সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০০:০০ টা

এত দিন কোথায় ছিলেন বনলতা সেন!

গোলাম মাওলা রনি

এত দিন কোথায় ছিলেন বনলতা সেন!

একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে। আমার কল্পনার চেয়েও দ্রুতগতিতে অনেক কিছু হচ্ছে। কোনটি ঘটনা আর কোনটি দুর্ঘটনা তা বুঝে ওঠার আগেই ঝড়ের গতিতে কীভাবে মানুষের জীবন তছনছ হয়ে যাচ্ছে তার প্রথম উদাহরণটি দিই। গত শুক্রবার মসজিদে ছিলাম। জুমার নামাজ শেষে জনৈক যুবক এগিয়ে এলেন। পরিচয় দিলেন নজরুল ইনস্টিটিউটের একজন কর্মকর্তা রূপে। প্রথমে নিজের দুঃখের কথা বললেন- তারপর আমার সাহায্য চাইলেন। ভদ্রলোকের কথা শুনে আমি ততটা বিব্রত ও অসহায়বোধ করলাম, যা আমার জীবনে কোনো দিন ঘটেনি। তিনি জানালেন, সম্প্রতি তিনি নীলক্ষেত বই মার্কেটে গিয়েছিলেন কিছু বই কিনতে। ১০-১২ জন যুবক তাকে টেনেহিঁচড়ে একটি টেইলারিং শপের মধ্যে ঢুকিয়ে তার পরিচয় জানতে চায়। আমার জীবনে কোনো দিন ঘটেনি।

ঘটনার আকস্মিকতায় ভদ্রলোক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে যায়। তিনি নিজেকে একজন সরকারি কর্মচারী বলে পরিচয় দেন এবং মাসে ৩৫ হাজার টাকা বেতন পান বলে জানান। আক্রমণকারীরা ভদ্রলোকের হাতের মোবাইলটি ছিনিয়ে নিয়ে- তা তল্লাশি করে ভদ্রলোকের সঙ্গে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র তাপসের একটি সেলফি দেখতে পায়। ভদ্রলোক যতই বলেন, তার সঙ্গে সাবেক মেয়রের কোনো পরিচয় বা সম্পর্ক নেই। মেয়র হিসেবে তিনি একবার নজরুল ইনস্টিটিউটে গিয়েছিলেন- আর তখন আরও অনেকের মতো তিনিও তাপসের সঙ্গে একখানা সেলফি তুলেছিলেন। আক্রমণকারীরা ভদ্রলোকের কথায় তেলেবেগুনে ক্ষেপে যায় এবং অভিযোগ করতে থাকে যে, তুমি আওয়ামী লীগ কর- কোটি কোটি টাকা কামিয়েছ। সুতরাং ১ কোটি টাকা না দিলে তোমার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করব- আর তোমাকে এখন থানায় নিয়ে যাব।

আমি যার কথা বলছি- তিনি ৪০ বছরের তরতাজা যুবক। সম্ভবত জামায়াতের মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং তাবলিগ জামাতের দাওয়াতি কর্মের সঙ্গে জড়িত। ফলে ঢাকা শহরের অনেককেই তিনি চেনেন বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে আক্রমণকারীদের সঙ্গে বাতচিৎ শুরুর চেষ্টা করা মাত্র চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুসির শিকার হয়ে শিশুর মতো কান্না শুরু করেন। আক্রমণকারীদের দাবি ১ কোটি থেকে লাখ টাকায় নেমে আসে। তিনি বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে বিকাশের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করে সেদিন রক্ষা পান। এখন দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কীভাবে প্রতিকার পাওয়া যায় তার বিহিত করার জন্য।

