবারকে নামমাত্র কিছু টাকা কিংবা নানা আশ্বাস দিয়ে, ‘আল্লার মাল আল্লা নিয়ে গেছে’ ধরনের কথা বলে, গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়েই বিষয়টা মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়। অথচ এ রকম প্রতিটি মৃত্যুর কারণ হচ্ছে- অত্যাবশ্যকীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা না নেওয়া। যে দায়িত্ব অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ভবন নির্মাণ কর্তৃপক্ষের; সে ব্যক্তি হোক বা প্রতিষ্ঠান। একজন শ্রমিককে যখনই, যিনি কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ করবেন, তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ওই নিয়োগকর্তারই। দরিদ্র শ্রমিকের পক্ষে এ আয়োজন করা সম্ভব নয়। কিন্তু নির্মাণাধীন স্থাপনার মালিক বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারের পক্ষে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা মোটেই কঠিন না। যেহেতু তারা কোটি কোটি টাকার সংস্থান করেই কাজে হাত দিয়েছেন।

তারপরও নিরাপত্তার ওই দরকারি কাজটা করেন না- কারণ দু-একজন শ্রমিকের মৃত্যুতে তাদের বিশেষ কিছু এসে যায় না। মানুষের মৃত্যুকেও তারা সহজেই ম্যানেজ করে ফেলতে পারেন। এদিকে নিহতের পরিবার পড়ে অনিশ্চয়তার অথৈ সাগরে। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারানো মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ থাকে না। নিয়তির লিখন বলে সবকিছু মেনে নিয়ে তারা জীবনের কঠিন যুদ্ধ চালিয়ে যান। কারণ, তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরনোর অবস্থা। অর্থ-বিত্তশালীদের সঙ্গে মামলা লড়ার সময়, সামর্থ্য কিছুই তাদের থাকে না।

গত ১৭ মে রাজধানীর সবুজবাগে নির্মাণাধীন ভবনের দশ তলার বাইরে কাজ করার সময় মাচা ভেঙে পড়ে তিন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ১৯ মে কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় সাত তলা ভবনে কাজ করার সময় পড়ে একজন শ্রমিক মারা যান। সারা দেশে এমন দুর্ঘটনা আরও কত ঘটেছে, ঘটছে তার সব হয়তো খবরই হয়নি।

বহুতল ভবনের দেয়াল প্লাস্টার বা রং করা, জানালা-ভেন্টিলেটরে কাচ লাগানো, এসি ফিট করা- এমন অনেক কাজ থাকে যা শ্রমিকদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভবনের বাইরে ঝুলেই করতে হয়। কাজ তো করতেই হবে; সেখানে নির্মাণ কর্তৃপক্ষ যদি নিচে নিরাপত্তার জাল বিছিয়ে দেন, পুরু ফোম পেতে রাখেন অথবা মজবুত রশি দিয়ে শ্রমিককে নিরাপদ বেল্টে বেঁধে শক্ত ঘেরা মাচায় দাঁড়িয়ে কাজ করার সুযোগ করে দেন- পড়ে মৃত্যুর প্রশ্ন উঠবে না। এসব ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে কোনো শ্রমিকের মৃত্যু হলে- তার দায় অবশ্যই মালিক-ঠিকাদারকে নিতে হবে। যিনি দায়িত্বহীনভাবে ওই হতভাগ্য শ্রমিককে নিয়োগ করেছিলেন, তার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনতে হবে। অন্যদিকে তাৎক্ষণিকভাবে সব কাজ বন্ধ করে, স্বল্পতম সময়ের মধ্যে নিহতের পরিবারকে অন্তত কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করতে হবে। প্রয়োজনে ওই সম্পত্তি জব্দ করে হলেও। পাশাপাশি, কোনো একটি ভবন নির্মাণ কাজের শুরু থেকেই সরকারের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের নিয়মিত তদারকি থাকতে হবে। সেখানকার সব কাজ নিয়ম মেনে করা হচ্ছে কি না এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থাগুলো সঠিকভাবে নেওয়া হচ্ছে কি না দেখতে হবে। দুর্ঘটনার পর হামলে পড়ে হাম্বতম্বি করলে কর্মকর্তাদের পকেট ভারী হতে পারে, কিন্তু নিহতের পরিবারের জন্য তা কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। অথচ ওই কাজটাই খুব তৎপরতার সঙ্গে করতে দেখা যায়। রাজধানীর বেইলি রোডে রেস্তোরাঁয় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অর্ধ শতাধিক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর কদিন বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় এরকম অভিযানের মচ্ছব দেখা গিয়েছিল নানা সংস্থা ও বিভাগের। এ ছাড়া, সেপটিক ট্যাংক, পানির ট্যাংক, পুরনো কূপ সংস্কার বা পরিষ্কার করতে নেমেও জমে থাকা বিষাক্ত গ্যাসে অনেক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। গত ১৪ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক মার্কেটের সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে গিয়ে তিনজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ১৮ মে গোপালগঞ্জে একই কাজে দুই শ্রমিক মারা যান। ২৬ মে লক্ষ্মীপুরে একজন এবং ১৪ জুন শরীয়তপুরে দুজন শ্রমিকের মৃত্যু হয় সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে গিয়ে। এসব খবর বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এভাবে আরও কত প্রাণ গেছে তার হিসাব নেই। ফলে এ ধরনের কাজ করানোর আগে সেখানে কোনো বিষাক্ত গ্যাস জমে আছে কি না, সেখানে নামা ওই শ্রমিকের জন্য নিরাপদ কি না- যথাযথভাবে পরীক্ষা করে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। শ্রমিকদের জন্য বর্জ্য ও দূষণরোধী পোশাক, গামবুট, গ্লাভস, মাস্কের ব্যবস্থাও করতে হবে। করা হয় না বলেই প্রায়ই এসব কাজে নেমে শ্রমিকদের প্রাণহানি ঘটে। এমন ক্ষেত্রেও নিয়োগকর্তাকে ওই মৃত্যুর দায়-দণ্ড নিতে হবে। উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে তাদের বাধ্য করতে হবে। ধনীদের জাকাতের কাপড় বিতরণকে কেন্দ্র করে অনেক সময় পদদলনে মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ২০১৭ সালে চট্টগ্রামে এমন এক আয়োজনে দশজনের মৃত্যু হয়েছিল। এ বছরও বরিশাল এবং রাজবাড়ীতে জাকাতের কাপড় আনতে গিয়ে পদদলিত হয়ে দুই নারীর মৃত্যু হয়েছে। আগাম ঘোষণা দিয়ে গরিব মানুষদের জড়ো করে বিতরণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা না নেওয়ায় হুড়োহুড়িতে পদদলিত হয়ে চরম কষ্টের মৃত্যুর শিকার হন তারা। এই মৃত্যুর দায়ও ওই ব্যক্তিদেরই নিতে হবে- যাদের দায়িত্বহীনতার কারণে এমন বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটে।

এমন সব অনাকাঙ্ক্ষিত অপঘাত মৃত্যুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইনকানুন নিশ্চয়ই আছে। বৃহত্তম জনস্বার্থে, তা আরও কঠোর করতে হবে। মামলা হতে হবে রাষ্ট্রপক্ষের উদ্যোগে। আর এ সংক্রান্ত মামলার বিচার এবং শাস্তির প্রক্রিয়া দ্রুততর করতে হবে। না হলে হতদরিদ্র মানুষদের এসব দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু কমানো যাবে না।

লেখক : সহকারী সম্পাদক বাংলাদেশ প্রতিদিন

সর্বশেষ খবর