শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০০:০০ টা

অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থন ও সমালোচনা

মাহমুদুর রহমান মান্না

অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থন ও সমালোচনা

গত ১৬ সেপ্টেম্বর দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোর প্রায় সবকটিতে প্রকাশিত একটি খবরের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। খবরে বলা হয়েছে- ‘দেশ ঠিক পথে যাচ্ছে বলে মনে করেন দেশের ৭১ শতাংশ মানুষ। আর ৮১ শতাংশ মানুষ চান সংস্কার কার্যক্রম শেষ করতে যতদিন প্রয়োজন ততদিন ক্ষমতায় থাকুক অন্তর্বর্তী সরকার।’ ‘পালস সার্ভে ২০২৪ : জনগণের মতামত, অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক এক জনমত জরিপে এ চিত্র উঠে এসেছে। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) জরিপটি পরিচালনা করে। ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোজাফফর আহমদ চৌধুরী মিলনায়তনে এ জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে ‘অভ্যুত্থানের ৪০ দিন : মানুষ কী ভাবছে’ শিরোনামে আলোচনা সভারও আয়োজন করা হয়।

আমি গবেষক নই। কিন্তু বুঝি, গবেষণা ছাড়া জ্ঞান কখনোই পরিপূর্ণ হয় না। জরিপ একটি পরিশ্রমের কাজ। সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য জরিপ সঠিক হওয়া চাই। সে জন্যই যখন কোনো গবেষণা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তখন জরিপ সঠিক পদ্ধতিতে হয়েছে কি না সেটা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। যে জরিপ নিয়ে আমি কথা বলতে শুরু করেছি তা পরিচালিত হয়েছে গ্রাম ও শহরের ২ হাজার ৩৬৩ জন মানুষের মধ্যে।

জরিপটি পরিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মানুষ দেশ এবং দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবছে সেটাই বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। এতে দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে দুটি প্রশ্ন ছিল এবং এখানে দুটি বিকল্প ছিল। এক. যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর; দুই. অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে যতদিন প্রয়োজন ক্ষমতায় থাকা।

২২ আগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ জরিপ চালানো হয়। বিআইজিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মির্জা এম হাসান এ জরিপে নেতৃত্ব দেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি মির্জা এম হাসানকে চিনি না। নেট খুঁজে যেটা বুঝলাম ইনি একজন প্রফেশনাল গবেষক। বর্তমান শিক্ষা ও পরিকল্পনাবিষয়ক উপদেষ্টা জনাব ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে অনেক দিন কাজ করেছেন। বোঝা যায় জরিপটিকে হালকাভাবে নেওয়ার অবকাশ নেই। তাছাড়া ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় সুনামের সঙ্গে বহু গবেষণাই পরিচালনা করেছে। কিন্তু তার পরেও চিন্তার উদ্রেক করে জরিপটি।

অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস মূল্যায়ন করে পত্র-পত্রিকাগুলো লেখালেখি করেছে অনেক। কোনো কোনো দল বা সংগঠন এক মাসের বেশি আলোচনা করেছে; কিন্তু সবাই এ কথা বলেছে- এক মাস সরকারের মূল্যায়নের জন্য কোনো সময়ই নয়। ব্র্যাক এবং মির্জা এম হাসান জরিপের জন্য এত অল্প সময় বেছে নিলেন কেন? মাত্র ২ হাজার ৩৬৩ জনের ওপর চালানো জরিপ, আবার মতামত গ্রহণ করা হয়েছে টেলিফোনে। এক ঘৃণিত ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর যে অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে তা নিশ্চয়ই জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করেছে। এখানে কে এলেন সেই বিবেচনা মানুষ বড় আকারে করেনি। এরকম একটা সরকারকে সরিয়ে যারাই ক্ষমতায় আসে তারাই এ ধরনের সমর্থন পান। অতীতেও আমরা এরকম উদাহরণ দেখেছি। নোবেলবিজয়ী এবং সেই কারণে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে থাকার কারণে নিশ্চয়ই এ সরকারের ওপরে মানুষের বাড়তি আস্থা তৈরি হয়েছে। কিন্তু অত বড় মাপের কেউ না এলেও সরকার এ সময়ের মধ্যে সমর্থন হারিয়ে ফেলত এরকম ভাববার কোনো কারণ নেই। এ সমর্থন কি ৭১ শতাংশ থাকত নাকি কমে যেত তা ভেবে লাভ নেই। ওটা জানা যেত না। ভাবনাটাই খুব হাইপোথেটিক্যাল।

এ সময়ের মধ্যে সরকার মৌলিক এমন কোনো কাজ করেনি। মৌলিকইবা বলব কেন, বড় মাপেরও কিছু করেনি বা করতে পারেনি। যেমন দেশের অভ্যন্তরীণ আইন-কানুন, নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রয়োজন যে পুলিশ বাহিনী সেটাই এখনো প্রয়োজনীয় অর্থে সক্রিয় নয়। জনপ্রশাসনে তো রীতিমতো বিশৃঙ্খলা। অনেকে বলছেন পুরনো যা কিছু ছিল, যেমন ছিল তেমনই আছে। যারা চাকরি ছেড়ে গেছে দুর্নীতি বা দলবাজির কারণে তাদের জায়গায় হয়তো নতুন লোক দেওয়া হয়েছে। তারাও নতুন বোতলে পুরনো মদের মতো স্বৈরাচারী সরকারের দোসর। ১৬ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সংবিধান সংরক্ষণ কমিটি এবং বাংলাদেশ আইনজীবী অধিকার পরিষদের এক আলোচনা সভায় গিয়েছিলাম। রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি আইনজীবী নেতারাও সেখানে বক্তব্য রেখেছিলেন। তাদের কেউ কেউ তীব্র এবং সুতীক্ষè ভাষায় সরকারের সমালোচনা করলেন। তাদের অভিযোগ, যে বিচারকরা একবার জুডিশিয়াল ক্যু করার চেষ্টা করেছিলেন, তাদের অনেকেই এখনো চাকরিতে বহাল আছেন। কারা বিগত সরকারের আমলে এ আন্দোলনকারী শক্তির বিরুদ্ধাচরণ করেছিল তাদের নামের লিস্ট দেওয়া হয়েছে সরকারের কাছে। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আইনজীবী নেতারা সরকারের তীব্র সমালোচনা করলেন। সে তুলনায় রাজনৈতিক নেতারা কিছুই বললেন না।

