ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। সবাইকে অবাক করে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন বামপন্থি নেতা অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে। এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দিশানায়েকে দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ও পরিচিত ব্যক্তিকে হারিয়ে বিস্ময়কর বিজয় লাভ করেছেন। ফলে তার এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে দেশটিতে নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের আভাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় স্বাধীনতার পর যে দুই প্রধান দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি ও ফ্রিডম পার্টি দেশটির দন্ডমুন্ডের হর্তাকর্তা ছিল, এবারের নির্বাচনে তাদের বিপর্যয় হলো। আর ক্ষমতার শীর্ষে ওঠে এলেন এমন এক প্রেসিডেন্ট যা নিয়ে কারও তেমন উচ্ছ্বাস ছিল না।
উল্লেখ্য, শ্রীলঙ্কার এবারের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন ৩৯ জন। তবে দ্বিতীয় দফা নির্বাচন শেষে তিনজন আলোচনায় আসেন। তারা হলেন- ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে, সাবেক প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসার ছেলে সাজিথ প্রেমাদাসা এবং নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে। প্রথম দফায় ১ কোটি ৭০ লাখ ভোটারের মধ্যে মার্কসবাদী বামপন্থি রাজনীতিবিদ অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে ৩৯.৬৫ শতাংশ ভোট পেয়ে এগিয়ে ছিলেন। বিরোধীদলীয় নেতা (এসজেবি) সাজিথ প্রেমাদাসা ৩৪.০৯ শতাংশ ভোট নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থান লাভ করেন। তবে দ্বিতীয় দফায় তুমুল গতিতে এগিয়ে যান অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে। তিনি লাভ করেন ৪২.৩১ শতাংশ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাজিথ প্রেমাদাসার ভোট কমে দাঁড়ায় ৩২.৭৬ শতাংশ। আর ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে লাভ করেন মাত্র ১৭ শতাংশ ভোট। উল্লেখ্য, ক্ষমতাচ্যুত রাজাপাকসের পরিবারের নবীন সদ্য হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন নামাল রাজাপাকসে। তবে তিনি পান মাত্র ২.৫৭ শতাংশ ভোট। মোট ভোটারের ৭০ শতাংশ ভোটে অংশগ্রহণ করেছিল। মজার বিষয় হলো- ২০২০ সালে অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকের দল সংসদে ২২৫ আসনের মধ্যে মাত্র তিনটি আসন লাভ করেছিল এবং তাদের ভোটের অংশগ্রহণ ছিল মাত্র ৩ শতাংশ। আর মাত্র চার বছরের মাথায় তা দাঁড়িয়েছে ৪২.৩১ শতাংশে।
দীর্ঘদিন শ্রীলঙ্কা শাসন করেছিল দুটি রাজনৈতিক পরিবার ও দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি ও ফ্রিডম পার্টি। ২০২২ সালে গণবিপ্লবে রাজাপাকসে পরিবারের ক্ষমতাচ্যুতির পর শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে পরিবর্তনের আভাস পরিলক্ষিত হয়। এরই প্রেক্ষাপটে বামপন্থি দলের উত্থান ঘটে। ১৯৬৮ সালে জন্মগ্রহণকারী মার্কসবাদী নেতা দিশানায়েকে এরই মধ্যে নীরবে ও অলক্ষ্যে এগিয়ে আসেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি শ্রীলঙ্কার রাজাপাকসে পরিবারের দুর্নীতি ও দুর্বল শাসনের কঠোর সমালোচনায়মুখর হন এবং সাধারণ মানুষের কাছে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৯৫ সালে দিশানায়েকে জনতা বিমুক্তি পেরামুনার (জেভিপি) পলিটব্যুরোতে যোগ দেন। ২০০০ সালে তিনি প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৪ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দিশানায়েকে সরকারের কৃষি, প্রাণিসম্পদ, ভূমি ও সেচমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি প্রধান বিরোধী হুইপ হিসেবে কাজ করেন। দুর্দান্ত ও যোগ্য নেতা হিসেবে দিশানায়েকে ২০১৪ সালে জেভিপির নেতা হিসেবে নির্বাচিত হন। তার এ দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, সফল নেতৃত্ব এবং জনসম্পৃক্ততা তাকে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে।বামপন্থি দলের নেতা দিশানায়েকের জনপ্রিয়তা এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। প্রথমত মাহিন্দা রাজাপাকসে পরিবারের একচ্ছত্র আধিপত্যের প্রতি মানুষের ক্ষোভ। এ পরিবারের সীমাহীন দুর্নীতি ও অপশাসনের ফলে ২০২২ সালে গণপ্রতিরোধের মুখে সরকারের পতন ঘটে। তখন রাজাপাকসে পরিবারের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় বসেন রনিল বিক্রমাসিংহে। উল্লেখ্য, রাজাপাকসের পতনের পর তারই প্রতিনিধি রনিল বিক্রমাসিংহের বিভিন্ন পদক্ষেপ সাধারণ মানুষের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে গিয়ে তিনি আয়কর বৃদ্ধি করেন। নিত্যপণ্যের ওপর করারোপ করেন এবং ভর্তুকি কমানোর মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যা জনমনে ক্ষোভ তৈরি করে। এতে সাধারণ ভোটারদের কাছে তিনি অপ্রিয় হয়ে ওঠেন। যার প্রভাব পড়ে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে।
