সোমবার, ২৫ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা
শিক্ষা ও শিক্ষক

শিক্ষার মান বাড়াতে শিক্ষকদের মান বাড়াতে হবে


শিক্ষার মান বাড়াতে শিক্ষকদের মান বাড়াতে হবে

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা এবং পাসের হার বাড়লেও শিক্ষার সার্বিক গুণগত মান বেড়েছে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাই শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকার ও স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের করণীয় এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটাতে করণীয় কি এসব বিষয়ে কথা বলেছেন ঢাকার ধানমণ্ডি গভ. বয়েজ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. ইনছান আলী। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন—মাহবুবুল আলম

 

প্রশ্ন : প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সব স্তরেই পাসের হার বাড়লেও শিক্ষার সামগ্রিক গুণগত মান বেড়েছে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। শিক্ষার গুণগত মান প্রত্যাশা অনুযায়ী না বাড়ার কারণ কি?

উত্তর :  পিএসসি, জেএসসি কিংবা এসএসসিতে পাসের হার বাড়লেও আসলে শিক্ষার সামগ্রিক গুণগত মান সেভাবে বাড়েনি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা  পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে সময়ের স্বল্পতা। কারণ পরীক্ষা শেষে পরীক্ষক খাতা মূল্যায়নের জন্য যে সময় পান সার্বিকভাবে তা  মোটেও যথেষ্ট নয়। ফলে দায় এড়াতে দ্রুত খাতা মূল্যায়নে ওভারমার্কিংয়ের কৌশল অবলম্বন করেন অনেক শিক্ষক। এতে করে  পাসের হার বৃদ্ধি পায় কিন্তু শিক্ষার মান যে হারে বাড়ার কথা ছিল তা হয় না। ফলে ওই শিক্ষার্থীদের ফলাফল দেখে তাদের যতটা মেধাবী মনে হয় আসলে তারা কিন্তু ততটা নয়। ফলে পরবর্তী জীবনে তারা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন। এছাড়া সৃজনশীলের মতো নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা এখনো তাদের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। একইসঙ্গে শিক্ষকরা এ বিষয়ে ততটা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। ফলে উভয়ের জ্ঞানের ঘাটতি এ ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে।

প্রশ্ন : শিক্ষার মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে শিক্ষকরা কি ভূমিকা রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর : শিক্ষার মান বাড়াতে শিক্ষকদের  ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর অভীক্ষা, পরীক্ষা, যাচাই, পরিমাপ ও মূল্যায়নে মনোযোগী হতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ  নেই। শ্রেণিকক্ষে কোনো বিষয়ে পাঠদানের পূর্বে ওই বিষয়ে তিনি ভালোমতো জ্ঞানার্জন করবেন। একজন শিক্ষক তার বিশ্লেষণ থেকে শিক্ষাক্রম বিশেষ করে শিক্ষণের বিষয়, শিক্ষণ পদ্ধতি, শিক্ষা উপকরণের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে পাঠের বিষয়বস্তু পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও উত্কর্ষ সাধন করতে পারেন। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ের বাইরের অনেক কিছু জানার সুযোগ পাবে।

প্রশ্ন : প্রশ্ন আছে, বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় সময়োপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে না। এ থেকে উত্তরণে করণীয় কী?

উত্তর : বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় সময়োপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে না এই বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নয়। এক্ষেত্রে সরকারের প্রচেষ্টার কোনো ঘাটতি নেই। তবে শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও বেগবান করার জন্য যথেষ্ট মনিটরিং ও তত্ত্বাবধানের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এছাড়া, শিক্ষকদের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে গবেষণামুখী হতে হবে এবং সমসাময়িক বিষয়ে প্রচুর ধারণা থাকতে হবে। একই সঙ্গে তা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে।

প্রশ্ন : প্রাথমিক স্তরের পিএসসি ও মাধ্যমিক স্তরের জেএসসি পরীক্ষা আর থাকছে না বলে শোনা যাচ্ছে। এটিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

উত্তর : বর্তমান শিক্ষানীতির আলোকে প্রথম  থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার আওতাভুক্ত হতে যাচ্ছে। একারণেই শিক্ষানীতি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার (পিএসসি) আর কার্যকারিতা থাকবে না। তবে এ স্তরের শেষ ধাপে অষ্টম শ্রেণি হওয়ায় জেএসসি তুলে দেওয়া ঠিক হবে না। আর যদি সেটা করাও হয় তা যেন একবারে না করে পর‌্যায়ক্রমে পরিবর্তন করা হয়। পিএসসি ও জিএসসি উঠে গেলে স্বল্প সময়ের কারণে শিক্ষকদের ওভারমার্কিংয়ের প্রবণতা কমে আসবে। তাছাড়া দেখা যায়, প্রত্যেক  শ্রেণিতে যে অনুপাতে শিক্ষার্থীরা জিপিএ-৫ পায়, পাবলিক পরীক্ষায় কিন্তু তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি জিপিএ-৫ প্রাপ্তির ঘটনা ঘটে। এর কারণ ঘরোয়াভাবে শিক্ষকরা ভালোভাবে খাতা মূল্যায়ন করেন, কারণ শিক্ষর্থী ও প্রধান শিক্ষকের কাছে তাদের দায়বদ্ধতা থাকে যা পাবলিক পরীক্ষায় দেখা যায় না।

প্রশ্ন : শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়ার আগ্রহ কমে গেছে বলে বিভিন্ন গবেষণা বা জরিপে দেখা গেছে। এর কারণ কী?

