মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০০:০০ টা

অমুসলিমদের নিরাপত্তায় ইসলামের নির্দেশনা

মুফতি হেলাল উদ্দিন হাবিবী

অমুসলিমদের নিরাপত্তায় ইসলামের নির্দেশনা

মহান আল্লাহর বিধান মতে, ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় অমুসলিম সংখ্যালঘুদের সামাজিক অধিকার মুসলমানদের মতোই। সমাজে তাদের প্রতি বৈষম্যের কোনো সুযোগ নেই। ইসলাম প্রত্যেক ধর্মালম্বীর নিজ নিজ ধর্ম পালনের অবাধ স্বাধীনতা প্রদান করেছে। ধর্ম গ্রহণে কাউকে জোর-জবরদস্তি করা ইসলাম সমর্থন করে না। অমুসলিম বলে তাদের সম্মানহানি করা, জানমালের ক্ষতিসাধন বা তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা করা গুরুতর অপরাধ এবং এর পরিণতি জাহান্নাম। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, দীন গ্রহণের ব্যাপারে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই। সত্য পথ ভ্রান্ত পথ হতে সুস্পষ্ট হয়েছে। যে অত্যাচারী শক্তিকে অস্বীকার করবে এবং আল্লাহর প্রতি ইমান আনবে, সে এমন মজবুত হাতল ধরল, যা কখনো ভাঙবে না। আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও প্রজ্ঞাময়। (সুরা বাকারা, আয়াত ২৫৬)

আল্লাহতায়ালা আরও ইরশাদ করেন, যারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের তোমাদের ঘরবাড়ি থেকে বহিষ্কার করেনি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদের ভালোবাসেন। (সুরা মুমতাহিনাহ, আয়াত ০৮)। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেছেন, সাবধান! যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম নাগরিক বা সংখ্যালঘুকে অত্যাচার করবে, তাদের অধিকার খর্ব করবে, তাদের ওপর সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ চাপিয়ে দেবে কিংবা জোরপূর্বক তাদের সম্পদ আত্মসাৎ করবে, কেয়ামতের দিন আমি তার বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ দায়ের করব। (আবু দাউদ)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করবে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ ৪০ বছরের দূরত্ব থেকে জান্নাতের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। (বুখারি)

হজরত নবী করিম (সা.) অমুসলিমদের সঙ্গে মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। যার কপি আজও তুরস্কের ইস্তাম্বুলের তুপকপি নামক জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। চুক্তির মূল বিষয়বস্তু ছিল এরূপ : ১. অমুসলিমরা শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে মুসলমানরা সর্বশক্তি দিয়ে তাদের রক্ষা করবে। ২. তাদের সব প্রকার নিরাপত্তা প্রদান করা হবে। ৩. ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হবে না। ৪. তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সম্পত্তি ও ধর্মীয় উপাসনালয়ের কোনো ক্ষতি করা হবে না। ৫. তাদের কোনো অধিকার খর্ব করা হবে না। ৬. তাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী প্রেরণ করা হবে না। ৭. ধর্মীয় ও বিচারব্যবস্থায় তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকবে। খলিফাতুল মুসলিমিন হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায় বসবাসরত খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মাঝে হইচই পড়ে যায় যে, কে বা কারা যিশুখ্রিস্টের পাথরের মূর্তির নাক ভেঙে ফেলেছে। তাদের ধারণা, এ কাজ মুসলমানদের মধ্যে কেউ করেছে। খ্রিস্টানদের একটি প্রতিনিধি দল মিসরের গভর্নর বিখ্যাত সাহাবি হজরত আমর ইবনুল আস (রা.)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে এর বিচার চাইলেন। হজরত আমর ইবনুল আস (রা.) বিষয়টি শুনে অত্যন্ত ব্যথিত হলেন এবং ক্ষতিপূরণ স্বরূপ নতুন আরেকটি মূর্তি তৈরি করে দিতে চাইলেন। কিন্তু খ্রিস্টান প্রতিনিধি দল তাতে সম্মত হলো না। তারা এর প্রতিশোধস্বরূপ দাবি করল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মূর্তি বানিয়ে তার নাক ভেঙে দেওয়া হোক। সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের এ ধরনের দাবি শ্রবণ করা সত্ত্বেও গভর্নর হজরত আমর ইবনুল আস (রা.) ক্ষিপ্ত বা উত্তেজিত হননি। বরং বিনয়ের সঙ্গে তাদের বললেন, আপনারা এটা বাদ দিয়ে বিকল্প কোনো প্রস্তাব করুন। আপনারা চাইলে আমাদের যে কোনো একজনের নাক কেটে আপনাদের হাতে তুলে দিতে প্রস্তুত। খ্রিস্টান প্রতিনিধি দল এ প্রস্তাবে সম্মত হলো। পরদিন খ্রিস্টান ও মুসলমান সবাই সমবেত হলো। মিসরের গভর্নর হজরত আমর ইবনুল আস (রা.) সমবেত জনতার উদ্দেশে বললেন, আপনাদের যিশুখ্রিস্টের নাক কর্তনের ঘটনার মাধ্যমে আমার শাসনের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। তাই আপনারা আমার নাক কেটে নিন। এই বলে তরবারি সামনে এগিয়ে দিলেন এবং নাক পেতে দিলেন। সমবেত জনতা অভিভূত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। খ্রিস্টান প্রতিনিধি দল হতবাক। অপর এক সাহাবি দৌড়ে এসে বললেন, আমিই দোষী গভর্নর কোনো অপরাধ করেননি। এই বলে তার নাক এগিয়ে দিলেন। বিস্ময়কর এই দৃশ্য দেখে খ্রিস্টান প্রতিনিধি হাতের তরবারি ফেলে বলে উঠলেন, ধন্য হে গভর্নর! ধন্য আপনাদের নবী মুহাম্মদ (সা.)। যার ছোঁয়ায় আপনারা এত উদার, নির্ভীক ও আদর্শবান। সংখ্যালঘুদের অভিযোগের প্রতি মুসলিম শাসকের এ ধরনের সম্মানবোধ ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে কাল থেকে কালান্তর। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশে হাজার বছর থেকে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ মিলেমিশে বসবাস করার সুদীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে; যা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের। যারা সংখ্যালঘু অমুসলিমদের ধর্মীয় উপাসনালয়ে আক্রমণ করে বা বিনা কারণে তাদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর জ্বালালাও-পোড়াও করে, তারা ইসলাম, দেশ ও মানবতার দুশমন।  প্রকৃত মুসলমান কখনো অন্য ধর্মের উপাসনালয়ে আঘাত করতে পারে না। কেননা ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায়  সব ধর্মের নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান ও সম্প্রীতি-সহাবস্থান নিশ্চিত করা ইসলামের মৌলিক দীক্ষা ও মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুপম আদর্শ।

লেখক : খতিব, মাসজিদুল  কোরআন জামে মসজিদ, কাজলা (ভাঙ্গাপ্রেস), যাত্রাবাড়ী, ঢাকা

সর্বশেষ খবর