সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০০:০০ টা

অন্তর্বর্তী সরকারকে বিতর্কিত করা যাবে না

মেজর জিল্লুর রহমান (অব.)

অন্তর্বর্তী সরকারকে বিতর্কিত করা যাবে না

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গণমানুষের মনে আকাশচুম্বী নতুন আশার সঞ্চার করেছে। এ ঐতিহাসিক আন্দোলনের ফসল মানুষের জীবনে কীভাবে প্রতিফলিত হতে পারে তা বাস্তবায়নের পবিত্র দায়িত্ব এই সরকারের। বুড়া রাজনৈতিক দলের পুরনো ধাঁচের রাজনীতি স্বজনপ্রীতি, রাষ্ট্র্রীয় সব অঙ্গ দলীয়করণ, দলপ্রীতি, দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার, চাঁদাবাজি, দখল দেখে মানুষ বিরক্ত।  মানুষ তরুণদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে দুর্নীতিবাজ স্বৈরাচার হটাতে ঘর থেকে রাস্তায় নেমে পড়ে। তরুণ প্রজন্মকে মেনে নিয়েছে সৎ নেতৃত্বের আঁতুড়ঘর হিসেবে।

তরুণরাই এখন আমাদের পথ দেখাচ্ছে, তারাই দেশ চালাবে। তাদের কাছে নিরাপদ দেশ রেখে যাব আমরা। তারুণ্যের শক্তির সামনে সব ষড়যন্ত্র, সব দুর্নীতি উড়ে যাবে- এমন আশায় বুক বেঁধে আছে দেশ। আঁতুড় সরকার বসে পারল না তাদের বিতর্কিত করার ষড়যন্ত্র থেমে নেই। দেশি-বিদেশি ঘুঁটি চালাচালি তো আছেই, দাবিদাওয়ার প্লাবন বইতে শুরু করেছে। আকস্মিক বন্যায় দেশ এক মানবিক বিপর্যয়ে পড়েছে। দেশের মানুষ প্রাণপণ লড়াই চালাচ্ছে বন্যাকবলিত মানুষকে উদ্ধার করতে। তাদের দুয়ারে ছুটে যাচ্ছে ত্রাণসহায়তা দিতে। ঠিক তখনই আনসার নামক অপদার্থরা সচিবালয় ঘেরাও করে ছাত্র-জনতার রোষে পড়ে। রবিবার সন্ধ্যায় ছাত্র-জনতা তাদের ধাওয়া দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে সচিবালয় এলাকার জঞ্জাল পরিষ্কার করে। এখন কি আন্দোলনের সময়, দাবি আদায়ের দরকষাকষির সময়? এরা আর যাই হোক দেশপ্রেমিক হতে পারে না। আনসারদের থাকার কথা বন্যাকবলিত এলাকায়, তা না করে তারা কার উসকানিতে আন্দোলনে নেমে জনগণের প্রতিপক্ষ বনে গেল। ছাত্র-জনতা প্রতিরোধ শুরু করলে গায়ের ইউনিফরম খুলে জীবন বাঁচিয়ে দৌড়ে পালিয়েছে। ব্যাংকারদের এমন এক জংলি আন্দোলন দমন করেছিলেন প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তার। চূড়ান্ত নোটিস দেওয়ার পর ছাঁটাই করা হয়। দেখা গেছে, অর্বাচীন নেতারা বুভুক্ষ অবস্থায় দিন কাটিয়েছে। মানুষের কাছে ভিক্ষা চাইতে গেলেও করুণা পায়নি। অযৌক্তিক কোনো দাবি, কোনো আবদার মেনে নেওয়া মানে খারাপ কাজে উৎসাহিত করা। মানুষের সমর্থন আছে সরকারের প্রতি, নৈরাজ্যবাদীদের কোনো করুণা কোনোভাবে আর দেখানো যাবে না। যদু-মধু বসে থাকবে না, সবাই দাবির প্লাবনে গা ভাসাবে। আরও কত কুচক্রী গোষ্ঠী ঘাপটি মেরে ওত পেতে বসে আছে।

আনসারদের এমন ঘৃণিত কর্মকান্ডের মধ্যে অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য বিশ্ববাসী দেখল। বিপদে বাঙালি জাতি এক হয়ে লড়ে। বন্যা মোকাবিলায় দুঃসাহসী জাতি হিম্মত হারায়নি। সরকার কী করল তার জন্য কেউ বসে নেই। যার যা আছে তাই নিয়ে ছুটে চলেছেন টিএসসির দিকে। তারা দেখাল দেশের মালিক দেশের জনগণ। তারা বানভাসি মানুষদের বাঁচাতে সাধ্যের বাইরেও চেষ্টা চালাচ্ছে।