দ্বিতীয়ত, ২০২২ সালে গোতাবায়ে সরকারের বিরুদ্ধে যে জনরোষ তৈরি হয় সেই বিক্ষোভে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে দিশানায়েকের দল জেভিপি। আন্দোলনের পর জেভিপি বৃহত্তর পরিবর্তনের ডাক দেয়। বিশেষ করে সামাজিক ন্যায়বিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দলটির অনড় অবস্থানের কারণে সাধারণ মানুষ দিশানায়েকের নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল হয়ে ওঠে। তা ছাড়া দিশানায়েকের ব্যক্তিত্ব ও বলিষ্ঠতা মানুষকে আগ্রহী করে তুলে। ফলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার প্রতি ব্যাপক ভোটের জোয়ার তৈরি হয়।
তৃতীয়ত, বামপন্থি দলটি গত শতকের সত্তর ও আশির দশকে দুটি বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিল। ফলে তাদের ওপর নেমে আসে সরকারের চরম জুলুম ও নির্যাতন। এতে দলটি গণগ্রেপ্তার, নির্যাতন, অপহরণ ও গণহত্যার শিকার হয় এবং দলের কমপক্ষে ৬০ হাজার মানুষ নিহত হয়। তখন তারা মানুষের কিছুটা সহানুভূতি লাভ করেন। এদিকে এ সহিংসতা থেকে বেরিয়ে এসে দিশানায়েকের নেতৃত্বে জেভিপি গঠনমূলক রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করলে মানুষের মাঝে দলের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। এবারের নির্বাচনে দলের নির্বাচনি কৌশল বিশেষ করে রাজাপাকসের আমলের অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে দেশকে উদ্ধার ও ৬০ দিনের মধ্যে আগের আমলের সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিশানায়েকেকে অগ্রগামী করে এবং তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন।
চতুর্থত, বর্তমান সরকারের কয়েকটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা সরকারের প্রতি মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, সমুদ্র থেকে উদ্ধার করা জায়গা নিয়ে কলম্বো পোর্ট সিটি নির্মাণ, হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর প্রকল্প, হাম্বানটোটায় নতুন বিমানবন্দর নির্মাণ এবং ৯৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এক্সপেসওয়ে নির্মাণ। এগুলোর বাস্তবায়নের জন্য সরকার চীনের কাছ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ নিয়েছে। এ বিশাল ঋণের বোঝা বহন করার মতো ক্ষমতা ও সামর্থ্য আদতে সরকারের নেই। জনগণ দেশের জন্য এ উচ্চাভিলাষী প্রকল্প ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। তাই এই সরকারের বিকল্প হিসেবে তারা অনূঢ়া কুমারার মতো গঠনমূলক বামপন্থি ব্যক্তিত্বকে বেছে নিয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
পঞ্চমত, দিশানায়েকের সৎ এবং সোজাসাপটা রাজনীতির কারণে সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ক্ষমতার জন্য নয়, বরং সমাজের শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের জন্য লড়াই করার তার সংকল্প তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তোলে। তার দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান, আর্থিক ন্যায়বিচার এবং দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের আহ্বান তাকে বিশেষভাবে পরিচিত করে তুলেছে। দিশানায়েকে নিজেকে একজন সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি কোনো ধনী বা ক্ষমতাশীল পরিবারের সদস্য নন, যা তাকে ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই দিশানায়েকে ২২৫ সদস্যের পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে অঙ্গীকার অনুযায়ী দুই দিনের মাথায় নতুন সংসদ নির্বাচনের দিন-তারিখ ঘোষণা করেছেন। আগামী ১৪ নভেম্বর সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে তিনি অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করেছেন তার দলের হরিণী অমরাসুরিয়াকে। যিনি দেশটির তৃতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী। তা ছাড়া নিজ দলের তিন সংসদ সদস্যের সমন্বয়ে একটি ছোট্ট মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেছেন, যারা নির্বাচনের আগ পর্যন্ত দেশ পরিচালনা করবেন।
পরিশেষে বলা যায়, শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে দেশের মানুষের কল্যাণে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে মুক্তি ও উচ্চ দ্রব্যমূল্যের চাপ থেকে পরিত্রাণের আশায় দেশের বিরাট জনগোষ্ঠী বিশেষ করে তরুণ সমাজ নতুন প্রেসিডেন্টকে নির্বাচিত করেছে। তাই দিশানায়েকেকে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষা, বেকারত্ব দূর করা, কর ও ভ্যাটের উচ্চহার থেকে মানুষকে পরিত্রাণসহ অনেক সংস্কার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পূরণ করতে হবে দেশের মানুষের প্রত্যাশা। আগামী দিনগুলো তাই নতুন প্রেসিডেন্টের জন্য মসৃণ হবে না বলেই মনে হয়।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, বিশ্লেষক ও ব্যাংকার