সবকিছুর মালিক মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন। তাঁর ইচ্ছায় আমরা দুনিয়াতে এসেছি এবং তাঁর ইচ্ছাতেই দুনিয়া থেকে বিদায় নেব। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কেউ এই দুনিয়াতে আসতে পারে না, আবার কেউ যেতেও পারে না। আল্লাহর ইচ্ছা ও কুদরতের ওপর সবকিছু নির্ভর করে। হাকিমুল উম্মত হজরত থানভী (রহ.) একটি সুন্দর ঘটনা লিখেছেন। ঘটনাটি হলো- এক বুজুর্গ ছিলেন। জনৈক ব্যক্তি ওই বুজুর্গের সাক্ষাতে এসে কুশল জানতে চেয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কেমন আছেন? উত্তরে বুজুর্গ ব্যক্তি বললেন, কোনো বাদশাহকে কি এ কথা জিজ্ঞাসা করতে হয়, ‘আপনি কেমন আছেন? শোনো, আমি এমন এক বাদশাহ, যার কথায় এই পৃথিবী পরিচালিত।’ কথাটা শুনতে কুফুরি কালামের মতো মনে হয়। কিন্তু বুজুর্গদের কথা এমনই হয়, তাঁদের কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে কোনো বিরূপ ধারণা করে ফেলা অনুচিত। তাঁদের কথার মাঝে অনেক সময় গভীর রহস্য লুকায়িত থাকে। যা সাধারণ মানুষ বুঝতে অক্ষম। ওই বুজুর্গের কথাও তেমনি রহস্যাবৃত। তিনি যে বললেন, ‘পৃথিবীর সবকিছু আমার কথামতো চলে’ এ কথার উদ্দেশ্য ও রহস্য কী? উদ্দেশ্য হলো, বুজুর্গ এ কথা বলতে চেয়েছেন যে, কোনো বিষয়ে আমার নিজস্ব কোনো ইচ্ছা নেই। আল্লাহ ও তাঁর রসুলের যে ইচ্ছা সেটাই আমার ইচ্ছা। আমি আমার ইচ্ছাকে কোরবান করে দিয়েছি আল্লাহর ইচ্ছার ওপর। সুতরাং আল্লাহ যেটা ইচ্ছা করেন সেটা আমারই ইচ্ছা। অর্থাৎ আমার মাঝে আমি বলতে কিছুই নেই। আমি আমার সবকিছু আল্লাহর মাঝে বিলীন করে দিয়েছি। আল্লাহ ছাড়া আর কিছুই আমার অন্তরে নেই। সেই হিসেবে মূলকথা এটাই হলো, আল্লাহই পৃথিবীর সবকিছু পরিচালনা করেন। আর আল্লাহর ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা। সুতরাং আমার ইচ্ছামতোই পৃথিবী পরিচালিত হয়। আমরা কি পারি না?
এবার তাহলে বুজুর্গের অবস্থা আর আমার-আপনার অবস্থা মিলিয়ে দেখি। বুজুর্গ তো স্বীয় অন্তরসহ সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মালিকের অনুগামী করেছেন, আমরা কি পারি কোনো একটি অঙ্গকেও আল্লাহর আনুগত্যে পুরোপুরি সোপর্দ করতে? আমরা যদি শুধু একটি চোখ নিয়ে চিন্তা করি, তা আল্লাহর ইচ্ছা মোতাবেক চালাব, তাহলে সেটাও আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। আসলে আমাদের চেষ্টা নেই। চেষ্টা করলে সবই সম্ভব। তা না হলে ওই বুজুর্গ পারলেন কীভাবে? পৃথিবীতে এমন অসংখ্য বুজুর্গ আগেও ছিলেন এবং এখনো আছেন। যাদের কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে সামান্য পরিমাণও আল্লাহর নাফরমানি প্রকাশ পায় না। উপযুক্ত চেষ্টা-সাধনা করেই তাঁরা সেই স্তরে পৌঁছেছিলেন। আমার-আপনার জন্য কি সেই স্তরে