বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার’-এর উদ্যোগে প্রতি বছর বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ১০ অক্টোবর ‘বিশ্ব স্তন ক্যান্সার’ দিবস পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হলো : ‘স্তন ক্যান্সার নিয়ে কাউকে যেন একা লড়তে না হয়’। এ ছাড়া বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী ০১ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে সচেতনতার মাস হিসেবেও পালন করা হয়। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন এনজিও এই সচেতনতা কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। সাধারণ মানুষের মধ্যে স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয় ও সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণ এসব কার্যক্রমের অন্যতম উদ্দেশ্য। ঢাকা ও সারা দেশের জেলা-উপজেলায় গোলাপি সড়ক শোভাযাত্রা ও সহজ বাংলায় প্রয়োজনীয় তথ্যসমৃদ্ধ লিফলেট বিতরণ করা হয়। গোলাপি ফিতা স্তন ক্যান্সার সচেতনতার একটি আন্তর্জাতিক প্রতীক। গোলাপি ফিতা এবং সাধারণভাবে গোলাপি রং, স্তন ক্যান্সার ব্র্যান্ডের সঙ্গে পরিধানকারী বা প্রচারকারীকে চিহ্নিত করে এবং স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য নৈতিক সমর্থন প্রকাশ করে। জাতীয় স্তন ক্যান্সার সচেতনতা মাসে গোলাপি ফিতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। অস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভূত আমেরিকান একজন ব্যবসায়ী ও জনহিতৈষী এভেলিন লাউডার ১৯৯৯ সালে পিঙ্ক রিবন সিম্বলটি তৈরি করেন। বিশ্বের সব মেয়ের মধ্যে পিঙ্ক রিবনের সাহায্যে ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য তিনি সম্পূর্ণ নিজের পরিকল্পনায় এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
নাম থেকে বোঝা যায়, স্তনের কোষে যে ক্যান্সার হয় তাকে স্তন ক্যান্সার বলে। এটি মহিলাদের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণভাবে ঘটতে থাকা ক্যান্সারগুলোর মধ্যে একটি। গত কয়েক বছরে উন্নত চিকিৎসা ও প্রযুক্তিগত সুবিধা প্রাথমিকভাবে স্তন ক্যান্সার শনাক্তকরণ ছাড়াও এর চিকিৎসা এবং এ সম্পর্কিত মৃত্যু হ্রাস করেছে। দেশে প্রতি বছরই ক্যান্সার আক্রান্তের হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বিষয়টি উদ্বেগের এবং দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্যও অশনিসংকেত। নানা ধরনের ক্যান্সারের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের হার বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও অনেক বেশি। এই ক্যান্সারে মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতি বছর গড়ে নতুন করে প্রায় গড়ে ১৩ হাজার নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং এর মধ্যে ৬ থেকে ৭ হাজারেরও বেশি নারীর মৃত্যু হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যান্সার দ্রুত শনাক্ত ও প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের পাশাপাশি সুচিকিৎসা গ্রহণ করলে এ ক্যান্সারে আক্রান্ত শতকরা ৯৫ ভাগ রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা সম্ভব। আগে থেকে সচেতনতা কিছুটা বাড়লেও এখনো অনেকেই সেভাবে অসুখটাকে আমল দেন না। আর তাই রোগ ধরা পড়তে দেরি হয়ে যায়। প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী স্তনের টিউমার দুই ধরনের। (এক) বিনাইন টিউমার- এটা অক্ষতিকারক। উৎপত্তিস্থলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। দূরের বা কাছের অন্য কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে আক্রান্ত করে না। (দুই) ম্যালিগন্যান্ট টিউমার যা আগ্রাসী এবং ক্ষতিকর। উৎপত্তিস্থলের সীমানা ছাড়িয়ে আশপাশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিংবা গ্রন্থিকে আক্রান্ত করে। এমনকি রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে দূরের কোনো অঙ্গেও আঘাত হানতে পারে। স্তনের মধ্যে ঘন হওয়া বা পি-, যা পাশের টিস্যু থেকে আলাদা মনে হয়। স্তনের আকার বা চেহারাতে পরিবর্তন। স্তনের চারপাশের ত্বক কমলার খোসার মতো দেখায়। স্তনের ত্বকের রঙের পরিবর্তন যেমন লালচে হওয়া।
বাড়তি ওজন ব্রেস্ট ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। বয়স একটা বড় ঝুঁকি। ইদানীং মানুষের গড় আয়ু অনেক বেড়েছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়ছে। আর এই কারণেই ইদানীং স্তন ক্যান্সারও বাড়ছে। দেরিতে বিয়ে বা বিয়ে না করা কিংবা সন্তান না হওয়া স্তন ক্যান্সার ডেকে আনতে পারে। অল্প বয়সে মেনার্কি অর্থাৎ পিরিয়ড শুরু হওয়া এবং বেশি বয়সে মনোপজ হলে দীর্ঘদিন ইস্ট্রোজেন নিঃসৃত হয়। ইস্ট্রোজেন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ালেও ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে। ভাজা ও তৈলাক্ত খাবার, ফাস্টফুড, অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট খেলে ওজন বেড়ে যায়, ফলে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। বয়স ৩০ পেরোলেই নিয়মিত ব্রেস্ট পরীক্ষা করা উচিত। প্রয়োজনে আল্ট্রাসনোগ্রাফি এবং ম্যামোগ্রাম করা দরকার। এ ছাড়া নিয়মিতভাবে নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা করার কৌশল জানতে হবে। যেটাকে ইংরেজিতে বলে সেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন বা SBE। গুগল বা ইউটিউবে সার্চ দিলে SBE কীভাবে করা যায় তা জানা যাবে। বয়স ১২ হওয়ার পর থেকে মেয়েরা নিয়মিতভাবে নিজের স্তন নিজেই পরীক্ষা করার অভ্যাস করতে পারলে ক্যান্সারের প্রকোপ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসবে। ৪০-৪৪ বছর বয়সি মহিলাদের প্রতি বছর ম্যামোগ্রাম করা যায়। ম্যামোগ্রাম স্তনের জন্য এক্স-রে-এর মতো। মহিলারা একটি মেশিনের সামনে দাঁড়ালে তাদের স্তন আলতোভাবে চেপে ধরে ছবি তোলা হয় এবং কোনো অস্বাভাবিক গলদ বা দাগ খুঁজে বের করা হয়।বিশেষজ্ঞদের মতে যে কোনো ক্যান্সারের সম্প্রসারণকে বাধা দেওয়া যায় ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে। এ ছাড়া আক্রান্ত হওয়ার আগেই যাপিত জীবন নিয়ন্ত্রণে রাখা, শনাক্তকরণ বা স্ক্রিনিং পদ্ধতি কঠোরভাবে অনুসরণ করার মাধ্যমেও একে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সন্তানকে মায়ের দুধ দিয়ে ক্যান্সার অনেকাংশে প্রতিরোধ করা যায়। ওজন ঠিক রাখতে শরীর বুঝে প্রয়োজনীয় সুষম খাদ্য আর ব্যায়াম করা দরকার। সুষম খাদ্য, ব্যায়াম, অ্যালকোহল বর্জন এবং স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখার মাধ্যমেই ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
লেখক : গবেষক