বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০০:০০ টা

মাদকাসক্তি রুখতে বলে ইসলাম

আবদুর রশিদ

দেশের শান্তিশৃঙ্খলার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মাদকাসক্তি। কারণ মাদকের অর্থ জোগাড় করতে মাদকাসক্তরা ছিনতাই-রাহাজানি, চুরি-ডাকাতিসহ যে কোনো অপরাধে সহজেই জড়িত হয় নারীর সম্ভ্রমের জন্য তারা প্রত্যক্ষ হুমকি বলে বিবেচিত হয়। মাদকাসক্তির ইতি ঘটাতে পারলে স্বভাবতই আইনশৃঙ্খলায় হ্রাস টানা সম্ভব হবে। হ্রাস পাবে সড়ক দুর্ঘটনা। নিশ্চিত হবে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গোটা পৃথিবীতে রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন। পবিত্র কোরআনের ঘোষণা, ‘আর আমি আপনাকে পৃথিবীর রহমতরূপে পাঠিয়েছি।’ যখন তিনি এ পৃথিবীতে আসেন, তখন পৃথিবীর সর্বত্র ছিল জুলুম, নির্যাতন, স্বার্থপরতা, বিদ্বেষ, হানাহানি, কুপ্রথা ও অশ্লীলতায় ভরপুর। মানুষ আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে সর্বত্র অবাধে চলত মদ্যপান ও অশ্লীল বেহায়াপনা।

মানুষ হলো সৃষ্টির সেরা জীব ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। মানুষের জন্য যা কিছু কল্যাণকর পবিত্র ও উপকারী তা মহান আল্লাহ হালাল করেছেন, পক্ষান্তরে যা কিছু ক্ষতিকর ও অকল্যাণকর তা হারাম করেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করা হয়েছে- ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু আহার কর, যা আমি তোমাদের জীবিকা হিসেবে দান করেছি এবং আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, যদি তোমরা তারই বন্দেগি করে থাক।’ (সুরা বাকারা-১৭২)

যেসব বস্তু বা পানীয় সুস্থ ও স্বচ্ছ বিবেক অবলুপ্ত করে তা মাদক হিসেবে অবহিত। মাদক শব্দটি এসেছে মূলত মদ শব্দ থেকে। রসুল (সা.) বলেন, সব নেশাকারী বস্তুই মদ বা মাদক আর সব নেশাকারী বস্তুই হারাম। মদ, তাড়ি, আফিম, গাঁজা, চরস, হাশিশ ইত্যাদি প্রাকৃতিক মাদকদ্রব্য এবং হেরোইন, মরফিন, কোকেন, প্যাথেড্রিন, ফেনসিডিল ইত্যাদি রাসায়নিক মাদক দ্রব্যের মধ্যে কোনো গুণগত পার্থক্য নেই। পরিমাণে কম আর বেশি হোক পান বা আহার বা অন্য কোনোভাবে মাদক গ্রহণ হারাম। ইসলামের শরিয়তে মদ্যপান সম্পূর্ণ হারাম। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার দেবী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন কর যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্র“তা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদের আল্লাহর স্মরণে ও সালাতে বাধা দিতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না। সুরা মায়িদা (৯০-৯১) রসুল (সা.) ইরশাদ করেন- ‘তোমরা মদ পান কর না, কেননা মদ সব অনিষ্টের চাবিকাঠি।’ (ইবনে মাজাহ)। আরও ইরশাদ করেন, ‘কোনো ব্যক্তি ইমানদার অবস্থায় মদ পান করে না।’ (মুসনাদে আহমাদ)। ‘মদ্যপায়ী ব্যক্তি মৃত্যুর পর জান্নাতে যাবে না।’ (ইবনে বিববান)।

মাদকের অসংখ্য অপকারিতা রয়েছে। মাদক আল্লাহর জিকির থেকে গাফিল ও নামাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। চিন্তা ও বিবেকের বিকৃতি সাধন এবং পরস্পরের মধ্যে হিংসা ও শত্র“তার জন্ম দেয়। এ ছাড়া আখেরাতের কঠিন ও ভয়াবহ শাস্তি তো রয়েছেই। মাদক সেবনকারী জেনা এবং কঠিন গুনাহতে লিপ্ত থাকে। আল্লাহ রহমত ও নেক দৃষ্টি থেকে মাদকাসক্তরা সদা বঞ্চিত। হজরত আনাস (রা.) রসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, রসুলুল্লাহ মদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে এমন ১০ শ্রেণির ব্যক্তিকে লানত করেছেন। ১. যেই লোক নির্যাস বের করে ২. প্রস্তুতকারক ৩. পানকারী ৪. যে পান করায় ৫. আমদানিকারক ৬. যার জন্য আমদানি করা হয় ৭. বিক্রেতা ৮. ক্রেতা ৯. সরবরাহকারী ও ১০. এর লভ্যাংশ ভোগকারী। (তিরমিজি)।

মাদকদ্রব্য গ্রহণে ফুসফুস ও মস্তিষ্কের অপূরণীয় ক্ষতি হয়, হৃৎস্পন্দন ও নাড়ির গতি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়, চোখ লালবর্ণ হয়, মুখ ও গলা শুকিয়ে আসে। মাদকে হজমশক্তি হ্রাস পায়, খাদ্যস্পৃহা কমে যায়, ফলে মানবদেহে ক্রমাগত অপুষ্টি বাসা বাঁধে। মাদকাসক্তি ব্যক্তিকে নেশার দাস বানিয়ে ফেলে। মানুষ নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায়। মাদকের ব্যয় সংকুলানের জন্য মাদকাসক্ত ব্যক্তি নানারকম দুর্নীতির আশ্রয় নেয় এবং অসামাজিক ও অপরাধমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ফলে অস্থির ও বেপরোয়া হয়ে ওঠে আর ব্যভিচার ও নরহত্যার মতো অপরাধে জড়িত হয়। বাস, ট্রাক ও ট্যাক্সি প্রভৃতি যানবাহনে মাদকাসক্ত চালকের কারণে বেশির ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা হয়ে থাকে। এ জন্য রসুলুল্লাহ (সা.) কঠোর ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘মাদকদ্রব্য সব অপকর্ম ও অশ্লীলতার মূল’। মাদকাসক্তি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন একটি চরম অপরাধ, তেমনি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও এটি একটি জঘন্য পাপাচার। তাই সমাজে এহেন ঘৃণ্য মাদকদ্রব্যের ব্যবহার ও প্রসার রোধ করা খুবই দরকার।

পবিত্র কোরআন ও হাদিসের অনুশাসন মেনে চললে এবং ইসলামের আলোকে জীবন পরিচালনার মাধ্যমে সমাজ থেকে মাদকদ্রব্য নির্মূল করা সম্ভব। মাদকাসক্তি রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপর হতে হবে। পাশাপাশি সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে।  বিশেষ করে মসজিদের খতিব এবং ইমামরা যদি জুমার খুতবায় মাদকের বিরুদ্ধে ইসলামী অনুশাসনগুলো তুলে ধরেন তবে তা জনসচেতনতা সৃষ্টিতে অবদান রাখবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে মাদক থেকে দূরে থাকার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক

সর্বশেষ খবর