পৌঁছা অসম্ভব? কখনো না। প্রয়োজন শুধু মেহনত-মোজাহাদার। কিন্তু কেমন মোজাহাদা? কোনো বিষয়ে কৃতিত্ব দেখিয়ে দেশের সরকারপ্রধানের হাত থেকে পুরস্কার নিতে চাইলে আপনি কেমন চেষ্টা মেহনত করবেন চিন্তা করুন! যেহেতু আল্লাহ দুনিয়ার সব বাদশাহ, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মালিক, অতএব তাঁর কাছ থেকে পুরস্কার পাওয়ার জন্য তেমন চেষ্টাই করতে হবে।
আনুগত্য দুই কারণে হয়। যথা (১) শাস্তির ভয়ে (২) মহব্বতে। আমরা যে তাফসির করছি ও শুনছি, কোরআন-হাদিস পড়ছি ও পড়াচ্ছি, আল্লাহর হুকুম-আহকাম মেনে চলার চেষ্টা করছি, এসব কিছুর পেছনে উপরোক্ত দুই কারণ বিদ্যমান। আমরা কেউ আল্লাহর শাস্তির ভয়ে এগুলো করছি, আবার কেউ আল্লাহর মহব্বতে করছি। আল্লাহ পাক উভয়কেই পুরস্কার দেবেন। তবে উভয়ের পুরস্কারের মাঝে পার্থক্য হবে। দুনিয়াতে যেমন পার্থক্য হয়, তেমনি আখেরাতেও পার্থক্য হবে। যে ব্যক্তি মহব্বতে কাজ করে তার মাঝে গোলামির যোগ্যতা সৃষ্টি হয়। গোলাম ২৪ ঘণ্টাই মালিকের চিন্তা করে। আর যে ব্যক্তি ভয়ে কাজ করে সে শ্রমিকের মতো কাজ করে টাইম টু টাইম। শ্রমিক এবং গোলামের কাজের মধ্যে রয়েছে রাত দিনের পার্থক্য। শ্রমিক তার নিজের স্বার্থ দেখে, আর গোলাম তার মনিবের স্বার্থ দেখে।সুলুকের রাস্তায় আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়ার জন্য ভয় এবং মহব্বত উভয়টা প্রয়োজন। কারণ সবার অন্তরে তো মহব্বত পয়দা হয় না। তাই আল্লাহর একান্ত প্রিয়পাত্র হতে না পারলেও অন্তত আল্লাহর নাফরমান না হোক, তার আজাবের ভয়ে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকুক; এ কারণেই ভয়কেও রাখা হয়েছে। যাতে এক নম্বর পজিশনে না পারলে দুই নম্বর পজিশনে হলেও থাকতে পারে। মানুষ স্বভাবগতভাবে যে কোনো ভয়ানক ও ক্ষতিকর জিনিস থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করে। যেমন- সাপ দেখলে পলায়ন করে। সুতরাং ‘গুনাহের কারণে জাহান্নামে যেতে হবে’ এই ভয় যদি মানুষের মাঝে আসে তাহলে সে অবশ্যই গুনাহ ছেড়ে দেবে। এ জন্যই তাছাওউফের লাইনে যারা প্রথম পা রাখে, তাদের গুনাহের কাজের ভয় শেখানো হয়। আমাদের মাদরাসাগুলোতে আসরের পর একটি বই পড়ে শোনানো হয় যার নাম এক মিনিটের মাদরাসা। তাতে প্রথমে গুনাহের পরিচিতি ও পরিণতির কথা বলা হয়। কারণ গুনাহের পরিণতি হলো ভয়ানক আজাব। এটা শুনে মানুষ গুনাহ ছেড়ে দেবে। চাই তার অন্তরে আল্লাহর মহব্বত থাক বা না থাক। বস্তুত ভয়ের কারণে মানুষ যখন গুনাহ ছেড়ে দেবে, তখন অটোমেটিক তার মাঝে আল্লাহর মহব্বত চলে আসবে। এ জন্যই আগে বলা হয়েছে গুনাহ ছাড়তে। গুনাহ ছাড়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হলো আল্লাহকে ভয় করা।
লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