আমি সরকারের সমালোচনা করার জন্য এসব লিখছি না। আমি বলছি এসব ব্যর্থতা কিংবা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সরকার জনপ্রিয়? তা কি ৭১ শতাংশ নাকি ৫১, সেই বিচার এখনই কী দরকার? ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো বলতে পারে এটা তো আমাদের নিয়মিত একটা প্রক্রিয়া। এর মধ্যে অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। তাদের কথাই হয়তো ঠিক। কিন্তু যেভাবে সব পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছে তাতে সাধারণ পাঠকের কাছে এ রকম কিছু একটা মনে হতে পারে, যেন সরকারকে ৭১ শতাংশ জনপ্রিয় দেখানোই এ রিসার্চের উদ্দেশ্য। এরকম আমরা তো অতীতেও দেখেছি।

মানুষের ভাবনায় যে একটা ধাক্কা লাগতে পারে তার আরও কিছু বাস্তবিক কারণ অবশ্য আছে। আইনজীবীদের অভিযোগের কথা একটু আগে বললাম। প্রশাসন সম্পর্কেও প্রায় একই কথা বলা যেতে পারে। প্রফেসর ইউনূস বলেছেন, আমাদের সমালোচনা করুন। যা মনে করেন তা বলুন। আগে এরকম বলা যেত না। বললে যে খড়গ, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নেমে আসত তা আমরা সবাই জানি। আমার নিজের ওপরও এরকম হয়েছে। সরাসরি সরকারি হস্তক্ষেপে তিনটি টেলিভিশনের উপস্থাপনা থেকে আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। টকশোতে আমাকে ডাকতে নিষেধ করা হয়েছে। পত্র-পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা বারণ করা হয়েছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে। উপস্থাপনা করার জন্য কেউ বলেননি, কিন্তু কথা বলার জন্য ডাকছেন। পত্রিকাগুলো লিখতে অনুরোধ করছে এবং আমি লেখা শুরু করেছি। আমি এ-ও জানি একটি বিশেষ সংস্থা থেকে মিডিয়াকে বলা হয়েছে- আপনারা প্রাণভরে লিখতে পারেন; খবর দিতে পারেন। কেউ আপনাদের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা দেবে না। এদিক থেকে পরিস্থিতির নিশ্চয়ই উন্নতি হয়েছে এবং এর ফলে কিনা জানি না সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখি শুরু হয়েছে। আমি দুটি লেখা এখানে তুলে ধরব, যেটা ফেসবুকে দুজন পোস্ট দিয়েছেন।

জনাব হাসান লিখেছেন- আওয়ামী যুগের ঢাকার সাবেক জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার ঢাকা, সচিব সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং বিমা উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারীকে আবার সাধারণ বীমা করপোরেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তিন বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর আগে আওয়ামী আমলের সুবিধাভোগী দুজন সচিবকে অন্তর্বর্তী সরকারে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনে এ ধরনের নিয়োগের কথা আরও অনেকে লিখেছেন। এ কথা সত্যি, ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ সরকার চূড়ান্ত দলীয়করণ করেছে। প্রশাসনের প্রায় সর্বস্তরে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কেউ একজন যে কোনো কারণে বাদ পড়ে গেলে বা হয়ে গেলেও সেই শূন্যস্থান পূরণে নতুন লোক পাওয়া কঠিন; যিনি বা যারা নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার চেতনার সঙ্গে ছিলেন কিংবা এখন তৈরি হয়েছেন। এ কারণেই সরকারের সমালোচনা হচ্ছে এবং হবে। অবিমিশ্র সমর্থন স্থির আছে এ কথা বিনা দ্বিধায় বিশ্বাসযোগ্য নয়। ক্যাম্পেইন করে সেটা হবে না। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিক অনলাইন জরিপ করেছে। এক মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগ ও কার্যক্রম নিয়ে জানতে ১০ থেকে ১২ সেপ্টেম্বর ওই দৈনিকের ফেসবুক পেজে এ জরিপ চালানো হয়। জরিপে মোট ১ লাখ ৩ হাজার ৬৫৬ জন ভোট দেন। এতে প্রশ্ন ছিল- অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম এক মাসে নেওয়া উদ্যোগ ও কার্যক্রমে আপনি কি সন্তুষ্ট? এ প্রশ্নের জবাবে হ্যাঁ বলেছেন ৪৫ হাজার ২৭৩ জন, যা ৪৫ শতাংশ। অন্যদিকে না বলেছেন ৫৩ হাজার ৭২২ জন, যা মোট মতামত প্রদানকারীর ৫১ শতাংশ।

লেখক : সভাপতি, নাগরিক ঐক্য

সর্বশেষ খবর