ভদ্রলোক দীর্ঘদিন ধানমন্ডির ৭ নম্বর সড়কের বায়তুল আমান মসজিদে নামাজ পড়েন এবং সেই সুবাদে আমাকে চেনেন। আমার সামাজিক পরিচিতির কারণে তার মনে হয়েছে, আমি হয়তো তাকে সাহায্য করতে পারব। কিন্তু আমি যখন নিজের অপারগতার কথা বললাম, তখন তিনি সকরুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন, যা তীরের ফলার মতো আমার হৃদয়ে বিষাদের বারুদ ছড়িয়ে দিল।

উল্লিখিত ঘটনার মতো হাজারো বিশৃঙ্খলা-চাঁদাবাজি-দখলদারত্ব ও অরাজকতার যে খবর মানুষের মুখে মুখে ফিরছে তা সাধারণ মানুষের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের দুর্নীতি ও দুঃশাসন কিংবা ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের মধ্যেও যেসব কথা শোনা যায়নি তা এখন ভয়ংকর রূপে মানুষকে তাড়া করে ফিরছে। দেশের শীর্ষ শিল্পপতি থেকে শুরু করে অজপাড়াগাঁয়ের দরিদ্র কৃষকের মনে একই আতঙ্ক বিরাজ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া এক ব্যক্তির গ্রামে একটি এতিমখানা ছিল, দুর্বৃত্তরা হামলা করে এতিমদের জন্য ফ্রিজে যে কোরবানির মাংস ছিল তা নিয়ে গেছে- এতিমদের তাড়িয়ে দিয়েছে এবং সেখান থেকে পাঁচটি গরু এবং পুকুরের সব মাছ নিয়ে গেছে। বিএনপির এক শীর্ষ নেত্রী মাগুরা জেলার একটি সংখ্যালঘু পরিবারের করুণ কাহিনি জানালেন। দুর্বৃত্তরা একটি খামার থেকে কেবল ৫৯টি গরু ছিনিয়ে নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, পুরো পরিবারটিকে এলাকাছাড়া করেছে। তারা স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্পে গিয়ে দরখাস্ত করেও কোনো বিহিত করতে না পেরে মাগুরা ছেড়ে সাভার এলাকায় এসে পালিয়ে রয়েছেন। পরিবারটিকে এলাকাছাড়া করার জন্য স্থানীয় সব রাজনৈতিক দলের টাউট-বাটপাররা একত্রে কাজ করেছে।

উল্লিখিত ঘটনার মতো আরও কিছু কাহিনি বলব। কিন্তু তার আগে শিরোনাম নিয়ে কিছু বলা আবশ্যক। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগের অবৈধ বাণিজ্য- মাঠ-ঘাট ইত্যাদি দখল করার জন্য শকুনের মতো ওরা ওত পেতে অপেক্ষা করছিল। মৃত প্রাণীর মাংস ভক্ষণ করার জন্য শকুন যেভাবে অপেক্ষা করে, ঠিক একইভাবে আমাদের দেশের গত পনেরো বছরের মতো অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার মতো দুর্বৃত্তপনা-চাঁদাবাজি দখল-সন্ত্রাসী ইত্যাদির দখল নেওয়ার জন্য বিশাল একটি গোষ্ঠী ওত পেতে ছিল। তাদের হাল আমলের তান্ডবের ধরন দেখে নাটোরের বনলতা সেনের মতো অনেকেই প্রশ্ন করেছেন- এত দিন কোথায় ছিলেন? আপনারা যারা বনলতা সেন নামক সেই বিখ্যাত কবিতাটি পড়েছেন- তারা নিশ্চয়ই কবির সেই অমর বাণী স্মরণ করতে পারছেন, যেখানে কবি বর্ণনা করেছেন- ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূরে সমুদ্রের পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারিয়েছে দিশা, সবুজ ঘাসের দেশ যখন যে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর, তেমনি দেখেছে তারে অন্ধকারে-; বলেছে সে এত দিন কোথায় ছিলেন। পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।’