বৃদ্ধ মহিলা ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী মানুষ হাত দিয়ে তার টাকা বাক্সে ঢুকাতে হাত কাঁপছে, তাতে কী? অন্তর জ্বলছে তার পানিবন্দি মানুষের অসহায়ত্ব জেনে। যেভাবেই হোক মহৎ কাজে শরিক তাকে থাকতেই হবে। ভ্যানচালক মুখে শুভ্র শ্মশ্রু ইউসুফ রোজগার করেছে ৫০০ টাকা; ঘরভাড়া দেওয়ার জন্য গাঁটে গুঁজে রেখেছিল। সেই ৫০০ টাকা দিয়ে বলল, ‘আমার কলিজাটা কাইটে যদি তোমাদের হাতে দিয়ে যেতে পারতাম ওদের দেওয়ার জন্য, বড্ড শান্তি পাইতাম।’ কেঁদে কেঁদে গলায় ঝোলানো গামছার এক প্রান্ত দিয়ে নয়ন মুছতে মুছতে সহমর্মিতার গভীর ব্যথার স্বরে বলল, আমি তো ভালো আছি! ওদের সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। তোমাদের চেষ্টা কাম কষ্ট দেখে ছুটে এসেছি। জন্ম-জন্মান্তরের জীবন-মরণের অটুট বন্ধন রাজনৈতিক কারণে চেতনার জিকির করে জাতিকে বিভাজিত করার অপচেষ্টা চালিয়েছে শেখ হাসিনা। আজ সে বিভাজন উড়ে গেছে ভালোবাসার ঝোড়ো হাওয়ায়। এক তরুণ উদ্ধারকাজে লিপ্ত অবস্থায় চট্টগ্রামে দুঃসাহসী মন্তব্য করেছে। যতক্ষণ বেঁচে থাকব রেসকিউ চালাতে থাকব। নিম্নআয়ের এক বোনের টাকা নাই, সম্বল ছিল একজোড়া কানের দুল, তাই দিয়ে গেল টিএসসির ত্রাণ তহবিলে। কিছু করতে পারার আনন্দে কিশোর-কিশোরীদের মাটির ব্যাংক জমা করছে। তৃতীয় লিঙ্গের দেশপ্রেমীরা পেছনে হাত গুটিয়ে রইল না। তারা মোটা অঙ্কের টাকা দিল, বলল, আমাদের টাকা জনগণের। আমাদের সন্তান নেই, এই টাকা জনগণের কল্যাণে খুশিতে দিয়ে গেলাম। পা নাই, খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে দান করলেন, এ এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য। গায়ের লোম কাঁটা দেওয়ার আবেগি মুহূর্ত। মনে হচ্ছে আজ প্রথম মানুষ প্রাণভরে স্বাধীনতার স্বাদ পাচ্ছে, আজ তারা দেশের মালিক। নিজের মালিকানার দায়িত্বে অবহেলা কেউ করছে না। আনন্দ চিত্তে ভিড় করছে টিএসসিতে অর্থ, ত্রাণসামগ্রী জমা দিতে। টিএসসিতে জায়গার সংকুলান হচ্ছে না। ব্যায়ামাগার খুলে দিতে হয়েছে ত্রাণসামগ্রী মজুত করতে। পৃথিবী ঘুমায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো দিন ঘুমায় না। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী সবাই জাতির অতন্দ্র প্রহরী। ক্যাম্পাসে আলো জ্বলছে, বিরামহীন ত্রাণের কাজ চলছে। দেশপ্রেমী মানুষের ঢল রাতভর যতদূর চোখ যায় সারিবদ্ধ ত্রাণের গাড়ি আর গাড়ি। নিজে দেখে আসুন চোখ দুটি সার্থক করুন। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তের সেই কথা মনে জেগে উঠবে, ‘ভগবান দুটি নয়ন দিছিলে আজ তাদের সার্থক করলে’। সেখানে জাহাজ একবার ভাসছে, একবার ডুবছে। আমাদের টিএসসিতে ত্রাণ শুধু আসছে আর আসছে। স্বপ্নের বাংলাদেশ এই বাংলাদেশ জাতি চেয়েছিল। শিশুরা এসেছে, পঙ্গুরা এসেছে। অভাবনীয় দৃশ্য শিহরণ জাগানো দৃশ্য ইস্পাত কঠিন এক ঐক্য মহাযুদ্ধের প্রস্তুতি। ত্রাণের বাস পথিমধ্যে বিকল হয়ে পড়ে আছে। খবর পেয়ে ইউনিভার্সিটির ট্রেজারার আরেকটি বাস কালবিলম্ব না করে পাঠিয়ে দিলেন। কোথায় সরকার, কোথায় ধনী দেশের ত্রাণ সাহায্য! সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সবার চাউনিতে দৃঢ়সংকল্প আমাদের যা আছে, তাই দিয়ে এ লড়াইতে জয়ী হতে হবে। আমাদের আছে একতা, সাহস, দেশপ্রেম; আমাদের আছে তারুণ্যের মহামূল্য হীরার খনি। আমরাই সমৃদ্ধ। কত দিন পর মানুষ তৃপ্তিতে তার দেশকে ভালোবাসতে পারছে। কত দিন পর মালিকানা ফিরে পেয়ে নিঃস্ব হয়েও সম্মানিত মনে হচ্ছে বুকের পাঁজরের মধ্যে। সব শ্রেণি-পেশা, জাতি-ধর্ম-বর্ণ এক হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের জাতিকে বিভাজনের টানা রেখা বিলপ্ত হয়ে গেছে। প্রবাসী ভাই তার মৃত মায়ের জমানো ব্যাংকের টাকা নিয়ে হাজির। হজের টাকা, ওমরাহর টাকা, পূজার টাকা, মসজিদের টাকা, মন্দিরের টাকা, গির্জার টাকা- সব বন্যায় পানিবন্দি মানুষের খেদমতে দান করেছে। এমন অসম্প্রদায় অমোচনীয় অটুট সামাজিক বন্ধন, হৃদয় নিংড়ানো দরদ, নিজ পরিবারকে বুভুক্ষ রেখে অনাহারির মুখে খাবার তুলে দেওয়ার দেশ আমার দেশ, আমি তোমায় প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসি।

অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে ক্রমাগত হত্যা মামলা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে আসামির সংখ্যাও বাড়ছে। জানা যায়, অভিযোগ লিখে নিয়ে থানায় গেলেই মামলা নিচ্ছে। অথবা আদালত নির্দেশ দিচ্ছেন মামলা রুজু করতে। অপরাধী আইনের আওতায় আসুক সবাই জোরালো দাবি করে। পুলিশ বড্ড বেশি বন্ধু হয়ে গেছে জনগণের। তাই যাচাইবাছাই তদন্ত ছাড়া পরিণতি না ভেবে মামলা রুজু করে দায়সারা দায়িত্ব পালন করছে।

আওয়ামী লীগ নেতা নাছিম লোকচক্ষুর অন্তরালে বসে বিবৃতি বাজাচ্ছেন। তার বয়ান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও পাঁচবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে হত্যা মামলা হওয়ায় তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কী দলকানা নেতা। শেখ হাসিনা যখন নিরীহ হাজার হাজার মানুষ খুন করেছে কয়েক দশক ধরে, নিজ দেশের মানুষকে করেছিল পরবাসী সেদিন আপনাদের উদ্বেগ কোথায় ছিল। আওয়ামী চশমা খুলে দেশের চশমা চোখে দেন। কে কবে পাঁচবারের প্রধানমন্ত্রী ছিল আদালতে ডিম নিক্ষেপ, জুতা মারধর কোনোভাবে সভ্যতা না। দেশের সরকারের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। হুজুগে মানুষ তারা পরিণতি না ভেবে মনের ঝাল মিটিয়ে যাচ্ছে। মাঝখানে সরকারকে ফেলে যাচ্ছে কৈফিয়ত দিতে। শেখ হাসিনা কাদের প্রতিহতের চেষ্টা করে সংঘাত বাধিয়েছে, খুনোখুনি অভিযান চালিয়েছে। তাই তাদের আগে আসামি করা যুক্তি। এ তো কোনো শুভ লক্ষণ না। জেলায় জেলায় মামলা হচ্ছে। আসামি বিদেশ থাকে, তাকে মামলায় হয়রানি করলে সেই কুলষিত রাজনীতি চর্চার আলামত ভেসে ওঠে চোখে।

অনেকের রাগ ও ক্ষোভ থাকতে পারে। কিন্তু এ ধরনের মামলা লিখলে কাজ হবে না, টিকবে না। প্রথম ধাপই পার হতে পারবে না। মামলাগুলো আন্দোলন ও আন্দোলনের ফসলকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

যেখানে অভিজ্ঞতা অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। যখন সামনে অনেক সুযোগের হাতছানি থাকে, তখন ভুল করার আশঙ্কাও থাকে- তরুণদের এটি মনে রাখতে হবে।  একটি বিপ্লব ঘটিয়ে যারা সফল হলেন, সুন্দর আগামীর জন্য সুযোগ্য নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করতে চাইলে তাদের এখন আরও বেশি পড়াশোনা ও জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন। প্রতিটি কাজে ও কথায় পরিশীলিত, সুসংগঠিত, শৃঙ্খলিত ও দায়িত্বশীল হতে হবে। এই উত্তাল সময়ে লক্ষ্য রাখতে হবে, তারুণ্য যেন কোনোভাবেই পথ না-হারায়। এখন তরুণদের দিকেই তাকিয়ে আছে গোটা দেশ।

 

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক

[email protected]

সর্বশেষ খবর