মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৪ ০০:০০ টা

সার্ক হোক ভাগ্যোন্নয়নের চাবিকাঠি

রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী

সার্ক হোক ভাগ্যোন্নয়নের চাবিকাঠি

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেপ্টেম্বরের শেষভাগে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষে নিউইয়র্কে থাকাকালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা-সার্ক (সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশন) পুনরায় সক্রিয়করণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি রাষ্ট্র- বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানের সমন্বয়ে গঠিত এ সহযোগিতা সংস্থাটির রাষ্ট্রনেতা সম্মেলনসহ প্রায় ৯০ শতাংশ কার্যক্রম দীর্ঘদিন অকার্যকর হয়ে রয়েছে। ফলে এ অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অস্বীকার করা যাবে না, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সংস্থাটির দ্রুত সক্রিয়করণ অত্যাবশ্যক।

আমরা জানি, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সত্তরের দশকের শেষভাগে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালে দক্ষিণ এশীয় আন্তর্জাতিক সংস্থাটি গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং এর প্রাথমিক সাংগঠনিক কর্মকান্ড শুরু করে ছিলেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে নিহত হন; তিনি আর এগোনোর সুযোগ পেলেন না। তবে পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট জিয়ার ধ্যানধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপের রাষ্ট্রনেতারা মিলে ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে এক সম্মেলনে মিলিত হয়ে সাত রাষ্ট্রীয় সার্ক প্রতিষ্ঠা হয়। সব গণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারবিরোধী রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে গড়ে তোলা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ‘সার্ক’ সম্মেলন উপলক্ষে সামরিক শাসক এরশাদকে কনসেশন দেয়। তখন যদি বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল স্বৈরাচার এরশাদের পতনের লক্ষ্যে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে সার্ক গঠনে বাধা দিত তাহলে এরশাদের পতন ঘটানো পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যেই সম্ভব হতো।

আর তার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকারের উদ্যোগেই সার্ক প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম দ্রুততার সঙ্গে শুরু করা যেত। বিরোধী দলগুলোর নেতাদের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে দোদুল্যমানতা এরশাদকে আরও পাঁচ বছর (১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর অবধি) স্বৈরশাসন চালানো আর রাষ্ট্র-লুণ্ঠনের সুযোগ করে দিয়েছিল। জিয়াউর রহমান যখন বাংলাদেশের সঙ্গে চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সাফল্য পেলেন, তখনো তিনি ভারতের সঙ্গে উপযুক্ত কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জোর প্রচেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হচ্ছিলেন। পতিত একদলীয় বাকশাল সরকারের এক জেলা গভর্নর তার প্রায় ৫০০ সন্ত্রাসী অনুসারীকে সঙ্গী করে প্রচুর যুদ্ধাস্ত্র সজ্জিত হয়ে সাবেক সংসদ সদস্য চিত্তরঞ্জন সুতারের সহযোগিতায় ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটা অবাঞ্ছিত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। তাদের আক্রমণে বাংলাদেশ নিরাপত্তা বাহিনীর অনেক সদস্য হতাহত হচ্ছিলেন। এসব সন্ত্রাসীর প্রতি বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় দেশপ্রেমিক নাগরিকদের কোনো সমর্থনই ছিল না, বরং ছিল সীমাহীন ঘৃণা। এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসীরাই ভারত সরকারকে বিভ্রান্ত করার জোর অপচেষ্টা চালাচ্ছিল- বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থি একটি সরকার ভারতবিরোধী অবস্থান নিয়ে বিশেষ মিশন চালাচ্ছে। [অবশ্য বেশ কয়েক বছর পর ভারত একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জিয়াউর রহমানের আসল অবস্থান যে পরিচ্ছন্ন (বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ আশ্রিত সুস্থ রাজনীতির) তা বুঝতে পারে এবং ওইসব সন্ত্রাসীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দান বন্ধ করে দেয়, আর প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করে]।