সাধারণ দৃষ্টিতে এটি একটি প্রেমের কবিতা। কল্পিত প্রেমিকার কালো চুলের মনোহর এবং তার মুখশ্রীর প্রেমে তান হারিয়ে পাগলের মতো যে প্রেমিক জীবনের চলার পথ হারিয়ে ফেলে এবং এক সময় ক্লান্ত-বিধ্বস্ত হয়ে যখন জীবনের হাল ছেড়ে দেয়- ঠিক তখন যদি জ্ঞান হারিয়ে স্বপ্নের মধ্যে সুন্দর ছিমছাম সবুজে ঘেরা দারুচিনির দ্বীপে অন্ধকার রজনির অস্পষ্টতায় কল্পনার সেই প্রেমিকা বনলতা সেনকে দেখতে পায় এবং যদি সেই প্রেমিকা তার প্রেম প্রত্যাশীকে জিজ্ঞাসা করে- এত দিন কোথায় ছিলেন তবে প্রেমিকের যে দশা তদ্রƒপ বর্তমানকালের দুর্বৃত্তরা একই বিপত্তিতে পড়েছে।

গত পনেরো বছর ধরে তারা বনলতা সেনরূপী চাঁদাবাজি, লুটপাট, টেন্ডারবাজি ইত্যাদিকে খুঁজেছে। তাদের সেই খোঁজাখুঁজি ছিল এমন- ‘হাজার বছর ধরে আমি হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে, অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে, সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে; আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারদিকে সমুদ্র সফেন, আমার দুদ- শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।’ জীবনানন্দ দাশের কথার সঙ্গে মিলিয়ে আপনি যদি ভাবেন বর্তমানে দুর্বৃত্তরা আওয়ামী দুবর্ৃৃত্তদের দাপটে যেভাবে গর্তে ঢুকেছিল তাতে করে গত পনেরো বছর তাদের কাছে কেয়ামতের ময়দানের হাজার বছরের মতো সুদীর্ঘ বলে মনে হয়েছে। তারা একটি গর্তকে মনে করেছে সিংহলের সমুদ্রের মতো ভয়াবহ। তারপর সেই গর্ত ছেড়ে যখন অন্য গর্তে ঢুকেছে তখন সেটিকে মনে হয়েছে মালয় সাগরের মতো।

হাল ফ্যাশনের দুর্বৃত্তরা সাগর ছেড়ে নগরের অন্ধকার গর্তে বাস করার চেষ্টা করেছে- কিন্তু প্রতিপক্ষ দুর্বৃত্তদের দাপটে ক্লান্ত হতে হতে যখন নগরের জীবনকে উত্তাল ও ভয়ংকর সমুদ্রের মতো মনে করেছে ঠিক সেই সময়ে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টকে তাদের কাছে জীবনানন্দ দাশের নাটোরের বনলতা সেনরূপে মনে হয়েছে এবং ক্ষুধার্ত ও বুভুক্ষের মতো হাজারো শহীদের রক্তের মাধ্যমে অর্জিত গণ অভ্যুত্থানের নতুন বাংলাদেশের ওপর শকুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

আমরা আজকের আলোচনার একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। এবারে আমার নিজের একান্ত কিছু অনুভূতির কথা শেয়ার করছি। বেক্সিমকোর কর্ণধার সালমান এফ রহমানের সঙ্গে আমার বিরোধিতার কথা দেশবাসী কমবেশি সবাই জানেন। সেই ২০০৯ সাল থেকে তার গ্রেপ্তারের দিন পর্যন্ত আমি তার নিষ্ঠুর সমালোচক ছিলাম। তাকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই বলেছি- এবং বহুবার লিখেছি। ২০১৪ সাল পর্যন্ত         আমি সংসদ সদস্য ছিলাম- আর ২০১৪ সালের পর থেকে সালমান সাহেব কেবল সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী মর্যাদার ব্যক্তি নন- তাকে মনে করা হতো শেখ হাসিনার পর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি।