উত্তর : আশি ও নব্বইয়ের দশকের কারিকুলামে নবম ও দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বই পড়ানোর জন্য স্নাতক পাস শিক্ষকই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু বর্তমান কারিকুলামে যে ধরনের বিজ্ঞান বই শিক্ষার্থীদের দেওয়া হচ্ছে তা যথাযথভাবে শিক্ষার্থীদের বোঝানোর জন্য স্নাতকোত্তর শিক্ষকের প্রয়োজন। অথচ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের যোগ্যতাসম্পন্ন ও দক্ষ উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষকের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা না বোঝার কারণে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এক্ষেত্রে একমাত্র যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষকই তার দক্ষতার মাধ্যমে বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষার্থীদের আনন্দমুখর করে তুলতে পারেন। পাশাপাশি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য কর্মক্ষেত্রের জায়গা বাড়াতে পারলেও এক্ষেত্রে সুফল পাওয়া যাবে।

প্রশ্ন : মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে কমিউনিকেটিভ ইংরেজি চালু আছে। শিক্ষার্থীদেরকে ইংরেজির ব্যবহারিক দিক সম্পর্কে আরও সমৃদ্ধ করতেই তা করা হয়েছে। এটি তা কতটা সফল হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর : কমিউনিকেটিভ ইংরেজির ৪টি বিষয় যথা লার্নিং, স্পিকিং, রিডিং এবং রাইটিংয়ে সমানভাবে উত্কর্ষ সাধন হলেই কেবল এই বিষয়ের সফলতা আশা করা যায়। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক এবং পর‌্যাপ্ত মনিটরিংয়ের অভাবে উপরিউক্ত বিষয়ের মধ্যে কেবল লার্নিংয়ে দক্ষতা ছাড়া বাকিগুলোর তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।

প্রশ্ন : বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় সাফল্যের সঙ্গে টিকে থাকতে হলে শিক্ষার্থীদের করণীয় কী?

উত্তর : প্রথমত কারিকুলাম অনুসারে পাঠ্যবইটি বুঝে পড়তে হবে। এক্ষেত্রে ফাঁকি  দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে শুধু  টেক্সবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। বর্তমান প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার জন্য সমসাময়িক বিষয়াবলীর দিকেও সমান দৃষ্টি রাখতে হবে। নজর রাখতে হবে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনাবলির দিকেও। পাশাপাশি নিজেকে দক্ষ এবং যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষার প্রতিও জোর দিতে হবে।

প্রশ্ন : শিক্ষার্থীদের মাঝে মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্টদের করণীয় কী?

উত্তর : শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল করে গড়ে  তোলার সুযোগ দিতে হবে। তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গায় নিয়ে তাদের উৎসাহিত করতে হবে। তবে তাদের একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া যাবে না। সমাজের আচার-আচরণ, রীতি-নীতির শিক্ষা দিতে হবে। এই শিক্ষা শুধু শিক্ষক দেবেন এমন ভাবার যেমন অবকাশ নেই, তেমনি পিতা-মাতা দেবেন এমনও ভাবা যাবে না। স্ব স্ব অবস্থান  থেকে মানবিক মূল্যবোধের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই একজন শিক্ষার্থী মানবিক মূল্যবোধের গুণে গুণান্বিত হবে।

প্রশ্ন : দেশে কর্মমুখী শিক্ষার সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

উত্তর : সরকারের এই উদ্যোগ দেশের জন্য সত্যিই আশাব্যঞ্জক। যদি এটিকে সার্বিকভাবে পরিচালনা করা যায় তবে দেশে বেকারের সংখ্যা অনেক কমে আসবে। তবে শুধু উদ্যোগ নিলেই চলবে না, এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের দক্ষ ও কর্মোপযোগী করে তোলার জন্য শিক্ষকদের অবশ্যই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং গবেষণায় পারদর্শী হতে হবে। একইসঙ্গে শিক্ষা দেওয়ার জন্য ক্লাস রুমে সেসব সরঞ্জামের প্রয়োজন তার যথেষ্ট সরবরাহ থাকতে হবে।

প্রশ্ন : শহরাঞ্চলের শিক্ষাঙ্গনে খেলার মাঠ নেই। ফলে পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। এতে মেধাবিকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা কী পিছিয়ে পড়ছে?

উত্তর : শিক্ষা এমন একটি বিষয় যেখানে মনোযোগের জন্য আনন্দমুখর পরিবেশের প্রয়োজন হয়। কিন্তু শহরাঞ্চলের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলাধুলার জন্য মাঠ, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য কোনো অডিটোরিয়াম নেই। এটা দুঃখজনক। ফলে এই সব প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কার্যক্রমের অভাবে শিক্ষার্থীরা তাদের মেধাকে সঠিকভাবে বিকশিত করতে পারছে না। এতে করে তারা পাঠ্যক্রমবহির্ভূত কার্যক্রম চালু আছে এমন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের থেকে অনেক পিছিয়ে পড়ছে। তাই শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তির পূর্বে এই বিষয়টি নিয়ে অভিভাবকদের অন্তত একবার চিন্তা করা উচিত।

সর্বশেষ খবর