কিন্তু ১৯৭৫-এর পর অভিযোগ উঠতে থাকে, আমাদের বৃহৎ-প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত তার ভূ-রাজনৈতিক কূটকৌশল প্রয়োগ দ্বারা এ অঞ্চলের দেশগুলোর ওপর আধিপত্য চালাচ্ছে। এমতাবস্থায় প্রেসিডেন্ট জিয়া দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোকে সঙ্গে নিয়ে সম্প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদ মোকাবিলার পাশাপাশি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সক্রিয় সহযোগিতা গড়ার আহ্বান জানান। রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে গণমানুষের জীবনমান উন্নয়নের ইতিবাচক বিষয়গুলোকেও প্রধান বিবেচ্য হিসেবে মাথায় রেখেছিলেন তিনি। তাঁর চিন্তা-চেতনা যে অত্যন্ত গঠনমূলক তা স্বীকার করে নেয় ভারতসহ অন্য দেশগুলো। সত্তর দশকের শেষভাগে এবং আশির দশকের শুরুতে প্রেসিডেন্ট জিয়ার দক্ষিণ এশিয়ার সাত/আটটি রাষ্ট্রকে নিয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ছিল এক অসামান্য কূটনৈতিক ও রাষ্ট্রনায়কোচিত সিদ্ধান্ত- যথার্থ এক বিশ্বনেতার উপযুক্ত কর্মকান্ড।

সার্ক গঠনের পরও ভূ-রাজনীতির স্বার্থে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী বৃহৎ রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান সুকৌশলে এটিকে যথাযথভাবে এগোতে বাধা দিয়ে আসছে। ১৯৮৫ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকায় প্রথম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে সার্ক কার্যক্রম শুরু হয় এবং পরবর্তী এক বছরেরও বেশি সময়কাল পর ১৯৮৭ সালের ১৭ জানুয়ারি নেপালে সার্ক সচিবালয় কর্মতৎপরতা আরম্ভ করে। সার্ক প্রতিষ্ঠার সময়েই ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়েছিল, দক্ষিণ এশিয়ার সমগ্র জনগোষ্ঠীর সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে এটি সৃষ্টি করা হলো- এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নত করা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গতিময় করা, সামাজিক অগ্রগতি এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি এ অঞ্চলের মানুষের মানসম্মান বৃদ্ধি ও তাদের ভিতরের সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপদানের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। তা ছাড়া সার্ক বিশ্বের অন্যসব উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্কোন্নয়ন এবং একই ধরনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার জোর প্রচেষ্টা চালাবে।

২০১৪ সালে সর্বশেষ সার্ক শীর্ষ সম্মেলন হওয়ার পর আর কোনো বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলন হতে পারেনি। ভারত ও পাকিস্তানের কারণেই সার্ক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ২০২০ সাল অবধি নেপাল সার্ক পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের অনানুষ্ঠানিক সম্মেলন করেছে। শেষ বৈঠকটি হয়েছে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে- করোনা পরিস্থিতির কারণে। কভিড-১৯ শুরুর পর সার্ক ২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ তহবিল গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। সেটাই একটা মোটামুটি ইতিবাচক কার্যক্রম। সার্ক কার্যক্রম নিয়ে একটা নেতিবাচক সমালোচনা রয়েছে- এটি সার্ক রাষ্ট্রসমূহের রাষ্ট্রপ্রধানদের বার্ষিক ‘পিকনিক পার্টি’ বা ‘প্রমোদ ভ্রমণের রাষ্ট্রীয় অপচয়ের আয়োজন’। এ সমালোচনাটি হেসে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ, জিয়াউর রহমানের স্বপ্ন দেখা সার্ক কার্যক্রম তার ৫ শতাংশ লক্ষ্য অর্জনেও সক্ষম হয়নি। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ১৯০ কোটি মানুষের জীবনমান উন্নয়নে প্রকৃত সহযোগিতা কার্যক্রম বাস্তবায়ন জরুরি- সে লক্ষ্যে কোনো অগ্রগতিই নেই। আমরা চাই সার্কের পুনরুজ্জীবন হোক এ এলাকার ১৯০ কোটি মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের চাবিকাঠি।

               

লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক

সর্বশেষ খবর