জনাব সালমানের অফিস ভবন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগই ধানমন্ডি ১ নম্বর সড়কে অবস্থিত। আর আমি থাকি ১ নম্বর সড়কের ঠিক পেছনে- নায়েম রোডে। আমি প্রায়ই ব্যায়াম করার জন্য রাত ৮টা/৯টার দিকে সালমান সাহেবের অফিসের সামনে দিয়ে ধানমন্ডি লেকের পাড়ে যেতাম। তার অফিসের সামনে শত শত নেতা-কর্মী খোশগল্প করত। তাদের দেখলে আমার কোনো ভয় হতো না। উল্টো তারা হাসিমুখে সালাম বিনিময় করত। সালমান সাহেবের সিকিউরিটি গার্ডরা দারোয়ানরা জানতেন তাদের মালিকের সঙ্গে আমার বিরোধ। তারপরও তারা আগ বাড়িয়ে সালাম দিতেন। অনেকে হাসিমুখে এগিয়ে এসে কুশল বিনিময় করতেন। ওই পথ দিয়ে চলতে ফিরতে আমি কোনো দিন শঙ্কা অনুভব করিনি। কিন্তু ৫ আগস্টের গণ অভ্যুত্থানের পর বেক্সিমকোর অফিস-শোরুম পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে এখন এমন ভূতুড়ে পরিবেশ যে, দিনের বেলায় হাঁটতে গেলেও গা ছমছম করে।

এই মহানগরীতে আমার বসবাস প্রায় অর্ধশতাব্দীর। কোনো দিন আমার মনে ভয়-আতঙ্ক বাসা বাঁধেনি। কিন্তু ৩০ আগস্ট শুক্রবার ধানমন্ডির বায়তুল আমান মসজিদে বসে নজরুল ইনস্টিটিউটের সেই কর্মকর্তার কাহিনি শোনার পর আমার মনেও ভয় বাসা বেঁধেছে এবং আমি সেটা টের পেলাম একই দিন রাত ১১টা ৩০ মিনিটের সময় সোনরাগাঁও হোটেলের সামনে যে চৌরাস্তা রয়েছে সেখানে পৌঁছানোর পর। আরটিভির গাড়িতে করে আমি তাদের মধ্যরাতের টকশোতে অংশগ্রহণের জন্য যাচ্ছিলাম। হঠাৎ চারদিক থেকে বাস-ট্রাক-গাড়ি এমনভাবে আমাকে বহনকারী গাড়িকে ঘিরে ফেলল তাতে মনে হলো- এই বুঝি ট্রাকচাপায় প্রাণ হারাই।

আমি অসহায়ের মতো চারদিকে তাকালাম- রাস্তায় একজন পুলিশও নেই। যেভাবে গাড়ির জট লেগেছে তা ছাড়তে কয় ঘণ্টা লাগবে তা বুঝতে পারছিলাম না। অন্যদিকে অনুষ্ঠানের প্রযোজক বারবার ফোন দিয়ে অনুরোধ করতে থাকলেন একটু হেঁটে গিয়ে অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য। আমি গাড়ি থেকে নামলাম- এই প্রথম অনুভব করলাম বহু বছরের পরিচিত স্থানটি আমার কাছে অচেনা লাগছে। রাত ১টা দেড়টার সময় একুশে টিভি, এনটিভি, আরটিভির অনুষ্ঠান শেষে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খেয়েছি- কোনো ভয় ছিল না। কিন্তু সে রাতে কীসের আতঙ্ক আমায় তাড়া করল- আমার মনে হতে থাকল আমি যদি বিপদে পড়ি তবে কোনো পুলিশ এগিয়ে আসবে না। কোনো থানার দরজা আমার জন্য এত রাতে খুলবে না- কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আমার জন্য ছুটে আসবে না। আমার এই অনুভূতির নেপথ্যে সারা বাংলার চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসীসহ অসংখ্য অরাজকতার সে বীভৎস চিত্রসমূহনিয়ামক হিসেবে কাজ করছে, তা নিরসনকল্পে অন্তর্বর্তী সরকার কী ব্যবস্থা নেয়, সেই প্রত্যাশায় আসমানের দিকে তাকিয়ে আছি।

 

                লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর